অথবা, মধুসূদনের কাব্যগ্রন্থগুলির সম্যক পরিচয় দিয়ে উনিশ শতকের বাঙলা কাব্যে ইহাদের অভিনবত্ব বিচার করো।
“মধুসূদন হইতে বাংলা কাব্যে আধুনিক যুগের সূচনা” :
কোন জাতির জীবনে নতুন ভাবের জোয়ার আসে, সেই ভাববস্তু এক এক জন মনীষীর প্রতিভা আশ্রয় করে মূর্ত হয়ে ওঠে। অকস্মাৎ সাহিত্যের প্রচলিত রূপরীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়, সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা হয়। বাঙলা কাব্যের সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রথম একটা বড়াে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল মধুসূদনের কাব্যকৃতিতে। মধুসূদনের সাহিত্যজীবনের বিস্তার খুব বেশী নয়। তার সাহিত্যচর্চার প্রধান পর্ব ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। মাদ্রাজ প্রবাস থেকে বাঙলাদেশে কবি যখন প্রত্যাবর্তন করেন—সেই সময়ে বাঙলার নবগঠিত সারস্বত সমাজের কাব্যরসপিপাসা নিবৃত্তির উপকরণ ছিল ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার পরিহাস-রসিকতা এবং রঙ্গলালের ভাবাতিরেকে আক্রান্ত রােমান্টিক কবিতা। সাহিত্য-রুচির ক্ষেত্রে তখন নতুন হাওয়া বইছিল, কিন্তু নবযুগের ভাবপ্রেরণা আত্মস্থ করে যথাযথভাবে নতুন কাব্য-কলা সৃজনের উপযুক্ত প্রতিভার আবির্ভাব তখনও হয়নি। মধুসূদন এই সম্ভাবনাপূর্ণ অথচ অগঠিত একটা সাহিত্যিক আবহাওয়ার কাজ শুরু করেন। উচ্চাভিলাষী যুবক মধুসূদন পাকা সাহেব হবার বাসনায় একান্তভাবে ইউরােপমুখী হয়েছিলেন। বাইরের দিক থেকে স্বদেশের প্রতি উপেক্ষাই তার সকল আচার-আচরণে প্রকট ছিল।
সুতরাং মাতৃভাষায় নতুন কিছু সৃষ্টি করা যে তার পক্ষে সম্ভব একথা তখনকার সাহিত্যিক সমাজের কারও পক্ষে বিশ্বাসযােগ্য ছিল না। রামনারায়ণের নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেবার জন্যে তাকে যতীন্দ্রমােহন ঠাকুর আহ্বান জানান। এই যােগাযােগেই বাঙলা সাহিত্যে এক দুর্লভ প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। বাঙলা ভাষায় মৌলিক নাটকের অভাব লক্ষ্য করে তিনি স্বয়ং স্বেচ্ছায় এই গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক রচনা করেন। পরবর্তী বৎসরই তিনি একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামে দুটি প্রহসন এবং ‘পদ্মাবতী’ নামক অপর একটি নাটকও রচনা করেন। কিন্তু বাঙলা গদ্যে যথাযথভাবে বীররস প্রকাশের সম্ভাব্যতা বিষয়ে যতীন্দ্রমােহনের সঙ্গে বিতর্ক প্রসঙ্গে মধুসূদন বাঙলায় অমিত্রাক্ষর রচনার প্রতিজ্ঞা করেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে দেশের সাহিত্যিক সমাজে আলােড়ন সৃষ্টি করলেন। বাজি রেখে অসম্ভবকে সম্ভব করার ঝোকে মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘তিলােত্তমা সম্ভব’ সম্পূর্ণ করলেন।
১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে ‘তিলােত্তমাসম্ভব’ কাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই কাব্যে মধুসূদনের কবি-জীবনের সূচনা, এই কাব্যেই বাঙলা কবিতায় আধুনিক যুগেরও সূচনা। এরপর ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে মধুসূদন তাঁর অমরকীর্তি এবং বাঙলা ভাষার একমাত্র মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ওড়-জাতীয় গীতিকাব্য ব্রজাঙ্গনা কাব্য এবং পাশ্চাত্ত্য পদ্ধতিতে বিয়ােগান্তক নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ রচনা করেন। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হয় বাঙলা ভাষায় প্রথম পত্রকাব্য—বীরাঙ্গনা কাব্য’। এর পর তিনি ব্যারিস্টারি পড়বার উদ্দেশ্যে বিলেত চলে যান, এবং সেখান থেকে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে অবস্থানকালে রচনা করেন বাঙলা ভাষায় প্রথম সনেট ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’। দেশে ফিরে আসবার পর আর কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, কিন্তু সাহিত্যকৃতিরূপে তাদের মূল্য খুব উচ্চমানের নয়। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য-হােমারের ‘ইলিয়াদে’র গদ্যানুবাদ ও ‘মায়াকানন’ নাটক।
সুন্দ-উপসুন্দ নিধনের জন্য অপরূপ রূপলাবণ্যবতী তিলােত্তমা সৃষ্টির পৌরাণিক কাহিনী মধুসুদন এই কাব্যে ব্যবহার করেছে। নতুন ছন্দ সৃষ্টির প্রতিই কবির আগ্রহ প্রবল হওয়ায় কাহিনী বিন্যাস এবং গঠনের দিক থেকে ‘তিলােত্তমা’ অনেকাংশে অসম্পূর্ণ রচনা। দেবচরিত্রগুলির পরিকল্পনায় এবং এক সর্বাতিশায়ী দৈবশক্তির কল্পনায় মধুসূদন কিছু পরিমাণ গ্রীক কাব্যের অনুসরণ করলেও পুরানাে কাহিনীতে কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেন নি। ‘তিলােত্তমাসম্ভবে’ একটা আখ্যানধারা আছে, কিন্তু সেই আখ্যানকে মহাকাব্যোচিত সংহত আকার দেওয়া হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে এক-একটা বর্ণনা, বিশেষভাবে নিসর্গ বর্ণনাগুলিতে কবির রােমাণ্টিক প্রবণতা এবং লিরিক ভাবােচ্ছাসে যথার্থ নতুন কাব্যরসের স্বাদ পাওয়া যায়। এই কাব্যের বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য দুটি- [এক] অমিত্রাক্ষর ছন্দে পূর্ণাঙ্গ পৌরাণিক কাব্য রচনার এই প্রথম প্রয়াস। [দুই] ভারতীয় কাহিনী বিন্যাসে পাশ্চান্ত্য জীবন- ভাবনার মিশ্রণ।
মৌলিক প্রতিভাসম্পন্ন কোন কবিই অন্ধভাবে প্রচলিত কাব্যকলার অনুবর্তন করেন না। আপন জীবন-ভাবনালব্ধ সত্য এবং আপন কল্পনার জগৎটাকে প্রকাশের জন্য নতুন আঙ্গিক, নতুন ভাষা তাকে নির্মাণ করতে হয়। বাণীর নতুন রূপ সৃষ্টি মৌলিক প্রতিভার একটা বিশিষ্ট লক্ষণ। আধুনিক কালের কবি মধুসূদনের পক্ষে রূপান্তরিত জীবন-চেতনা প্রকাশের জন্যে নূতন কাব্যভাষা এবং নতুন আঙ্গিক উদ্ভাবন অপরিহার্য ছিল। আত্মপ্রকাশের দুরন্ত আগ্রহে কবি প্রাচীন ছন্দের বন্ধন ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নির্মাণ করেছেন। মধুসূদনের এই প্রয়াসে বাঙলা কাব্যে ছন্দোমুক্তির সূচনা হয়। এর পূর্বে আট এবং ছয় মাত্রার দুটি পর্বে গঠিত চরণে এবং দুটি অন্ত্যমিলযুক্ত চরণ নিয়ে অক্ষরবৃত্ত পয়ার গঠিত হয়। চরণের আট ও ছয়মাত্রার পর্ব দুটি একই সঙ্গে অর্থগত ভাগ এবং শ্বাসগত ভাগরূপে পরিগণিত হয়। সুতরাং এই ছন্দে ছেদ এবং যতি পড়ত একই স্থানে। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে দৃশ্যত বড়াে বৈশিষ্ট্য দুই চরণের মধ্যে চরণান্তিক মিলের অভাব, কিন্তু এটাই অমিত্রাক্ষরের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়। প্রধান বৈশিষ্ট্য ছেদ ও যতি স্থাপনের নতুন পদ্ধতি। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষরে শ্বাশত বিভাগ প্রাচীন পয়ারের মতােই আট ছয় মাত্রার দুটি পর্বে, কিন্তু অর্থের দিক থেকে এইভাবে পর্ব ভাগ করা যায় না। চরণ অতিক্রম করেও বক্তব্য-ধারা অন্য চরণে সংক্রমিত হতে পারে। বস্তুতঃপক্ষে এই প্রবহমাণতায়ই অমিত্রাক্ষর ছন্দের অন্যতম প্রাণ-ভােমরাটি যেন লুকিয়ে আছে। ফলে একটা ভাব দুটি চরণের পয়ারের মধ্যেই সম্পূর্ণ করবার বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন,
“কিন্তু মায়াময়ী মায়া, বাহু প্রসারণে
ফেলাইলা দূরে সবে, জননী যেমতি
খেদান মশকবৃন্দে সুপ্ত সুত হতে
করপদ্ম সঞ্চালনে!”
অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল শক্তি এই নতুন বিন্যাস-রীতিতেই নিহিত। মিলের অভাবজনিত শূন্যতা কবি পূর্ণ করেছেন সুনির্বাচিত শব্দপ্রয়ােগে সৃষ্ট ধ্বনির বিচিত্রতা দ্বারা। লঘু ও গুরু শব্দের সংঘাতে এই কবিতায় এমন ছন্দোসঙ্গীত সৃষ্টি হয়-যার ফলে মিলের অভাব অনুভূতই হয় না। ‘তিলােত্তমাসম্ভব কাব্যে’ এই ছন্দ অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবেই ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ই অমিত্রাক্ষর ছন্দের বিচিত্রতর ব্যবহার দেখা যায়। ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ অমিত্রাক্ষর ছন্দের নমনীয়তা এবং সৌন্দর্যের চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।
এ জাতীয় ছন্দ ও ভাষার ব্যবহারে মধুসূদনের কাব্য যে এক মহৎ মর্যাদার আসনে সমুন্নীত হয়েছিল এবং এ কাব্য যে দেশবাসীর দ্বারা অতিশয় সমাদৃত হয়েছিল, তার উল্লেখ করে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এইরূপ উদাত্ত ভাষা গৌরব ও ধ্বনিগান্ভীর্য-সমন্বিত, অন্ত্মিলহীন, অথচ অন্তশ্ছন্দঃস্পন্দের বিচিত্র প্রবাহের দ্বারা গীতােচ্ছ্বাসময় কবিতার জন্য দেশের কেহই প্রস্তুত ছিলেন না। ইহার জন্ম মধুসূদনের পাশ্চান্ত্যকাব্যপুষ্ট, প্রতিবেশ-নিরপেক্ষ একক কল্পনার মধ্যে। কবিপ্রতিভার সহিত সমকালীন কাব্যরুচির এরূপ দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান অতিক্রম করিবার শক্তি তিনি নিজ অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যেই পাইয়াছিলেন।”
মধুসুদনের বিশিষ্ট প্রতিভার শক্তি পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্যে। এই কাব্যের প্রকাশকাল ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে এবং এটা মধুসূদনের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। তিলােত্তমার কাব্যভাষা এবং কাব্যের ছন্দ বিষয়ে কবি যে পরীক্ষার সূচনা করেছিলেন, পরীক্ষামূলকতার স্তর অতিক্রম করে তা এই কাব্যে নতুন সৃষ্টির প্রাণােন্মাদনায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধের বিরাট পটভূমির মধ্যে নানা ধরনের চরিত্র এবং নানা রসের সমাবেশ ঘটেছে। অনুভূতির বৈচিত্র্য এবং আবেগের ভিন্ন ভিন্ন স্তর এই কাব্যে কবি অমিত্রাক্ষরের মাধ্যমে অনায়াসে প্রকাশ করেছেন। তিনি দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ সর্ববিধ প্রয়ােজনেই ব্যবহৃত হতে পারে।
কিন্তু শুধু ভাষা ও ছন্দের জন্যেই নয়, মর্মগত বক্তব্যের জন্যেও মেঘনাদবধ বাঙলা কাব্যের ইতিহাসে সম্পূর্ণ এক নতুন সৃষ্টি। ভারতবর্ষের মানুষের জীবনে আবহমান কাল ধরে সমাদৃত রামায়ণ কাহিনী থেকে মধুসূদন এই কাব্যের কাহিনী সংগ্রহ করেছেন; ভারতীয় সমাজের নীতি-চেতনা, ধর্মবােধ, গার্হস্থ্য বন্ধন প্রভৃতি যে আদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, রামায়ণে সেই আদর্শকেই রূপ দেওয়া হয়েছিল এবং এই জীবন-নীতির বিরােধী যা কিছু-তাই প্রতিফলিত রামায়ণের রাবণ চরিত্রে।
