ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় মৃত্যুদন্ড শাস্তি হিসাবে কমবেশী সব সমাজে প্রচলিত ছিল। অপরাধের শাস্তি হিসেবে এবং রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদন্ড শাস্তি হিসেবে দেয়া হয় মূলত হত্যা, গুপ্তচরবৃত্তি, বিশ্বাসঘাতকতা, ধর্ষণ, সামরিক আইন, সমকামিতা, ব্যাভিচার, অজাচার, মাদক পাচার, বড় ধরনের দূর্নীতি, স্বধর্ম বা স্বপক্ষ ত্যাগ করা (Apostasy) ইত্যাদি অপরাধে। নিম্নোক্ত অপরাধসমূহের শাস্তি হিসেবে বাংলাদেশ দন্ডবিধিতে মৃত্যুদন্ড প্রচলিত আছে-
১. রাষ্ট্রদ্রোহিতা
২. মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা সাক্ষ্যদান
৩. নরহত্যা
৪. নাবালক বা উম্মাদ ব্যাক্তির আত্মহত্যায় সহায়তা
৫. যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যাক্তির হত্যার প্রয়াস
৬. নরহত্যার সাথে ডাকাতি
তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনসহ আরো কিছু আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে।
শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের ব্যবহার অতি প্রাচীন হলেও এটি নিয়ে প্রায়শই বির্তক দেখা যায়। মানুষ জীবন লাভ করে প্রাকৃতিকভাবে। সেই প্রকৃতি প্রদত্ত জীবন মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে আইনী প্রক্রিয়ায় ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। মৃত্যুদন্ড প্রাচীনকাল থেকে নানাভাবে কার্যকর ছিল। প্রাচীনকালে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি হিসেবে অপরাধীকে আগুনে বা পানিতে নিক্ষেপ করা হতো কিংবা গহীন বনে রেখে আসা হতো। যদি আগুনে পুড়ে বা পানিতে ডুবে মারা না যেতো কিংবা বনের হিংস্র পশু খেয়ে না ফেলতো তবে ধরে নেয়া হতো দন্ডিত ব্যাক্তি মৃত্যুদন্ডের মতো অপরাধ করেনি। প্রাচীনকালে মৃত্যুদন্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোন বিধিবদ্ধ আইন ছিল না। শাসকশ্রেণীর বিরাগভাজন হলে অনেক ছোট অপরাধেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। গ্রীক ইতিহাসে সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ভারতীয় ও বৈদিক সভ্যতাতেও মৃত্যুদন্ড অতি প্রয়োজনীয় শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হতো।যুগ যুগ ধরে চলমান বির্তকে বর্তমানে পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশে মৃত্যুদন্ড রহিত করা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে মৃত্যুদন্ড প্রচলিত থাকলেও ক্রমেই এর বিরুদ্ধে জনমত জোরদার হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমাবিশ্বে অত্যধিক অপরাধ প্রবণতার কারনে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড পুনরায় প্রচলেনর বিষয়ে জনমত তৈরী হচ্ছে। নিউইয়র্কের মতো অপরাধপ্রবণ শহরে প্রমাণিত হয়েছে যে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড না থাকার কারনে সেখানে অপরাধীরা খুন, রাহাজানি, বলৎকারসহ যে কোন প্রকারের নিষ্ঠুরতা করে থাকে। ফলে একবার রহিত করার পর ১৯৯৫ সালে সেখানে পুনরায় মৃত্যুদন্ড আইন কার্যকর করা হয়েছে।
মৃত্যুদন্ডের পক্ষে বিপক্ষে যতই জোরালে যুক্তি পেশ করা হোক না কেন এর ফলাফল ও কার্যকারিতা নিয়ে বির্তকের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। আইন মানুষই প্রয়োগ করে ঈশ্বর বা ফেরেশতার হাত এখানে সরাসরি প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কাজেই আইনের প্রয়োগে কিছুটা ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড থাকলে বিশেষ করে এর অপপ্রয়োগ হলে এর বিপক্ষে যুক্তি ও জনমত জোরালো হয়। আবার এ অজুহাতে মৃত্যুদন্ড রহিত করা হলে এর ফলাফলও ভয়াবহ হতে পারে। যেমন পাশ্চাত্যের কিছু দেশে ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার কিংবা শিশু হত্যাকারীকেও বিচারক মৃত্যুদন্ড শাস্তি দিতে পারছেন না কারন সেখানে আইন করে মৃত্যুদন্ড রহিত করা হয়েছে।
শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের পক্ষে ও বিপক্ষে বেশকিছু জোরালো যুক্তি রয়েছে।
মৃত্যুদন্ডের পক্ষে যুক্তি :
