উপন্যাস সমাজ জীবনের দর্পন। সামাজিক মানুষ উপন্যাসের পাতায় যখন উঠে আসে তখন তার সামগ্রিকতা নিয়েই আসে। ব্যাক্তিমানুষের সামাজিকতা, পারিবারিকতা ও মানস অনুভব সৎ উপন্যাসের পাতায় যেমন করে প্রত্যক্ষ করা যায়, সুবৃহৎ সমাজের বহুকাল ব্যাপী প্রেক্ষাপটে তাকে প্রত্যক্ষ করা সাধারনের পক্ষে অসম্ভব। এমন কি অসাধারণ ব্যক্তির পক্ষেও সর্বাবস্থায় তার সুযোগ ঘটেনা।
শিল্পীমন বহুযুগের বহুমানুষের মন-মানস মিলিয়ে গঠিত হয় বলে তার অনুভূতির জগতে সমাজ সত্য ও ব্যক্তি সত্য যেমন করে ধরা দেয়, কোন ঐতিহাসিক বা সমাজতত্ত্ববিদের পক্ষে তা দুঃসাধ্য। রবীন্দ্রনাথ সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ শিল্পী প্রতিভার অন্যতম বলে তাঁর শিল্পকর্মে সমাজসত্য যে ভাবে প্রস্ফুট তাতে যাতায়াতের কোন অকুলান হয়েছে বলে মনে হয় না। যোগাযোগ উপন্যাসটিতে উপন্যাসিক এ-দেশের সমস্ত সমাজ ও ধনবাদী সমাজের প্রক্রিয়াটি তুলে ধরেছেন।
মনস্তত্ব বা মানসিক গড়নের ব্যাপারটি কোন শ্রেণী ও সমাজ নিরপেক্ষ বিষয় নয়। ব্যক্তির সামজিক ও শ্রেণীগত অবস্থানই তার মানস গঠন করে। অন্যদিকে শ্রেণী গড়ে উঠে সামজিক সম্পর্কের আর্থিক বিধি ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে। ভারতীয় সমাজে সামন্ত ভূ- স্বামীদের অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। বিভিন্ন বৃত্তিজীবী মানুষ এ সকল ভূ-স্বামীদের ছত্রছায়ায় পারস্পরিক সহায়তায় শতশত বৎসর যাবৎ নিশ্চিত জীবন-যাপন করেছে। অন্যদিকে সামন্ত ভূ-স্বামীগণ ও বৃত্তিজীবী জনসাধারনের নিঃস্তরঙ্গ জীবন-প্রয়াসের উপরিজলে বসে এক সুদৃঢ় সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে।
সাহিত্য, দর্শনে, ললিতকলায় তথা জীবনাচরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা অতুলনীয় সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এক কথায় মানস চর্চায় ভারতীয় সামন্ত সমাজ বিপুলায়তন ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেছিল।
এ-দেশে ইংরেজের উপনিবেশ স্থাপনা কেবল মাত্র ভারতীয় ধনৈশ্বর্যই শোষন করেনি বরং এ-দেশের সমাজ জীবনেও ভারতীয় এক বিশেষ উপপ্লবের সৃষ্টি করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা এ দেশের সামন্ত সমাজকে বিচলিত করে কুটির শিল্পের বুনিয়াদকে ধ্বংস করে। এ দেশের স্বয়ম্ভবতাকে বিপর্যস্ত করেছে। কিন্ত তাতে করে তারা এ-দেশে যন্ত্র বিপ্লব ঘটিত হয় নতুন ইন্ডাস্ট্রি মালিক সমাজ গড়েনি, গড়েছে বাজার নির্ভর মুৎসুদ্দি শ্রেণী। যারা পণ্য-উৎপাদন করে না, পণ্য কেনা বেচা করে। শিল্প গড়ে না, অর্থের পাহাড় গড়ে। এর সম্পদ চেনে না, কেবলমাত্র লাভ চেনে।
যোগাযোগ উপন্যাসে চাটার্জি আর ঘোষাল পরিবার দুটোকে উপর্যুক্ত দু’শ্রেণীর প্রতিভূ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। বিপ্রদাস ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সমাজের শেষ প্রতিনিধি আর মধুসূদন উঠতি বাজার নির্ভর ধনবাদী সমাজের প্রতিভূ। বিপ্রদাস শত শত বৎসরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উত্তরাধিকার হিসাবে লাভ করেছে। তার দেহে-মনে, আচার-আচরনে, সত্য নিষ্ঠায় সে সমৃদ্ধি ফুটে উঠে তা যেন উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ। মধুসূদন কঠোর কঠিন পরিশ্রমের পথধরে ধন আহরন করেছে। অর্থের প্রাচুর্যই তার গৌরব। হাজার বছর লালিত সুসংস্কৃত কোন ঐতিহ্য তার নেই। কাঁচা পয়সা যা একান্তই বইরের জিনিস, তার অভাব তার নেই। কিন্তু অন্তরের সংস্কৃতির দিক থেকে সে একান্তভাবেই দেউলে, দীনহীন অভাজন। তার এ-দৈন্য সে ঢেকে রাখতে চায় কঠোরতা দিয়ে। কিন্তু পদে পদে তা বেরিয়ে পড়ে নির্লজ্জভাবে।
বিপ্রদাসের অনুজা কুমুদিনী সামন্ত সমাজের সুসমৃদ্ধ মানস ঐশ্বর্যের মহিমা লালিত যেন। মদুসূদন তাকে পন্য মূল্যে কিনে নিতে চায়। ধনৈশ্বর্য দিয়ে বাঁধতে চায়। কিন্তু বারে বারে ব্যার্থ হয়। কুমুদিনীর মনের গহীনে যে সুধা আছে মধুসূদন তার নাগাল পায় না। অন্তর মিশালে অন্তরের যে পরিচয় সহজ হয়ে উঠতে পারে মধুসূদন তা জানে না। আর জানে না বলেই অপরকে সে পীড়িত করে, নিজে পীড়িত হয়। কুমুদিনীকে সে পায় না, পেতে পারে না। সামন্ত সমাজের যে সমৃদ্ধি মানসশ্রী তা ধনবাদী সমজের জন্য নয়; তাকে লাভ করবে এই ধনতান্ত্রিক সমাজের সন্তান- ঔপন্যাসিক যেন ইঙ্গিতে এ কথাটাই বলতে চান। কুমুদিনী মুধুসূদনের সংসারে প্রবেশ করেছে অবিনাশ ঘোষালের জন্মকে সম্ভব করে তোমার জন্যই।
উপন্যাসটিতে সামন্ত সমাজের অসঙ্গতি রূপেই যে ধনতান্ত্রিক সমাজ বিরাজ করছে। ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ যেন বলতে চান যে সামন্ত সমাজ থেকে ধনবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা উত্তরন নয়, এটা কেবলমাত্র সামন্ত সমাজের অসঙ্গতিতেই। কুমুদিনী আর মধুসূদনের সন্তান সম্ভাবনার মধ্য দিয়েই এ অসঙ্গতির নিরাকরন সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ তাই নিশ্চিত জানেন যে সামন্ত সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। কিন্ত ধনতান্ত্রিক সমাজ তার যোগ্য উত্তরাধিকার নয়। কে তার যোগ্য উত্তরাধিকার সেটা তিনি ইঙ্গিতে বলে দিয়েছেন মাত্র। সুতরাং তিনি কি নির্দেশ করেছেন তা সচেতন পাঠক অবশ্য উপলব্ধি করবেন। উপন্যাসিক জানেন সামন্ত সমাজ তার ঐশ্বর্য হারিয়ে নিঃশেষে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, ধনবাদী সমাজ টিকবেনা। বরং এ দুয়ের নিরাাকরনের মধ্যদিয়ে নতুন এক শ্রেণীহীন সমাজের আবির্ভাব ঘটবে। সেখানে মানব সভ্যতার বহুকাল লালিত সম্যক কৃতি গুলিই ঠাঁই পাবে।
সাহিত্য সম্পর্কে সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে এ- কর্মটি হল বাহিরের জিনিসকে আপনার করা আপনার জিনিসকে সকলের করা। অর্থাৎ বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার মাঝেই সাহিত্য-শিল্পের সার্থকতা। উপন্যাস তথা কথা- সাহিত্যে শিল্পের বাহ্য ও আবÍর প্রকৃতির মিলন ঘটে থাকে। বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি উপন্যাসের মাঝে হাত ধরাধরি করে দাঁড়ায়। অজস্র মানুষ তাদের বিপুল বৈচিত্র্য নিয়ে কথাসাহিত্যের মাঝ সমুপস্থিত। ফলে সমাজের সামগ্রিক অবস্থা নিয়েই মানুষ এসে হাজির হয় সাহিত্যের পাতায়। লেখক থেকে যান নেপথ্যে। স্বল্পশক্তি সম্পন্ন লেখক হলে সমাজের বা ব্যক্তিগত চরিত্র আঁকতে আঁকতেই দিন যায়। নিজের ভাল লাগা মন্দ লাগা ঘটনা প্রবাহের গতিপথে হারিয়ে যায়। ক্রমশ যেন লেখক তার ব্যৈক্তিক বৈশিষ্ট্য নিযুক্ত হন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত অমিত শক্তিধর লেখকের পক্ষে তা হয় নাই বা হওয়া সম্ভবও ছিল না।