মধুসূদন মধ্যযুগীয় জীবনাদর্শের বিরুদ্ধে আধুনিক জীবনচেতনায় দীপ্ত ব্যক্তি-মানুষের মহিমা বড়াে করে দেখাবার জন্যে এই ধর্মদ্রোহী রাবণকেই তাঁর কাব্যে নায়কের মর্যাদা দিয়েছেন এবং রাবণ ও পক্ষভুক্ত বীরদের চরিত্র উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত করেছেন। যে রামচন্দ্র প্রতি পদক্ষেপে নীতিশাস্ত্রের সূত্র মিলিয়ে চলেন তার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে নবযুগের কবি আত্মশক্তির বলে বলীয়ান অসীম শক্তিধর স্পর্ধিত রাবণকেই কাব্যে প্রাধান্য দিয়েছেন। রাবণ চরিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলাতেই কবি আনন্দবােধ করেছেন।
এই রাবণ একদিকে অমিত বলবীর্যশালী—অন্যদিকে স্নেহে-প্রেমে মমতায় পূর্ণ হৃদয় নিয়ে মানবতার আদর্শ বিগ্রহ। যে মানবতাবাদ ইউরােপ থেকে সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের দেশের উনিশ শতকের জীবনচেতনায় এক নবজাগরণ সম্ভব করে তুলেছিল, মেঘনাদবধ কাব্যে সর্বপ্রথম সেই নতুন জীবনাদর্শের রূপায়ণ দেখা গেল। মেঘনাদবধ কাব্যে ভাব ও রসের ক্ষেত্রে অতি সচেতনভাবে যে পরিবর্তন ঘটানাে হল, প্রাচীন ধর্ম ও নীতি-শাসিত জীবনের পরিবর্তে আত্মশক্তিনির্ভর অটল ব্যক্তিত্বে উন্নতশির মানুষের মহিমা মূর্ত করে তােলা হল—তাতেই যথার্থভাবে আধুনিক কাব্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারগৃহে লক্ষ্মণের সহযােগীরূপে বিভীষণকে দেখতে পেয়ে তার উদ্দেশ্যে মেঘনাদ যখন এই কঠিন ধিক্কার উচ্চারণ করে তখন তার মধ্যে আমরা আধুনিক স্বাজাত্যবোেধকেই উদ্ভাসিত হতে দেখি।
বিষয়বস্তু এবং কাব্যকলা—উভয়দিক থেকেই মেঘনাদবধ আধুনিক শিল্পবােধসম্পন্ন কবির মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দেয়। নতুন ছন্দ ও রূপান্তরিত ভাষার প্রয়োগে, সুপরিকল্পিতভাবে কাহিনী-বিন্যাসে, সংহত কাব্যকায়া-নির্মাণের দক্ষতায় মধুসূদন এই কাব্যে আধুনিক কবিদের সামনে কবিতার শিল্পরূপ সৃষ্টির দায়িত্ব সম্পর্কে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। মেঘনাদবধই আধুনিক যুগের প্রথম বাঙলা কাব্য।
মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যে’র যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন সেকালের মনীষী শ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র, তিনি লিখেছেন, “…The scenes, characters, machin ery and episodes are in many respects, of Mr. Datta’s own creation. In their conception and development Mr. Datta displayed a high order of art to Homer and Milton, as well as to Valmiki, he is largely indebted in many ways, but he has assimilated and made his own most of the ideas which he has taken and his poem is on the whole the most valuable work in modern Bengali literature.”
