রবীন্দ্রনাথের কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ করো।

অথবা, উনিশ শতকের কাব্য পরিক্রমায় রবীন্দ্রনাথের অবদান আলোচনা করো।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন যে বছর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নামক মহাকাব্য লিখলেন সে বছরই জন্ম হয় আর এক কবির। যিনি বাংলা কাব্য পরিক্রমার রাজাধিরাজের আসন অধিকার করে আছেন এযাবৎ কাল। সে নাম যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘হিন্দু মেলার উপহার’ লিখে তিনি কাব্যজগতে প্রবেশ করলেন। ‘বনফুল’ থেকে ‘ক্ষণিকা’ পর্যন্ত উনিশ শতকেই তিনি অনেকগুলি কাব্য লিখে ফেলেছেন।

রবীন্দ্রনাথের সূচনালগ্নের কাব্যগুলির মধ্যে আছে-‘সন্ধ্যা সংগীত’, ‘প্রভাত সংগীত’, ‘ছবি ও গান’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ ও ‘কড়ি ও কোমল’। এক অকারণ বিষণ্ণতায় ডুব দেখি ‘সন্ধ্যা সংগীত’ কাব্যে। পারিবারিক গন্ডিতে আবদ্ধ থাকার ফলে যে রোমান্টিক বেদনা হৃদয়কে দগ্ধ করেছে, তার প্রকাশ দেখি এ কাব্যে-

“হৃদয়ে যে ছবি ছিল ধূলায় মলিন হল তার তাহা নাহি যায় চেনা।”

‘প্রভাত সংগীত’ আপাত এক আনন্দ উৎসাহ থেকে লেখা। ফলে সাহিত্যমূল্য তেমন নেই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন “এ সমস্ত লেখার আর কোনো মূল্য যদি থাকে, ষোলো আনা সাহিত্যিক মূল্য নয়।” ‘সন্ধ্যা সংগীত’-এর বিপরীতেই এ-কাব্যের অবস্থান। সেই কাব্যে যে কৃত্রিম বিষণ্ণতা, তা থেকে কবি এই কাব্যে বেরিয়ে এলেন। তাই কবি ঘোষণা করতে পেরেছিলেন-

“জয় হোক জয় হোক মরণের জয় হোক আমাদের অনন্ত মরণ মরণের হবে না মরণ।”

রাধার বেদনাকে কবি নবচেতনা দান করলেন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ কাব্যে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যচেতনার প্রথম বড়ো পরিবর্তন দেখা দিল ‘মানসী’ কাব্যে এসে। কবি ঘোষণা করলেন-“কবির সাথে শিল্পী এসে যোগ দিল”। প্রেম, পুরাণ প্রভৃতি মিলিয়ে কবি তাঁর কবিচেতনাকে নব মাত্রায় নিয়ে গেলেন। এখানেই এসে কবি ছন্দকে ভাঙলেন। প্রেম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দর্শন আমরা এখানেই পেয়ে যাই-“ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী/চেয়ো না তাহারে।”

রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্যায়ের অন্যতম কাব্য ‘সোনার তরী’। প্রেম, প্রকৃতি, রূপকথা, মর্ত্যচেতনা সব মিলিয়ে কবি এ-কাব্যে এক দর্শনে পৌঁছে গেলেন। ‘সোনার তরী’, ‘মানসসুন্দরী’ ও ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় এক নারীকে রেখে তিনি রোমান্টিক সৌন্দর্যের এক মূর্তি স্থাপন করেছেন, যা কবিকে সৌন্দর্যচেতনায় নিয়ে যায়। তবে সেই কাব্যলক্ষ্মীর সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব নয়। কবিও পাননি। সে না পাওয়াতেই তিনি রহস্য সন্ধানে এগিয়ে যান-

“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী বলো কোন্ পাড়ে ভিড়িবে, তোমার সোনার তরী।” রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেল ‘চিত্রা’ কাব্যে। এ দেবতা কোনো মূর্তি নয়। যে শক্তি কবির অন্তরে বসে কবিকে চালনা করে, তাঁকেই কবি জীবনদেবতা বলেছেন। তিনি নিজেই এ কাব্যে এসে ঘোষণা করলেন-“আমার স্থান সৌন্দর্যের সাধকরূপে একা তোমার কাছে।” এই কাব্যে এসে কবি বাইরের সঙ্গে অন্তরের, সীমার সঙ্গে অসীমের সন্ধানে অগ্রসর হলেন। ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম, আশা-আকাঙ্ক্ষা সব নিয়ে কবি এখানে। উপস্থিত হলেন, তবে তা শিল্পে উত্তীর্ণ করলেন-

“জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে তুমি বিচিত্ররূপিনী।” উনিশ শতকেই রবীন্দ্রনাথ নিজের পৃথক অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যা বিংশ শতকে এসে অচিরেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভ করেছিল।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading