কাদম্বরীকে নিয়ে ভাবতে গিয়েই কোন কুমুদিনীর কথা স্মরণে এল। যদিও কাদম্বরী বাস্তব চরিত্র আর কুমুদিনী কেবলই রবিবাবুর একটি সৃষ্ট চরিত্র।
এবং যদিও এ দুজনের স্বভাব, চরিত্র, বিচার, বিস্তার, প্রভাব সবই একেবারে ভিন্ন ধর্মী তবুও রবি ঠাকুরের কথা চিন্তা করলেই বা কাদম্বরীর কথা এলেই আমার কুমুদিনীকে বেশ মনে পড়ে।
কুমুদিনী হলেন রবি ঠাকুরের “যোগাযোগ” উপন্যাসের নায়িকা।
সংক্ষেপে বলতে গেলে,
কুমুদিনী রাজ্য হারানো রাজার মেয়ে কিন্তু ঘটনাচক্রে বিবাহ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এক রাজাকে। তবে তার প্রণয়ে কিন্তু কুমু কোনো জাতভেদ রেখেছিলনা। সে এক সমুদ্র ভালবাসা নিয়েই বসে ছিল স্বামী বরটিকে তার অর্ঘ্য দেবে বলে। কিন্তু রাজা বেচারা ধনে মানে যশ কামালেও, মনে দৈন্যতা দূর করতে পারেনি।
কুমু’র ভালবাসতে চেয়েও ভালবাসার যোগ্য কাউকে না পাওয়ার যে গভীর মর্মবেদনা, এইটা আমাকে বেশ ছুঁয়ে গেছে।
আর তাদের দুইয়ের এই সম্পর্কের টানাপোড়ন ছুঁয়েছে দুই পরিবার ছেড়ে সমাজ, সংসার, সংস্কৃতি আর আশেপাশের সবকিছুকে।
ছোটবেলা থেকেই মারমার কাটকাট একশন, এডভেঞ্চার বা থ্রিলার পড়ার অভ্যাসের কারণে বাংলা সাহিত্যে আমার দখল একেবারেই নস্যির ডিব্বার সমতুল্য। তার মাঝেও যে কিঞ্চিৎ চর্চা হয়েছে সেটাও দৈবচক্রে। ওভাবেই হাতে পেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের “যোগাযোগ” বইটা।
এবং এত বছর পরও মনে আছে, আমার “নেই কাজতো রবি ঠাকুর পড়” উদ্দ্যেশ্যে শুরু করা বইটার আকর্ষণের মূলে ছিল, বিপ্রদাস (নামটা এইটা বা এরকম কিছু) কৈশোরে তাকে বেশ মনে ধরেছিল। সবই বোধহয় বুদ্ধদেবের রাজর্ষির মায়া!
তো যাহোক, পড়তে পড়তে পরবর্তীতে কুমুদিনীই হয়ে যায় ধ্যান জ্ঞান।
কুমুদিনী যাকে বলে আভিজাত্যের আরেক নাম।
চিন্তায়, জ্ঞানে, নীতিতে, মনের ঐশ্বর্য্যে সে শাশ্বত। আবার তাকে অতিমানবী বা অধরা করার প্রচেষ্টা রবি ঠাকুর করেননি। তার মাঝেও আছে আক্ষেপ, সীমাবদ্ধতা, অপারগতার দায়। কিন্তু ব্যক্তিত্বের প্রখরতা আর নীতির তীব্রতার পেষণে নিষ্কম্প থেকে যে নিদারুণ অবরুদ্ধ যাতনায় বিদীর্ণ হয়েছে প্রতি ক্ষণ, সে ব্যথায় আমি মর্মাহত হয়েছি বারবার।
আবার তায় জন্য আমার যে কুমু’র স্বামী মধুসূদনের প্রতি কোনো ক্ষোভ জন্মেছে তাও না। অনেকটা যেনো তার প্রতি আশাই বা কিসের। কুমুকে ছুঁয়ে দেবার সে সাধ্যই যে মধুসূদনের নেই। আত্ম অহমিকায় ডুবে থাকা, মানসিক দাসত্বের শেকল ভাঙতে না পারার ব্যর্থতা।
এসবই মধুসূদনকে এমন একটা সীমাবদ্ধতায় অনন্তকালের জন্য আটকে ফেলেছে যে, কুমু’র ভালবাসাকে আহ্লাদে কাছে না টেনে, সে অর্ঘ্যকে প্রাপ্য অধিকার ঠাউরে যে অবহেলা, অসম্মানের আঁচড় মধুসূদন কুমু’র স্নিগ্ধ আত্মাভিমানে এনেছে, তার দায় পুরোটাই মধুসূদনের হলেও, সে ব্যর্থতার দায় কেবলই হয়তো ওর না।
সমাজ, লোক চর্চা, চর্চিত চর্বিত ঠুনকো অহম, আর ইতিহাসের নামে বয়ে চলা জাতিভেদকেও কিছুটা দায় নিতেই হবে।
কুমুদিনী আমার কিশোরী মনে এতটাই গভীর আঁচড় কেটেছিলো যে প্রায় এক যুগেরও বেশী সময় পরে এসেও, আজো কুমু’র কথা মনে হলেই কলিজাটা মোচড় দেয়।
কুমু’র অপ্রাপ্তির এই মর্মবেদনা শীতের ঝড়ো হাওয়ার সদৃশ্য সুঁইয়ের মতন বিঁধে।
চন্দ্রানী ব্যানার্জির গানটা মনে পড়ে-
তোমাকে বুঝিনা প্রিয়,
বোঝনা না তুমি আমায়,
দুরত্ব বাড়ে যোগাযোগ নিভে যায়।
Q৩। ‘বলাকা’ কাব্যের অন্তর্গত ‘শঙ্খ’ কবিতার মর্মার্থ লিখুন।
ANS- কবি মনে করেছেন, বলাকার শঙ্খ সৃষ্টিকর্তার আহ্বান বলয়। এই শঙ্খে অকল্যাণ-পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানসিক সংগ্রামের শক্তিও নিহিত রয়েছে। শক্তি ও প্রেরণার এই বলয়কে হেলায় মাটিতে ফেলে রাখতে নেই। দুঃখকে স্বীকার ও বহন করার জন্যও এই শক্তি কাজে লাগে বলে রবীন্দ্রনাথের ধারণা। “শা-জাহান” (কবিতাটিকে প্রথমে “তাজমহল” নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল) কবিতা সম্বন্ধে কবি অধ্যাপক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন: “পৃথিবীতে এমন বিরাট কিছুই নেই যার মধ্যে চিরকালের মতো তাঁকে ধরে রাখলে তাঁকে খর্ব করা হয় না। আত্মাকে মৃত্যু নিয়ে চলে কেবলই সীমা ভেঙে ভেঙে। তাজমহলের সঙ্গে শাজাহানের যে-সম্বন্ধ সে কখনোই চিরকালের নয় – তাঁর সঙ্গে তাঁর সাম্রাজ্যের সম্বন্ধও সেইরকম। সে-সম্বন্ধ জীর্ণ পত্রের মতো খসে পড়েছে, তাতে চিরসত্যরূপী শাজাহানের লেশমাত্র ক্ষতি হয়নি।
সেই শাজাহানও নেই সেই মমতাজও নেই, কেবল তাদের যাত্রাপথের এক অংশের ধূলির উপরে জীবনের ক্রন্দনধ্বনি বহন করে রয়ে গেছে তাজমহল। … সে-প্রেম দুঃখবন্ধুর পথে অন্তহীন সম্মুখের দিকে চলে গিয়েছে, সম্ভোগের মধ্যে তার সমাপ্তি নয়। ”
ইহুদি পুরাণে আছে – মানুষ একদিন অমৃতলোকে বাস করত। সে-লোক স্বর্গলোক। সেখানে দুঃখ নেই, মৃত্যু নেই। আর উপনিষদ বলছে: “সত্যং জ্ঞানং অনন্তম্”; প্রথমে সত্যের মধ্যে জড় জীব সকলেরই সঙ্গে এক হয়ে মানুষ বাস করে – জ্ঞান এসে বিরোধ ঘটিয়ে মানুষকে সেখান থেকে টেনে স্বতন্ত্র করে – অবশেষে সত্যের পরিপূর্ণ অনন্ত রূপের ক্ষেত্রে আবার তাকে সকলের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। এ কথা ঠিক যে, যারা মনে করে তুফানকে এড়িয়ে পালানোই মুক্তি, তারা কিনারে বা তীরে যেতে পারে না। তাই মানুষের প্রার্থনা ও সাধনা হওয়া উচিত পথ না এড়িয়ে অসত্য-অন্ধকার পথ পেরিয়ে আলোর জগতে প্রবেশ করা। বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর সাহিত্যসাধনার পরিণতপর্বে এই সাধনাকেই আশ্রয় করেছেন মনে-প্রাণে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বলাকা পর্বের কবিতা রচনা করেন কবি। বিশেষ করে সবুজপত্র মাসিক পত্রিকার তাগিদে তাঁকে তখন এই কবিতাগুলো লিখতে হয়েছিল। সে-সময়ে সারাপৃথিবীজুড়ে চলছে ভাঙাচোরার খেলা, বইছে পরিবর্তনের প্রবল হাওয়া। রুশ বিপ¬বও আসন্ন। জড়তা থেকে তারুণ্যের জয়ের পথে পৃথিবীর সকল গতিপথ ধাবমান। এই ভাঙাচোরার মধ্যে কবির মানসিক অস্থিরতার অনর্গল (ধারাবাহিক) বহির্প্রকাশ বলাকার কবিতা। সবকটি কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ একটা যোগসূত্র রয়েছে বলেও কবির ধারণা। তাঁর কেবলই মনে হয়েছে, হংসশ্রেণীর মতনই মানুষ যেন মানসলোক থেকে যাত্রা শুরু করে অপ্রকাশ কোনো বেদনা ও ব্যাকুলতা নিয়ে কোথায় কোন সুদূরে উড়ে চলে যাচ্ছে। যুদ্ধ চলাকালে কবি ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছিলেন। যুদ্ধের অনুভূতি নয়; তাঁর ভেতরে কাজ করছিল অতীত রাত্রিসম অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথে নতুনযুগে পদার্পণের আনন্দ। আর তাই হয়তো তিনি কষ্টের অবসান ও আনন্দের সূর্যোদয়ের সম্ভাবনার কথাই আঁকতে চেয়েছেন বলাকার ধেয়ে চলার আনন্দের মধ্য দিয়ে।
“বলাকা” কবিতায় আত্ম-উদ্বোধনের আহ্বান আছে। কবি মনে করেন মানসিক উৎফুল¬তা, চঞ্চলতা আর সামনে এগিয়ে চলার প্রবণতা মানুষকে সত্যিকারের বাঁচবার পথ দেখাতে পারে। কবি জানেন, জীবনের গতির অন্বেষার মধ্য দিয়ে নতুন সভ্যতা নির্মাণের আভাস প্রতিফলিত হয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক অভিপ্রায়কে বুকে ধারণ করে কবিতায় তার প্রাণসঞ্চার করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ১৩৩০ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে “বলাকা” সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, প্রদ্যোতকুমার সেনগুপ্তের অনুলেখন থেকে, তার সারকথা এরকম:
“বলাকা বইটার নামকরণের মধ্যে এই কবিতার (৩৬ সংখ্যক কবিতা: বলাকা) মর্মগত ভাবটা নিহীত আছে। সেদিন যে একদল বুনো হাঁসের পাখা সঞ্চালিত হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারের স্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়েছিল, কেবল এই ব্যাপারই আমার কাছে একমাত্র উপলব্ধির বিষয় ছিল না, কিন্তু বলাকার পাখা যে নিখিলের বাণীকে জাগিয়ে দিয়েছিল সেইটাই এর আসল বলবার কথা এবং বলাকা বইটার কবিতাগুলির মধ্যে এই বাণীটিই নানা আকারে ব্যক্ত হয়েছে। বলাকা নামের মধ্যে এই ভাবটা আছে যে, বুনো হাঁসের দল নীড় বেঁধেছে, ডিম পেড়েছে, তাদের ছানা হয়েছে, সংসার পাতা হয়েছে – এমন সময় তারা কিসের আবেগে অভিভূত হয়ে পরিচিত বাসা ছেড়ে পথহীন সমুদ্রের উপর দিয়ে কোন সিন্ধুতীরে আর-এর বাসার দিকে উড়ে চলেছে।
সেদিন সন্ধ্যার আকাশপথে যাত্রী হংসবলাকা আমার মনে এই ভাব জাগিয়ে দিল – এই নদী, বন, পৃথিবী, বসুন্ধরার মানুষ সকলে এক জায়গায় চলেছে; তাদের কোথা থেকে শুরু কোথায় শেষ তা জানি নে। আকাশের তারার প্রবাহের মতো, সৌর-জগতের গ্রহ-উপগ্রহের ছুটে চলার মতো এই বিশ্ব কোন নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে প্রতি মুহূর্তে কত মাইল বেগে ছুটে চলেছে। কেন তাদের এই ছোটাছুটি তা জানি নে, কিন্তু ধাবমান নক্ষত্রের মতো তাদের একমাত্র এই বাণী – এখানে নয়, এখানে নয়। ”
দিনের শুরুতে সূর্য উদয়ের ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যচর্চার প্রথমপাদে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলেন। “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতায় তাঁর সে ভাবনার কথা লেখা আছে। আর শিল্পচর্চার পরিণত পর্যায়ে পদার্পণ করে কবি পাখির চঞ্চলতার ভেতরে আবিষ্কার করেছেন মানবজীবনের না-বলা কিছু কথার বিস্ময়কর অনুভব। অজানার যতোসব রাজ্যে ভরা এই পৃথিবীর সন্তান রবীন্দ্রনাথ তাঁর অবাকভরা মনের আকুতি প্রকাশ করেছেন এভাবে:
সহসা শুনিনু সেই ক্ষণে
সন্ধ্যার গগনে
শব্দের বিদ্যুৎছটা শূন্যের প্রান্তরে
মুহূর্তে ছুটিয়া গেল দূর হতে দূরে দূরান্তরে।
হে হংসবলাকা,
ঝঞ্ঝা-মদরসে মত্ত তোমাদের পাখা
রাশি রাশি আনন্দের অট্টহাসে
বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে। (বলাকা)
পাখির এই চলাচলের নিয়মাদি যেন জীবনের সকল স্তব্ধতার গায়ে প্রবল এক আঘাত হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে। অন্তত কবি সে রকমই ভাবছেন। তিনি মনে করছেন যারা ঘুমিয়ে আছে শান্তিতে; কেবল পৃথিবীর সুবিধাসকল ভোগ করবার জন্য সময় পার করছে, তাদের জন্য এ এক মহাবাণী। ভোগ আর উপভোগের সীমানার বাইরে যে সুন্দর জীবন, দুনিয়ার যে অসীম রহস্য ও স্বপ্নঘেরা মমতা, তার সৌন্দর্য দেখে নেওয়ার আহ্বান আছে জেগে ওঠার এই প্রত্যয়ের |