মেঘনাদবধ কাব্য ই মধুসূদনের কবিখ্যাতির প্রধান অবলম্বন হওয়ায় তিনি মহাকাব্যের কবিরূপে পরিচিত। মেঘনাদবধের মহাকাব্যোচিত সমারােহের মধ্যেও মাঝে মাঝে গীতিরস উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধের চতুর্থ সর্গে সীতার বিলাপে, রাবণের আর্তস্বরে মধুসুদনের প্রকৃতিগত রােমান্টিক লিরিক মানসপ্রবণতা প্রকাশ পায়। তার কবিমানসের লিরিক প্রবণতার জন্যেই মেঘনাদবধ রচনার সঙ্গে সঙ্গে রাধাবিরহ-প্রসঙ্গ নিয়ে কাব্য রচনার প্রেরণা তিনি অনুভব করেছিলেন।
বৈষ্ণব কাব্যের রােমান্টিক পরিবেশ এবং রােমান্টিক প্রেমের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনা কাব্যে নতুন ভঙ্গি তে প্রকাশ পেয়েছে। তার বৃহৎ কাব্যগ্রন্থগুলির পাশে খণ্ড খণ্ড গীতিকবিতার এই সংকলনটি তেমন মর্যাদা পায়নি, তবুও ‘ব্রজাঙ্গনা’র কবিতাগুলি ভাষা-ছন্দের পরীক্ষার দিক থেকে আকর্ষণীয়। দেশজ ভাষার ছন্দম্পন্দ যে মধুসূদনের কাছে অপরিজ্ঞাত ছিল না ব্রজাঙ্গনা কাব্য তার প্রমাণ।
মেঘনাদবধ রচনার সমসময়েই ব্রজাঙ্গনায় মধুসূদন এইরূপ স্বাচ্ছন্দ্যময় লিরিক লিখেছেন। খাঁটি বাঙলা ভাষার ছন্দম্পন্দ যে তাঁর মজ্জাগত, উদ্ধৃত অংশটিতেই তা প্রমাণিত হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বিচিত্র ব্যবহার কবিতার গঠনে, যতি সংখ্যা এবং চরণ সংখ্যা বিন্যাসের অপরিসীম স্বাধীনতায় ও স্তবক-গঠনে ‘ব্রজাঙ্গনা’র কবিতাগুলি বাঙলা কবিতার আঙ্গিকগত পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২) ওভিদের ‘হেরােইদাস’ কাব্যের অনুসরণে রচিত পত্রকাব্য। ওভিদের কাব্যে একুশখানি পত্র আছে, মধুসূদনেরও পরিকল্পনা ছিল একুশটি পত্র দিয়ে বীরাঙ্গনা কাব্য সম্পূর্ণ করার। কিন্তু মাত্র একাদশটি পত্রের সংকলন-রূপে এই কাব্য প্রকাশিত হয়। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী থেকে এগারজন নায়িকা চরিত্র নির্বাচন করে প্রেমাস্পদের উদ্দেশ্যে নায়িকাদের পত্রের আকারে এই কাব্যের এগারটি সর্গ রচিত হয়েছে। প্রতিটি সগই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু একটা নারী-চরিত্রের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের আধারে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রেমের রূপ স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
চরিত্র এবং চরিত্রগত সমস্যার ফলে হৃদয়াবেগের স্তরগুলি সর্বত্র এক নয়, কিন্তু মধুসূদনের ভাষা ও ছন্দ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিষয়ের উপযুক্ত আধার হয়ে উঠেছে। ‘বীরাঙ্গনা’র পত্রিকাগুলিতে এক একটা আখ্যানের ক্ষীণ আভাস আছে, প্রতিটি সহি বিশেষভাবে চরিত্রগুলির উক্তিরূপে রচিত। তথাপি তার মধ্যে আখ্যান-কাব্যের নয়, গীতিকাব্যের ধর্ম বেশী পরিস্ফুট হয়েছে। প্রতিটি সর্গে একটা স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবের প্রকাশ হওয়া বস্তুত সর্গগুলি খণ্ড খণ্ড গীতিকাব্যেরই রূপ ধারণ করেছে। তাতে বীর, করুণ, বীভৎস বিভিন্ন রসের সার্থক সৃষ্টি করেও মধুসূদন এর দ্বারা গীতিকবিতাসুলভ মধুর রসসৃষ্টিতেই অধিকতর সার্থকতা দেখিয়েছেন। এই বিষয়ে মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ এবং ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ একসূত্রে গ্রথিত। বীরাঙ্গনার ভাষাকেও গীতিকাব্যের আদর্শ ভাষা বলা যায়।
