‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’ বা মানুষের ধর্ম নিয়ে হিববার্ট লেকচার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালের মে মাসে ম্যানচেস্টার কলেজ, অক্সফোর্ডে প্রদান করেছিলেন। তিনি যে ধারণাগুলি উপস্থাপন করেছিলেন তা ছিল তাঁর বহু বছরের চিন্তার চূড়ান্ত পরিণতি। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তিনি শারীরিক বিবর্তনকে অতিক্রম করে আধ্যাত্মিক বিবর্তন যথা ব্যক্তি মানবতার সীমা অতিক্রম করে কীভাবে বিশ্বমানবতায় পৌঁছানো যায় সে ব্যাপারে তিনি গভীর মনন করেছিলেন। তাঁর কাছে বিশ্ব মানবতা বিবর্তনের সর্বোচ্চ পর্যায়। অতএব, “মানুষের ধর্ম” এ মানুষের ধারণা হল সর্বজনীন মানুষের ধারণা যা অখন্ড বিশ্বসত্তার আরেক রুপ। সাধারণভাবে বিজ্ঞানে ও দর্শনে আরোহ মূলক যুক্তি বিজ্ঞান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় নতুন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। ঠিক সেই ভাবে কবির দর্শনেও কবি আরোহ মূলক যুক্তি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানব সত্তা থেকে বিশ্ব মানব সত্তার ধারণায় পৌঁছাতে।
ভারতীয় দর্শনে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বিধ পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়েছে । সর্বোচ্চ পুরুষার্থ হল মোক্ষ। আর এদের মধ্যে অন্যতম হল ধর্ম, ‘সর্বস্ব ধারকম্’ অর্থাৎ যা সকল কিছুকে ধারণ করে । মানুষের ধর্ম হল ‘মনুষ্যত্ব’ । ‘মনুষ্যত্ব’ হল ভারতীয় দর্শন সম্মত সামান্য বা জাতি যা সকল মানুষের মধ্যে সমানভাবে বিদ্যমান ধর্ম । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন প্রতিটি মানুষের মধ্যেই মানবোচিত গুণ বা বিশিষ্টতা যথা দয়া,প্রেম,করুণা,ভালোবাসা,মায়া-মমতা থাকে; এই সব কিছুর সামান্য ধারণা হল ‘মনুষ্যত্ব’ । রবীন্দ্রনাথ মানুষের দুটি দিকের কথা বলেছেন ; যথা প্রথমটি হল; যেখানে মানুষ নিজের বিষয়বুদ্ধি নিয়ে বাঁচতে চায়, অপরদিকটি হল যেখানে ব্যক্তিনিজের ব্যক্তিগত সীমা অতিক্রম করে পূর্ণ স্বরূপের উপলব্ধি করতে তৎপর ।
রবীন্দ্রনাথ পূর্ণ মানব স্বরুপের মধ্যেই মনুষ্যত্ব তথা মানবতাকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন, তার মানবতাবাদ হল মর্ত্য-অমর্ত্যের মেলবন্ধন যা বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করে পূর্ণ স্বরূপকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যখন দেখি মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের অবনতি, ধর্মীয় ভয়াবহ সংঘাত যা মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রেখেছে; সেখানে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ এ সকল কিছুর ঊর্দ্ধে উঠে আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন করে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা জাগাতে পারে । মানুষের চরম অভীষ্ট হল এই ভালোবাসা, বিশ্বজনীনতার দিব্য উপলব্ধি, সকল লতা-পাতা, বৃক্ষ, প্রান্তরের প্রতি মমত্ববোধ । রবীন্দ্রনাথের এই নিষ্পাপ ভালবাসার শক্তি এতটাই যে বর্তমান সমাজে সকল অসৎ, সংকীর্ণতা ও পঙ্কিলতাকে ধ্বংস করতে পারে এবং মানবের জীব সীমাকে অতিক্রম করে সর্বজনীন মানবসীমায় উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করতে পারে ।