১. প্রত্যেকের বাঁচার অধিকার আছে। নর হত্যাকারীরা এক বা একাদিক নির্দোষ প্রাণের বেচেঁ থাকার এ অধিকার হরণ করে। ফলে সে নিজে বেচেঁ থাকার অধিকার হারায়। মৃত্যু শুধু তার শাস্তিই নয় যথার্থ প্রাপ্যও বটে।
২. কেউ কাউকে হত্যার কথা ভাবলেও মৃত্যুদন্ডের কথা চিন্তা করে সে যেন হত্যাকারী হয়ে না যায়। নিজের জীবন রক্ষার্থে প্রতিটি মানুষ হবে অন্যের জীবনের জিম্মাদার।
৩. মৃত্যুদন্ডের ফলে শুধু হত্যাই নয় অন্য যে অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে এসমস্ত অপরাধ করার পরিকল্পনাও সহজে করবে না অপরাধীরা।
৪. মৃত্যুদন্ড মানুষকে সব সময় একটা ভীতির মধ্যে রাখতে সমর্থ হয়। এমনকি অপরাধ করার সময়ও অপরাধী ভুলে যায় না যে, অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার মৃত্যুদন্ড হতে পারে।
৫. মৃত্যুদন্ডের ভয় শৈশব থেকে চরম অপরাধ প্রবণতা রোধ করতে সহায়ক।
৬. মৃত্যুদন্ড কার্যকরের খবর যেহেতু বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচারিত এবং আলোচিত হয় তাই অন্যান্য অপরাধীদের উপরও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
৭. মৃত্যুদন্ডের খবর অনেক সময় অপরাধেদের এক ধরনের মানসিক শাস্তি দিতে সমর্থ হয়। অপরাধী নতুন করে নিজের ও অন্যের জীবনের মূল্য বুঝতে শিখে।
৮. কিছু অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড রাখার ফলে ঐ সব অপরাধের প্রতি সমাজের সকলের তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হয়।
মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে যুক্তি :
১. শাস্তিদানের উদ্দেশ্য যদি সংশোধন হয়ে থাকে মৃত্যুদন্ডের ক্ষেত্রে এ উদ্দেশ্য ব্যর্থ। মৃত্যুদন্ডে অপরাধীর জীবন নাশই হয়। তার নিজের কোন সংশোধন এতে সম্ভব নয়।
২. মৃত্যুদন্ড একবার কার্যকর হয়ে গেলে বিচারের ভুল আর সংশোধন করা সম্ভব নয়। অথচ অপরাধীকে অন্য কোন সাজা প্রদান করা হলে বিচারকার্যের যে কোন ভুল সংশোধন করা সম্ভব।
৩. মৃত্যুদন্ড নিষ্ঠুরতা। এর পরিবর্তে অন্য কোন সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হলে অপরাধীর শাস্তিও হয় এবং তার দ্বারা কাজও করিয়ে নেয়া যায়।
৪. শাস্তির ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ব্যবহৃত হলে নিরপরাধ মানুষ বলির কারণ হতে পারে।
৫. মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হলে অপরাধীর পরিবার পরিজনের উপর এর বিরুপ প্রভাব পড়তে বাধ্য।
বর্তমান বিশ্বে ইউরোপের দেশ সমূহে, প্যাসিফিক রাষ্ট্রসমূহ (অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সহ) এবং কানাডায় মৃত্যুদন্ড আইন রহিত করা হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ দেশেই যে কোন অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড রহিত করা হয়েছে, শুধুমাত্র ব্রাজিলে অস্বাভাবিক অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড শাস্তি বহাল আছে। যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড বহাল আছে। আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় মৃত্যূদন্ড শাস্তি রহিত করা হয়েছে। তবে সেখানে হত্যা, ধর্ষন ইত্যাদির মতো বড় ধরনের অপরাধগুলো ইদানিং আশন্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সেখানে মৃত্যুদন্ড শাস্তি পুনরায় বহালের প্রতি জোর দাবীর সৃষ্টি হচ্ছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের প্রয়োগের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরী হতে থাকে। ১৯৭৭ সালে ১৬টি দেশ মৃত্যুদন্ড শাস্তি রহিত করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১ আগস্ট ২০০৮ পর্যন্ত ৯২ দেশ সকল ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড শাস্তি রহিত করে। কিছু কিছু দেশ রয়েছে যারা দীর্ঘদিন যাবৎ মৃত্যুদন্ডকে শাস্তি হিসেবে ব্যবহার করে না। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের প্রয়োগ স্থগিত করে কিন্তু ১৯৭৭ সালে পুনরায় চালু করে। ভারতে ১৯৯৫ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কোন মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়নি। অন্যদিকে ফিলিপাইন ১৯৮৭ সালে মৃত্যুদন্ড শাস্তি রহিত করে কিন্তু ১৯৯৩ সালে এটি পুনরায় চালু করে ২০০৬ সালে আবার রহিত করে।