লি-ইটো কনভেনশন (Li-Ito Convention) এবং চীন-জাপানি নীতি:
ভূমিকা:
লি-ইটো কনভেনশন (Li-Ito Convention) হলো একটি চীনা-জাপানি চুক্তি যা ১৮৮৫ সালে চীনের লি-হুনঝাং এবং জাপানের ইতো হিরাবুমি (Ito Hirobumi) স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তি ছিল চীন ও জাপানের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল কোরিয়ার বিষয়ে তাদের সম্পর্ক নির্ধারণ করা। এই চুক্তির মাধ্যমে, চীন এবং জাপান একে অপরকে কোরিয়ায় নিজেদের স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এই চুক্তির প্রভাব কোরিয়া এবং আরও বিস্তৃতভাবে, চীন-জাপান সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, বিশেষ করে তাদের কোরিয়ান উপদ্বীপে রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের দৃষ্টিতে।
লি-ইটো কনভেনশনের প্রেক্ষাপট:
১৮৬৮ সালে মেইজি রেস্টোরেশন (Meiji Restoration) এর পর, জাপান আধুনিকীকরণের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে এবং নিজের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। এদিকে, চীনও ওই সময়ে দুর্বল হচ্ছিল, বিশেষত প্রথম আফিম যুদ্ধ (1839-1842) এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (1856-1860) এর পর, যখন চীন তার রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সামরিক শক্তি হারাতে শুরু করেছিল। কোরিয়া, যেটি চীনের অপ্রত्यक्ष আধিপত্যাধীন ছিল, দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ—জাপান এবং চীনের মধ্যে একটি বিরোধপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। জাপান কোরিয়ান উপদ্বীপে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত ছিল, যেখানে চীন তার প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিল।
এ পরিস্থিতিতে, ১৮৮৪ সালে কোরিয়ায় গৃহীত কূটনৈতিক সংকট এবং ১৮৮৫ সালের শিমোনোসেকি চুক্তির পর, জাপান এবং চীনের মধ্যে একটি সামরিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। এই প্রতিযোগিতার প্রেক্ষিতে, উভয় দেশ কোরিয়া নিয়ে তাদের স্বার্থের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রয়োজন অনুভব করে। এর ফলে, ১৮৮৫ সালের লি-ইটো কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়।
লি-ইটো কনভেনশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য:
লি-ইটো কনভেনশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কোরিয়ায় চীন ও জাপানের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন এবং তাদের সামরিক উপস্থিতি বা হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো নির্ধারণ করা। এই চুক্তির আওতায়, জাপান এবং চীন একে অপরকে কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং কোরিয়ার ভেতরে তাদের নিজস্ব শক্তি এবং প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে একে অপরকে সম্মান জানায়।
এই চুক্তির অধীনে, চীন ও জাপান কোরিয়া থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছিল এবং চীনকে কোরিয়ার প্রতি তার ঐতিহ্যগত আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সম্মতি দেয়া হয়। এর পাশাপাশি, চীন ও জাপান কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়। তবে, চুক্তি কখনও নিশ্চিত করে না যে, কোরিয়া সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হবে এবং কোনো পক্ষের পক্ষ থেকে একটি একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না।
লি-ইটো কনভেনশনের চীনা-জাপানি নীতিতে প্রভাব:
লি-ইটো কনভেনশন কোরিয়ার প্রতি চীন-জাপানি নীতিকে এক নতুন আকারে গঠন করেছিল, যার প্রভাব ছিল:
১. চীন ও জাপানের মধ্যে কোরিয়ার উপর দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা: এই চুক্তি চীন এবং জাপানের মধ্যে একটি আধিকারিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে, যা কোরিয়া নিয়ে তাদের সম্পর্ককে চূড়ান্তভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে, চীন এবং জাপান একে অপরের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষমতা এবং আধিপত্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিল, যদিও এটি শুধুমাত্র একটি সাময়িক সমঝোতা ছিল।
২. কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক স্বাধীনতা: লি-ইটো কনভেনশনের মাধ্যমে, কোরিয়া অভ্যন্তরীণভাবে কিছুটা স্বাধীনতা লাভ করেছিল, কারণ এই চুক্তি কোরিয়াকে দুই শক্তির সরাসরি আধিপত্য থেকে কিছুটা মুক্তি প্রদান করেছিল। তবে, চীনের সঙ্গে জাপানের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক এবং তাদের কূটনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে কোরিয়ার স্বাধীনতা যথেষ্ট সীমিত ছিল।
৩. চীনের প্রভাবের ক্ষয়: লি-ইটো কনভেনশন চীনের প্রভাবের ক্ষয়ের জন্য একটি বড় প্রভাবক ছিল। চীন তার ঐতিহ্যগত আধিপত্য এবং কোরিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করলেও, জাপান সেই সময়ে দ্রুত আধুনিক হয়ে ওঠে এবং একটি নতুন সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। জাপান কোরিয়ায় আধিপত্য স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল এবং এটি কোরিয়ায় চীনের প্রভাবের প্রতি একটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল।
৪. জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন: লি-ইটো কনভেনশন কোরিয়ার প্রতি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে ত্বরান্বিত করেছিল। যদিও চীন ও জাপান কোরিয়ায় তাদের প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য সম্মত হয়েছিল, কিন্তু জাপান পরবর্তীতে কোরিয়াকে একমাত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়, যা চীনের কোরিয়া থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে।
৫. যুদ্ধের পূর্বাভাস: এই চুক্তির ফলে চীন-জাপান সম্পর্ক আরো টানাপোড়েনপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ (১৮९৪-১৮৯৫) এর দিকে নিয়ে যায়। যুদ্ধের ফলে, জাপান কোরিয়া ও চীনের উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, যা পরবর্তীতে কোরিয়ার জাপানি দখলকে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার:
লি-ইটো কনভেনশন চীন এবং জাপানের কোরিয়া সম্পর্কের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। এই চুক্তি কোরিয়ায় তাদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করার জন্য একটি শর্তাধীন সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল, কিন্তু এটি চীনের জন্য কোরিয়ার উপর আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন করে তোলে। জাপান কোরিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই চুক্তিকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল এবং চীনকে ধীরে ধীরে কোরিয়ার রাজনীতির বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। ফলে, কোরিয়া শিগগিরই জাপানের সাম্রাজ্যবাদের অংশ হয়ে ওঠে, এবং চীন ও জাপানের মধ্যে পরবর্তী সংঘর্ষের সূচনা হয়।