‘রখের রশি’ নাটকে সময়ে এই কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের দেখা গেছে এই ভয়ের হাতিয়ার ব্যবহার করতে। আলোচ্য নাটকে রথের রশিকে পুজো-অর্চনায় সন্তুষ্ট করার জন্য নারীদের বিভিন্ন লোকাচার ও শুভা-শুভ বোধের প্রকাশে এই ভয়ের একটা পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে। শাসক পরিকল্পিত ভাবে নারীদের এই লোকাচারকে অস্থিরতার সৃষ্টির এক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছে। সমাজের সমস্ত স্তরে এই ভয়ের একটা বাতাবরণ ব্যাপনের সূত্রে ছড়িয়ে দেবার কায়েমী স্বর্যের প্রবণতা তার কারণে তৈরি হওয়া ক্রম অস্থিরতার ঘোলা জলে ফল লাভের কোনো প্রত্যাশা নাটকে এক ভিন্ন প্রতীকের জন্ম দিয়েছে।
কিন্তু দীর্ঘদিনের বঞ্চনায় তৈরি হওয়া উপরের তলার চাপে নীচের তলার পুঞ্জীভূত অস্থিরতা প্রবল বিক্ষোভে যখন ফেটে পড়ে ইতিহাস তৈরি করে তখনই তৈরি হয় যুগান্তর। সেখানে শাসকের কোনো প্রচেষ্টা, কোনো ভয়ের রাজনীতিই আর কাজ করেনা, যা অবশভাবী সত্য তা প্রবল ভাবে তার অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। ‘রথের রশির প্রতি পরতে পরতে এই সত্য নানা প্রতীকে ফুটে উঠেছে। তাই রাজা, সৈনিক, পুরোহিত, প্রত্যেকেই যখন পরাভব স্বীকারে ধ্বস্ত, ক্লান্ত, রিক্ত ঐ ‘যাদের নাম করতে নেই’ তারা খবর পেল বাবার রখ টানতে হবে তাদের। এই যাদের নাম করতে নেই’ বক্তব্যের মধ্যে যে অস্পৃশ্যতার কথা বা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার সভ্য আছে প্রতিও রবীন্দ্রনাথ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। কারণ যাকে ।
মানব সভ্যতা বলি তার বিশাল কর্ম যজ্ঞোর এই বিরাট সংখ্যার যোগের কথা যদি অস্বীকার করি তাহলে মানব সভ্যতার রথ অচল হতে বাধ্য এবং তাতে যে, গোটা বিশ্ব মানব সভজ্ঞতাতেই এখানে নাট্যকার দ্বিধাহীনভাবে পেশ করেছেন। সুস্থির বিশ্বের মানবসভ্যতা ক্রম অস্থিরতার সংক্রম ঘটবে সেই তথ্য রখ তখনই সচল হবে যখন কারোর চাপে কেউ বা কোনো স্থানের চাপে কোনো স্থান অস্থির প্রত্যয় নিয়ে বাঁচবে না। আনন্দের সঙ্গে সবাই কর্মক্ষেত্রে কর্মযজ্ঞের অংশীদার হয়ে সবাই মিলে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কেউ অনুযোগ করে বলবে না সভ্যতায় তার অবস্থানের কথা, নিজের প্রবল উপস্থিতির কথা,…
“আমরাই তো যোগাই অন্ন, তাই তোমরা বাঁচ
আমরাই বুনি বস্ত্র, তাই তোমাদের লজ্জা রক্ষা।”
আমরাও মানুষ, আমরাও সভ্যতা রূপী রথের চালিকা শক্তি, এই তথ্য যখন এক মানব শ্রেণীর আর এক মানব শ্রেণীকে করিয়ে দেবার প্রয়োজন তখনই তৈরি প্রবল অস্থিরতা। শ্রেণী সংগ্রামের তড়ে তা তখন কখনো হয়ে ওঠে মার্কসের তত্ত্ব, কখনো হয়ে ওঠে সমাজ বদলের বিপ্লব-যুগান্তরের ইঙ্গিত।
‘রখের রশি’ আলোচনার সঙ্গে অবশ্যই মনে করতে হবে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘রাশিয়ার চিঠির কথা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের শেষ বছরে রাশিয়ায় গিয়ে তিনি দেখেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। ছাতার নীচে দিনবদলের দেখার চালচিত্র। যা তারকাছে মনে হয়েছিল তীর্থ দর্শনের সামিল। দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে গোটা রাশিয়ার নতুন রূপে বিশ্ব রাজনীতিতে উত্থান নাট্যকারের মধ্যে প্রবল আলোড়ল তুলেছিল। সবার সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা তাড়িত জীবনকে সমান ভাবে নিজেদের মধ্যে দিয়েছিল। গোটা বিশ্ব যখন এক নেওয়ার অদ্ভুত এক বিপ্লবী দর্শন নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে প্রবলভাবে নাড়া । অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলছে তখন এই বিশ্বেরই একটা বৃহৎ দেশ নিজের মতো করে রাষ্ট্রীক অস্থিরতাকে প্রশমন করছে এক নবীন বিপ্লবী দর্শনের আলোকে। এক নতুন পথের খোঁজে তাদের মধ্যে নিরন্তর তৈরি হওয়া অস্থিরতাকে সবাই মিলে প্রতিরোধ করছে, নতুন ভাবে সমাজ গড়ার দেখছে। সবাই সবার সুখ-দুঃখের অংশীদারীত্বে এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের বিস্ফোরণে কবিচিত্ত বিস্ফারিত হলো নতুন আবেগে।
কবি বিশ্বাস করতেন যাকে আমি বা আমরা ঘৃণা ভরে পিছনে রাখছি তাদের সঙ্গে আমরাও যে মানুষ হিসাবে পিছনে চলে যাচ্ছি ঢুকে পড়ছি এক অকারণ অস্থিরতার মধ্যে এই অসাম্য ব্যবস্থার প্রতিরোধ করতে হবে, প্রতিবিধান খুঁজতে হবে। নিজেই শুধু ভাষাজ্ঞানের অধিকারী হলে চলবে না, আমাদের আশেপাশে যেসব মুঢ় মুক মুখ, যারা আমাদেরই একক তাদের মুখেও দিতে হবে ভাষা। তাদেরকেও বের আনতে হবে পিলসুজের তলা থেকে প্রদীপের আলোর সামনে। ভবেই তৈরি হবে প্রকৃত সুস্থির সমাজ। বিশ্বের এক বৃহৎ অংশকে যদি আমরা ঘৃণা ভরে সরিয়ে রাখি তাহলে যে ক্রম অস্থির হয়ে ওঠা বিশ্বের জন্ম আমরা দেবো তা গোটা মানব জাতিকেই এক প্রবল অস্থিরতার মধ্যে ঠেলে দেবে। এই মুঢ় মুক মানুষগুলো যারা শোষিত হয়েছে বঞ্চিত হয়েছে ক্রম অস্থির হয়েছে তাদেরকে নিয়ে, তাদের অস্থিরতার বিক্ষোভকে পাথেয় করে রাশিয়ার জেগে ওঠা কবিকে চককিত করেছিল। ‘রথের রশি’ নাটকে ঐ খাদের নাম করতে নেই’ তাদের জেগে ওঠা, তারাই যে আগামী দিনে মহাকালের রখের মূল চালিকাশক্তি হতে চলেছে, এই সাধারণ মানুষের জেগে ওঠাকেই, তাদের দীর্ঘ দিনের অক্লান্ত কর্মযজ্ঞ যা গোটা পৃথিবীর প্রকৃত চালিকা শক্তি তাকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
মহাকালের রখ গেছে থেমে। সমাজের যারা দন্ডমুন্ডের কর্তা, যারা দীর্ঘকাল নিজেদের বেবেছে বিকল্পহীন মহাকালের রখের চালক তারা প্রত্যেকে বিফল হয়েছে রখ টানতে। সবাই যখন প্রান্ত, ক্লান্ত, বড় কিছুর অঘটনের আতঙ্কে বিপর্যন্ত একটা হৈ হৈ রব শোনা গেল। পিল পিল করে ঘেমো ঘেমো লোক এসে জড়ো হলো মহাকালের রখের কাছে। যাদের কোনো নির্দিষ্ট পরিচয় নেই, নেই কুল-গোত্র, শুধুমাত্র অস্পৃশ্য সংখ্যাতেই যাদের শুধু গোনা হয়। সমাজের সভ্যতার প্রকৃত চালক অথচ কোনো কৌলিও নেই, সেই লোকগুলো স্পর্ধাভরে বললো মহাকালের রথ চালাবে। যাদের সঙ্গে নিজেদের আলাদা করতে গিয়ে নাক উঁচুরা বলেছে
“ক্ষত্রিয় আমরা, শূদ্র নই, নই গোরু চিরদিন আমরা চড়েই এসেছি
চিরদিন রখ টানে ঐ ওরা যাদের নাম করতে নেই।’
শাস্ত্রের জোরে যাদের আলাদা করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘকাল তারাই বললো চালাবে। চিরকাল সংখ্যা লঘিষ্টের হাতে নিয়ত অস্থির হয়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠের এভাবে সামনের সারিতে উঠে আসাকেই রবীন্দ্রনাথ যুগান্তরের সময় বলে চিহ্ণিত করেছেন। নাটকে দলপতির বক্তব্যে কেন যুগান্তর সৃষ্টি হতে হবে তারও ব্যাখ্যা শোনা গেছে। তাদের হাতে বাবার মহাকালের রখ চলবে, এ খবরই বা তাদের কে দিল তার উত্তর জানতে চাইলে সে যা বলেছে মধ্যে শোনা গেছে প্রতীকময় ইঙ্গিত ।
‘আমরা এলেম বাবার রথ চালাতে।
এতদিন আমরা পড়তেম রথের চাকার তলায়,
দলে গিয়ে ধুলোয় যেতুম চ্যাণ্ডা হয়ে।…
এ তিনি ডাক দিয়েছেন তার রশি ধরতে।
অবদ পুরোহিত জিজ্ঞাসা করে,
এখবর তাদের কে দিল?’ তার উত্তরে দলনায় “কেমন করে জানা গেল সে তো কেউ জানে।