ভারতীয় দর্শনে ‘দর্শন’ শব্দটি বলতে বোঝায় ‘দৃষ্টি’ । এই দর্শন হলো আত্ম দর্শন বা আত্মাকে দেখা বা জানা তথা সত্যের সাক্ষাৎ উপলব্ধি । দর্শনে সিদ্ধান্ত আনয়ন বিষয়ক যে দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, একটি হল তর্কবিদ্যার যুক্তি প্রণালী যাকে আমরা ‘অবরোহ পদ্ধতি’ বলি; যেখানে সিদ্ধান্ত আবশ্যিকভাবে আশ্রয় বাক্য থেকে নিঃসৃত হয়, আশ্রয় বাক্যের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিহিত থাকে । এই পদ্ধতির দ্বারা আমরা নতুন কিছু জানতে পারি না। আরেকটি পদ্ধতি হলো আরোহ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত অনিবার্যভাব হেতু বাক্য থেকে নিঃসৃত হয় না। সিদ্ধান্তটি আশ্রয় বাক্যের তুলনায় ব্যাপক হয়। এই পদ্ধতির দ্বারা নতুন কিছু জানা যায়। সাধারণভাবে বিজ্ঞানে এবং কবির অনুসন্ধানেও আরোহ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। আর এই জন্যই ভারতীয় দর্শনে ‘ব্যক্তিগত উপলব্ধি’ এত গুরুত্ব লাভ করেছে। ভারতীয় দর্শন হলো ‘সত্যদর্শ’, কবিগুরুও এই কথা মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন। তাই ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি এক জায়গায় বলেছেন, “আমার ধর্ম কবির ধর্ম, আমি যা কিছু অনুভব করি তার উৎস হল দৃষ্টি।” রবীন্দ্রনাথ সত্তার সত্যকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধের ভূমিকায় তিনি তাই বলেছেন ” আমাদের অন্তরে এমন কে আছেন যিনি মানব অথচ যিনি ব্যক্তিগত মানব কে অতিক্রম করে সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট। তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। তাঁরই আকর্ষণে মানুষের চিন্তায় ভাবে কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব। মহাত্মারা সহজে তাঁকে অনুভব করেন সকল মানুষের মধ্যে, তার প্রেমে সহজে জীবন উৎসর্গ করেন। সেই মানুষের উপলব্ধিতেই মানুষ আপন জীবসীমা অতিক্রম করে মানবসীমায় উত্তীর্ণ হয়। সেই মানুষের উপলব্ধি সর্বত্র সমান নয় ও অনেক স্থলে বিকৃত বলেই সব মানুষ আজও মানুষ হয়নি। কিন্তু তাঁর আকর্ষণ নিয়ত মানুষের অন্তর থেকে কাজ করছে বলেই আত্মপ্রকাশের প্রত্যাশায় ও প্রয়াসে মানুষ কোথাও সীমাকে স্বীকার করছে না। সেই মানবকেই মানুষ নানা নামে পূজা করেছে, তাকেই বলেছে ‘এষ দেবো বিশ্বকর্মা মহাত্মা।’ সকল মানবের ঐক্যের মধ্যে নিজের বিচ্ছিন্নতাকে পেরিয়ে তাঁকে পাবে আশা করে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানিয়েছে।”
মৃত্যুচিন্তা তাঁর পরমার্থ সাধনার একটি অন্যতম বিষয়। তিনি মানবজীবনের কোথাও সম্পূর্ণতা আছে কিনা জানতে চেয়েছেন।কবির লেখায় বারংবার মৃত্যুর প্রসঙ্গ এসেছে। তাঁর জীবন কালে নিকটজনকে হারানোর বেদনা কবি অন্তরে লালন করেছেন। তাই তাঁর কবিতায় বারবার মৃত্যু প্রসঙ্গটি এসেছে। এ ব্যাপারে মৃত্যুর পরে কবিতার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন-
‘হেথায় যে অসম্পূর্ণ সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত,
কোথাও কি একবার সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত,
জীবনে যা প্রতিদিন ছিল মিথ্যা অর্থহীন
ছিন্ন ছড়াছড়ি
মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি তারে গাঁথিয়াছে আজি
অর্থপূর্ণ করি।’
‘জীবনদেবতা’র ভাবনার দ্বারা কবি পুরাতনপন্থী সংস্কারকে বর্জন করে নতুন দর্শন আনয়ন করতে সচেষ্ট হয়েছেন-
‘জীবনকুঞ্জে অভিসার নিশা আজি কি হয়েছে ভোর?
ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা
আনো নবরুপ আনো নব শোভা,
নতুন করিয়া আর বার চিরপুরাতন মোর
নতুন বিবাহ বাঁধিবে আমায় নবীন জীবনভোরে।’
কবি জন্ম-জন্মান্তরকে ‘জীবনদেবতা’য় একসূত্রে গাঁথতে চেয়েছেন, জন্ম-জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে কবি বিশ্বমানব তথা বিশ্বচরাচরের অনুভব করেছেন। কবি বিশ্ব নিখিলের ধারণা ‘উপেন’ চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায়-
‘মনে ভাবিলাম মোরে, ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল দু-বিঘার পরিবর্তে।’
রবীন্দ্রনাথ তুলনা করে দেখিয়েছেন—মানবদেহে যেমন অসংখ্য জীবকোষের অবস্থান রয়েছে এবং সেগুলি স্বতন্ত্র থেকেও দেহের সার্বিক পোষণে নিয়োজিত থাকে, তেমনি স্বতন্ত্র ব্যক্তি মানুষই সমন্বিতভাবে মানবসত্তা গড়ে তোলে। সেই পূর্ণের অনুভব ব্যক্তি মানুষের উপলব্ধিতে থাকে। তাই মানুষ জানতে পারে সে ব্যক্তিমাত্র নয়, বিশ্বমানবের অন্তর্গত সত্তা। এতে জাগতিক কোনো সুবিধা নেই, কিন্তু বিরাট সত্তার সঙ্গে একাত্মতার বোধ থেকে জন্মায় অহেতুক আনন্দ। এ সবই মনুষ্যত্বধর্মের পরিচয় বহন করে।
দেশে দেশে কালে কালে মানুষ তার সাধনা দিয়ে এক অখণ্ড মানবসত্তা গড়ে তোলে। সেই সত্তা তাকে আপন সত্তা অর্থাৎ আত্মস্বরূপের উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়। সকল মানুষের মিলিত সাধনাতেই অন্তর্নিহিত সত্যের সন্ধান পাই আমরা। তা থেকে মানবমূল্যবোধ তৈরি হয়ে সভ্যতার ভিত্তি পত্তন করে।
রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পাশ্চাত্যের অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মধ্যে কয়েক জায়গায় মিল আছে, তবে অমিলই বেশি। উভয়েই মানবিক সত্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে দৃষ্টিভঙ্গি পৃথক। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রের চিন্তায় স্বাধীনতা এক সর্বব্যাপী রূপ পরিগ্রহণ করেছে। তাঁর মতে মানুষ হল পরিপূর্ণরূপে মুক্ত বা স্বাধীন কারণ মানুষের অস্তিত্ব শূন্যতা রূপে। যদি মানুষের নির্দিষ্ট রূপ থাকতো তবে তাকে মুক্ত বা স্বাধীন বলা যেত না। সীমাহীন স্বাধীনতার সঙ্গে শূন্যতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শূন্যতা থেকেই মানুষের মনে বিষাদ আসে। এর ফলে মানুষ এক ভয়ানক অনিশ্চিয়তার শিকার হয়। শূন্যতা থেকে আগত অনিশ্চিয়তার ভয়াভয় একাকিত্বের সঙ্গে মানুষ ভয়ঙ্কর স্বাধীনতার জগতে চির নির্বাসিত।
অপরদিকে মানবিক সত্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্র দর্শন সম্পূর্ণ পৃথক। ভারতীয় উপনিষদ নির্ভর রবীন্দ্র দৃষ্টিভঙ্গির দার্শনিক কেন্দ্রবিন্দু হল ‘আনন্দ’। রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতাকে দেখেছেন ভারতীয় উপনিষদের আনন্দের আলোকে। কর্মকে পরিত্যাগ করে নয় কর্মকে আনন্দোদ্ভদ করার ফলেই মুক্তি তথা স্বাধীনতা আসে।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব মানবতার ধারক ঈশ্বর এর অস্তিত্বের জন্য খুব বেশি বৌদ্ধিক ও বিমুর্ত যুক্তি জালে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর কাছে সর্বোচ্চ সত্তা হলো উপলব্ধির বিষয়, তা কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যার বিষয় নয়। তাঁর ঈশ্বর বিষয়ক প্রমাণকে দর্শনের ভাষায় ‘পরিকল্পনা মূলক যুক্তি’ বা ‘Teleological Argument’ বলা হয়। এই যুক্তি বলে যে জগতের শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়েই অর্থাৎ জগতের শৃঙ্খলা এর কারণস্বরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার্য। কবির কাছে এই বিশ্বজগত ঐক্যতান রূপে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই ঐক্যতান অসীম সঙ্গীত সৃষ্টিকারী ঈশ্বর ছাড়া ব্যাখ্যা করা যায় না।
কবি মনুষ্য ধর্ম আলোচনায় শ্রেয় ও প্রেয় এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। কবির মতে মানুষের স্বভাবে শ্রেয় ও প্রেয় দুই থাকে। সাধু তথা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি শ্রেয় কে গ্রহণ করেন তাই তিনি শ্রেষ্ঠ। অপরদিকে যিনি প্রেয় কে গ্রহণ করেন তিনি যে পুরুষার্থ থেকে বিচ্যুত হবেন এমন কোন কথা নেই। আসলে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যেই মানুষ শুধু শ্রেয় তথা সাধুতাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রেয় কে গ্রহণ করে সেই মানুষ বিশ্বমানবতার সন্ধান থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট। তাই তিনি ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে বলেছেন- “তেমনি একান্তভাবে প্রেয় কে অবলম্বন করলে, মানুষ বলতে যা বোঝায় সেই সত্য হীন হয়ে যায়। নিজের মধ্যে সর্বকালীন বিশ্বভূমীন মনুষ্য ধর্মের উপলব্ধিই সাধুতা, হীনতা সেই মহামানবের উপলব্ধি থেকে বিচ্যুত হওয়া।”
রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজ ইন্দ্রিয়, মন ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ হল আধ্যাত্মিকতার প্রতি যাওয়ার পথের অন্যতম আদর্শ। বিশ্ব মানব চেতনায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তিনি ‘গীতালি’র গানে ষড় ইন্দ্রিয় বিকাশের কথা বলেছেন, তিনি অনুভব করেছেন কার প্রতি তাঁর এই ক্রন্দন-
‘এতদিনে জানলেম
যে কাঁদন কাঁদলেম
সে কাহার জন্য,
ধন্য এ জাগরন
ধন্য এ ক্রন্দন,
ধন্য রে ধন্য।’
আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও প্রবন্ধ কখনো আত্মচেতনা, কখনো সৌন্দর্যচেতনা, কখনো ধর্মীয় আরাধনার পথ বেয়ে আধ্যাত্মচেতনায় তথা বিশ্ব মানব চেতনায় পর্যবসিত হয়েছে। উপনিষদের ঋষিসুলভ প্রত্যয় তাঁর কবিতা ও লেখায় প্রতিফলিত। তাঁর কবিতা ও গান গ্রাম বাংলার বাউল সম্প্রদায়কে যথেষ্ট ঋদ্ধ করেছে। ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে তিনি কখনও আমল দেননি। তাঁর লেখায় ও কর্মে বিশ্বমানবতার ভাব সুস্পষ্ট।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব মানবতার চেতনা জ্ঞানে উজ্জল, ভক্তিতে রসাপ্লুত, তাঁর চেতনায় প্রেম, দয়া, ধর্ম, কর্ম, ভক্তি, মৈত্রী সব মিলিত হয়ে এক পথের পথিক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাছে মানুষ বিশ্ব চেতনার অংশ, ‘সো অহম’ অর্থাৎ ‘আমিই সেই’ উপনিষদের এই বাণী কবি আষ্টেপৃষ্ঠে লালন করতেন। উপনিষদের এই বাণীর সঙ্গে একমত হয়ে তিনি ব্যক্তি মানবসত্তার সঙ্গে বিশ্ব মানব চেতনার মেলবন্ধন তুলে ধরেছেন। অহং আবরণ মোচন করে জীব মানব বিশ্বমানবে লীন হয়। তাই তিনি ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে বলেছেন-
“সো অহম সমস্ত মানুষের সম্মিলিত অভিব্যক্তির মন্ত্র, কেবল একজনের না; ব্যক্তিগত শক্তিতে নিজে কেউ যতটুকু মুক্ত হচ্ছে সেই মুক্তি তার নিরর্থক যতক্ষণ সে তা সকলকে না দিতে পারে।”
এই ধরাধামে সবকিছুই বিশ্বমানবতার চেতনায় অন্তর্লীন। তাই ‘প্রবাসী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘বিশাল বিশ্বে চারি দিক হতে প্রতি কণা মোরে টানিছে
আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ শতকোটিকর হানিছে।’