মধুসূদনের শেষতম কাব্যগ্রন্থ ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ বা সনেট সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে। সনেট বস্তুত গীতিকবিতারই একটা প্রকারভেদ। বাঙলায় পাশ্চাত্ত্য কাব্যকলা আত্মীকরণের ঝোক মধুসূদনের কবিজীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কবি-জীবনের প্রথম পর্বেই তিনি সনেট রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম সনেটটির রচনাকাল মেঘনাদবধের সমসাময়িক। কিন্তু এরপরে কবি দীর্ঘদিন এই কাব্যরূপটির চর্চা করেন নি। ইউরােপ প্রবাস কালে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ভের্সাই শহরে কবি যখন বাস করেছিলেন তখনই সনেটগুলি রচনা করেন। পরবাসে দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে কবির ক্লিষ্টচিত্ত স্বদেশের জন্যে দেশের কাব্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্যে যে ব্যাকুলতা অনুভব করত এই খণ্ড খণ্ড কবিতায় তাই অপরূপভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থেই ব্যক্তি-মানুষ মধুসূদনের অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। আখ্যান নয়, চরিত্রসৃষ্টির আগ্রহ নয়, একান্তভাবে কবির নিজস্ব আবেগ অনুভূতি প্রত্যক্ষভাবে সনেটগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে ইতালীয় কবি পেট্রার্ক কর্তৃক অনুপ্রাণিত হলেও মধুসূদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল্টনের মিলবিন্যাস রীতি অনুসরণ করেছেন।
এই সনেটগুলিকে কবি-আত্মার বহিঃপ্রকাশরূপেই চিহ্নিত করা চলে। কবি ওআর্ডসওআর্থ মহাকবি শেপীয়রের সনেটগুলি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে ‘with this key he un- locked his heart’ অর্থাৎ এই সনেটগুলিকেই চাবিরূপে ব্যবহার করে শেল্পীয়র তার হৃদয় উন্মােচন করেছিলেন। অনুরূপ মন্তব্য মধুসূদন সম্বন্ধেও যথাযথভাবেই প্রযুক্ত হতে পারে, কারণ এই সনেটগুলিতেই কবি-প্রাণের যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। “নিজের আপন জনকে, দেশকে, জাতিকে, যথার্থভাবে জানতে হলে বােধ হয় একটু দূর থেকেই দেখতে হয়; হিমালয়ের বুকে বসে হিমালয়ের বিরাটত্ব উপলব্ধি করা যায় না, একমাত্র দূর থেকে দেখলেই তার সমগ্রতার বােধ আসে। তেমনি, মধুসূদনও দূর প্রবাসে অবস্থানকালেই স্বদেশ-স্বজনের স্মৃতিতে উদ্বেল হয়ে তার যথার্থ মূল্য অনুধাবন করতে পেরেছেন।” (অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য)।
মধুসূদনের কবি-জীবনের বিস্তার খুব বেশী নয়। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত কবি জীবনে মাত্র কয়েকটা কাব্যগ্রন্থে তিনি বাঙলা কবিতাকে আবহমান ধারায় মৌলিক রূপান্তর সাধন করে গেছেন। তিনিই বাঙলা কবিতায় বিশ্ব কাব্যলােকের উন্নততর আদর্শ এবং রুচির প্রবর্তন করেন। ধর্মীয় জটিলতা এবং অতিলৌকিকতায় আচ্ছন্ন বাঙলা কাব্যের ক্ষেত্রে মানবিক অনুভূতির বিচিত্রতা ও মানব মহিমাকেই কাব্যবিষয়রূপে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি বাঙলা কবিতার ভবিষ্যৎ মুক্তিপথ প্রস্তুত করে দিয়েছেন। কবিতার ভাব ও রসের ক্ষেত্রে যেমন তিনি বিপ্লব সাধন করেছেন তেমনই এই নতুন ভাববস্তুর উপযুক্ত আধার রচনার জন্য প্রাচীন বাঙলা কাব্যের প্রকাশরীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন কাব্য-আঙ্গিক উদ্ভাবন করেছেন। সুতরাং মধুসূদন থেকেই বাঙলা কাব্যের আধুনিক যুগের সূচনা—এই উক্তিতে একটা তর্কাতীত ঐতিহাসিক সত্যই বিঘােষিত হয়েছে বলা যায়।