যোগাযোগ উপন্যাসে লেখক এ দেশের ধনতন্ত্রের জন্মলগ্নেই তার অভ্যন্তরীন অসঙ্গতিকে উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে তিনি তাকে আর দশজনের মত স্বাগত জানাতে পারেন নি। এর কুৎসিত কুরূপ চেহারাই তার চোখে পড়েছে। সামন্ত-সামজের পতনের মাঝে ও তিনি তার ঐশ্বর্যকে উপলব্ধি করে ছিলেন। বিপ্রদাসের ধনৈশ্বর্য তলায় এসে ঠেকলেও তার একান্ত করেই যা নিচের ঐশ্বর্য অন্তদৃষ্টি সুশিক্ষিত মানস, অতুলনীয় অনুভব ক্ষমতা, সৌন্দর্যবোধ শিল্পচেতনা প্রভৃতি ধনে সে ধনী। সেখানে কোন রাজা-বাদশার অধিকার নেই। অনুজা কুমুদিনীর অন্তর্জগতে যে মহাকাশের বিস্তার তার বুদ্ধিমত্তায় যে অনায়াস পটুত্ব সেখানেও নেই কোন নীচতা বা হীনতা। এগুলো শ্রষ্ঠা রীন্দ্রনাথের আবিষ্কার কেবলমাত্র ঘটনা- প্রবাহের ফসল নয়।
মধুসূদনের চরিত্র পরিকল্পনায় রবীন্দ্রনাথ বহিঃরঙ্গকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ মধুসূদন যে সমাজের প্রতিভূ সেখানে অন্তরের ঐশ্বর্য মহীয়ান হয়ে উঠেনি। ঐতিহ্য গড়ে উঠার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন মধুসূদনের ক্ষেত্রে সেটার অবকাশ খুবই কম। ফলে তার চাল-চলন কথাবার্তা আচার ব্যবহারে অমার্জিত কর্কশতার প্রধান্য। মনে হয় কবির পরবর্তী কাজে রচিত নাটক রক্ত করবীর রাজার সঙ্গে মধুসূদনের সাদৃশ্য রয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পনাও সহজ নয়। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই তা সম্ভব।
নবীন আর মোতির মা চরিত্র দুটির স্বতন্ত্র কোন সত্তা নেই। মোতির মায়ের শেষ দিকের চেতনাবোধ বাদদিলে নবীন তো কেবলিমাত্র আইডিয়ার প্রতীক। বিশেষ করে এদের কথা বার্তায় যে চমৎকারিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে এ ধারনা আরো দৃঢ় হয়।
সমগ্র উপন্যাসটিতে সংলাপের ক্ষেত্রে যে চাতুর্য ও সুশিক্ষিত মানসের পরিচয় পাওয়া যায় তা যে চরিত্রগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয় না। এ দার্শনিক ভাব কবিত্বপূর্ণ প্রকাশভঙ্গী বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক বিরহিত। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই এ ধরনের সংলাপ রচনা সম্ভব। কখনো কখনো মনে হয় ঘটনা প্রবাহের চেয়ে সংলাপের মোহনীয়তাই যেন বেশি। পাঠক দিশে হারা হন। বিপ্রদাশ আর কুমুদিনীর কথোপকথন নিতান্ত বৈষয়িক বিষয়ের মাঝে আবদ্ধ থাকে না। ঔচিত্য অনৌচিত্য বোধের এমন এক উচ্চ গ্রামে তার প্রবেশ, যে শেষে আর তা শব্দের মাঝেও আবদ্ধ না থেকে সুদূর কল্পলোকে প্রয়ান করে। ফলে তার মাঝখান দিয়ে আমরা পরিষ্কার ভাবে যেন রবীন্দ্রনাথকেই প্রত্যক্ষ করি। কুমুদিনী আর মোতির মায়ের মাঝে যে সংলপাপ বিনিময় তাতে একটা কথা ভেবে আশ্চর্য হতে হয় কুমুদিনীর এ অভিজ্ঞতার উৎস কোথায়? কিংবা মোতির মা-ই বা এ পরিপূর্ণ শিক্ষা কোন শিক্ষালয়ে পেয়েছে? উত্তর একটিই তিনি গুরুদের রবীন্দ্রনাথ। ঐতিহ্যসূত্রে যা পাওয়া যায় তাকে স্বীকরন করে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ভিন্ন এত ঐশ্বর্যমন্ডিত হয়ে উঠতে পারে না।
বস্তত: বিষয়বস্তু, চরিত্র পরিকল্পনা, সংলাপ, ঘটনা প্রবাহ প্রভৃতি বিচারে এ-কথাই মনে হয় যে যোগাযোগ উপন্যাস অতুলনীয় মানস মানব-সম্পদের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ ভাবে উপস্থিত থেকেছেন বলে বিশ্বাস করতে বাঁধে না।