‘মহেশ’ গল্পে মহেশের মৃত্যুর জন্য কে বা কারা দায়ী যুক্তিসহ আলোচনা করো।

‘মহেশ’ গল্পে মহেশের মৃত্যুর জন্য কে বা কারা দায়ী যুক্তিসহ আলোচনা

জগদীশচন্দ্র বসুর ‘মহেশ’ গল্পের কাহিনীতে মহেশের মৃত্যু একটি গভীর এবং জটিল সমাজগত সমস্যা এবং নৈতিক সঙ্কটের ফলস্বরূপ। মহেশের মৃত্যুর জন্য কয়েকটি প্রধান কারণ ও চরিত্র দায়ী, যা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. জমিদার (হরকালী পাঠক)

  • নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা: হরকালী পাঠক, জমিদার হিসেবে, মহেশের মৃত্যুর জন্য প্রধান দায়ী। জমিদার হিসেবে তার আচরণ ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অমানবিক। তিনি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং প্রজাদের মানবিক দিকের প্রতি কোনো সহানুভূতি প্রদর্শন করেননি। জমিদারের নিষ্ঠুর আচরণ ও শ্রমের প্রতি অমান্যতার কারণে মহেশকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, যা তার শরীরকে বিপর্যস্ত করে তোলে। জমিদারের আর্থিক লোভ এবং মানবিকতার অভাব মহেশের জীবনের পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তোলে।

২. গফুর

  • অবহেলা ও অক্ষমতা: গফুর, যিনি জমিদারের সেবক, তারও কিছু দায় রয়েছে। যদিও গফুরের চরিত্র নিষ্ঠুর নয়, তবুও তার অক্ষমতা ও অবহেলার কারণে মহেশের জীবন আরও কষ্টকর হয়ে ওঠে। গফুর কেবলমাত্র জমিদারের আদেশ পালন করেন এবং মহেশের প্রতি যথাযথ যত্ন নেননি। তার অদক্ষতা ও অবহেলা মহেশের জীবনে আরও সমস্যা সৃষ্টি করেছে। গফুরের আচরণের ফলে মহেশকে পর্যাপ্ত সেবা এবং সমর্থন না পাওয়া, তার মৃত্যুর কারণ হতে সহায়ক।

৩. সামাজিক অবস্থা ও ব্যবস্থা

  • অমানবিক সমাজ ব্যবস্থা: মহেশের মৃত্যু শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট চরিত্রের দায় নয়, বরং পুরো সমাজ ব্যবস্থার অমানবিকতার ফলস্বরূপ। এই সমাজ ব্যবস্থা দরিদ্রদের প্রতি নির্মম এবং শোষণমূলক আচরণ করে। মহেশের মতো দরিদ্র মানুষের প্রতি সামাজিক সহানুভূতির অভাব এবং সমাজের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা তাদের জীবনে ক্রমাগত কষ্ট ও সংকট নিয়ে আসে। সমাজের এ ধরনের অমানবিক আচরণ মহেশের মৃত্যুতে অবদান রাখে।

৪. মহেশের নিজস্ব দুর্বলতা ও পরিস্থিতি

  • অলসতা ও শারীরিক দুর্বলতা: মহেশের নিজস্ব দুর্বলতা এবং শারীরিক সমস্যাও তার মৃত্যুর একটি কারণ। দীর্ঘদিনের অত্যাধিক পরিশ্রম, যথাযথ খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব, এবং শারীরিক অবস্থা তার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মহেশের স্বাস্থ্যগত সমস্যা তার জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। যদিও এই দুর্বলতা সমাজ ও কর্তৃপক্ষের অমানবিক আচরণের ফলস্বরূপ, তবে মহেশের শারীরিক দুর্বলতা তার মৃত্যুর জন্য একটি সঙ্গত কারণ হিসেবে কাজ করে।

৫. নির্যাতন ও শোষণ

  • অত্যাধিক শ্রম ও অবহেলা: মহেশকে অত্যাধিক পরিশ্রম এবং অবহেলার শিকার হতে হয়। জমিদার ও গফুর উভয়ের অবহেলা এবং অমানবিক আচরণ তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। শ্রমের পরিমাণ ও অবহেলার কারণে মহেশের শরীর ভেঙে পড়ে এবং তার মৃত্যু ঘটে।

৬. নিশ্চয়তা ও সহানুভূতির অভাব

  • মানবিক সহানুভূতির অভাব: মহেশের মৃত্যুর একটি বড় কারণ হল তার চারপাশের মানুষের সহানুভূতির অভাব। জমিদার ও গফুরের কাছে মহেশ একটি অপ্রয়োজনীয় এবং অবহেলিত বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়। মহেশের মানবিক দিক ও তার কষ্টের প্রতি কোনো মনোযোগ বা সহানুভূতি না থাকা তার মৃত্যুর জন্য অবদান রাখে।

সংক্ষেপে, ‘মহেশগল্পে মহেশের মৃত্যুর জন্য প্রধানত জমিদার হরকালী পাঠক দায়ী, যিনি তার নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণের মাধ্যমে মহেশের জীবনকে কঠিন করে তোলেন। গফুরের অবহেলা, সামাজিক ব্যবস্থার অমানবিকতা, এবং মহেশের শারীরিক দুর্বলতা এই মৃত্যুর অন্যান্য কারণ। এই সমস্ত কারণ মিলিয়ে মহেশের মৃত্যু সমাজের অবক্ষয়, দুর্নীতি, এবং মানবিকতার অভাবের ফলস্বরূপ ঘটেছে।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading