বিহারীলাল চক্রবর্তী (২১ মে, ১৮৩৫–২৪ মে, ১৮৯৪) হলেন বাংলা ভাষার একজন কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথ তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান
বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান :-
ভূমিকা:- কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী মহাকাব্যের যুগে সর্বপ্রথম গীতি কবিতার প্রতি সর্বাত্মকভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এবং মহাকাব্যের যুগে তিনি নিজের মনে কাব্য লােকের সুর সাধনা করেছেন। পরবর্তীতে মহাকাব্যের জলােচ্ছ্বাস মন্দীভূত হয় এলাে তখন গীতিকবিতা প্রাধান্য পেল। বাংলা কাব্যের পালাবদলের ইতিহাস এর প্রধান সূত্র কার কবি বিহারীলাল। পরবর্তীকালে তার শিষ্য সম্প্রদায় গীতিকবিতায় অবতীর্ণ হয় যেন তার সূত্রেই ভাষ্য রচনা করেছেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী বাংলায় রােমান্টিক গীতিকাব্যের প্রথম ও স্বার্থক পথপ্রদর্শক। তিনি প্রথম আত্ম ভাবমূলক গীতি কবিতা রচনা করেন। তাই তাে রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালকে “ভােরের পাখি” রূপে অভিহিত করেন।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল— (ক) সারদামঙ্গল, (খ) সাধের আসন, (গ) বন্ধুবিয়ােগ, (ঘ) নিসর্গ-সন্দর্শন, (ঙ) বঙ্গসুন্দরী, (চ) প্রেম প্রবাহিনী।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ গুলি হল :-
(ক)বিহারীলাল চক্রবর্তীর সারদামঙ্গল: একান্তভাবে আত্মগত ও মন্ময় কাব্য হিসাবে বিহারীলালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ সারদামঙ্গল। এই প্রসঙ্গে কবি নিজেই লিখেছেন মৈত্রী বিরহ, প্রিতী বিরহ, সরস্বতী বিরহ এই ত্রিবিধ বিরহে উন্মত্ত হয়ে আমি সারদামঙ্গল রচনা করি। এই সারদা কখনও জননী কখনাে প্রিয়সি কখনাে কন্যা। তিনি দয়া স্নেহ ও প্রেমে মানবচিত্ত কে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সারদামঙ্গল পাঁচটি সর্গে গ্রোথিত। সারদার সঙ্গে কবির বিরহ মিলন অশ্রুভারাতুর ও আনন্দময় মুহূর্ত গুলি কাব্যটিকে রােমান্সময় করে তুলেছে।
(খ) বিহারীলাল চক্রবর্তীর সাধের আসন: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন বিহারীলালের ভক্ত। তিনি একটি উপহার সাদৃশ্য আসনবুনে জানতে চেয়ে ছিলেন সারদার তত্ত্ব বা সারদার বিষয়। সেই প্রশ্নের উত্তরে বিহারীলাল সারদামঙ্গল কাব্যের উপসংহারে লিখেছিলেন সাধের আসন গ্রন্থটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকলেও স্পষ্ট হয়নি এবং সাধের আসন উন্নত শিল্পরূপ হয়ে ওঠেনি।
(গ) বিহারীলাল চক্রবর্তীর বন্ধুবিয়ােগ : চারটি স্বর্গে বর্ণিত বন্ধুবিয়ােগ কাব্যে কবি তার চার বন্ধু পূর্ণচন্দ্র, কৈলাশ, বিজয় ও রামচন্দ্র এবং প্রথম স্ত্রী অভয়ার বিয়ােগব্যথা ব্যক্ত করেছেন। কাব্যটিতে শেলীর Adonias কাব্যের প্রভাব আছে।
(ঘ) বিহারীলাল চক্রবর্তীর নিসর্গ-সন্দর্শন: কাব্যটি সাতটি স্বর্গে রচিত। নিসর্গের নানা চিত্র সমুদ্র দর্শন, নভােমন্ডল, ঝটিকার রজনী, ঝটিকার সম্ভোগ প্রভৃতি প্রকৃতি বর্ণনা বেশ চমকপ্রদ। সমগ্র কাব্য জড়প্রকৃতির একটি প্রানময় পরিচয় ফুটে উঠেছে যার অভিনবত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়।
(ঙ) বিহারীলাল চক্রবর্তীর বঙ্গসুন্দরী: এই কাব্যে তিনি কয়েকটি নারী চরিত্র অঙ্কন করে তার মধ্য দিয়ে গৃহচারিণী নারীকে সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে সৌন্দর্যস্বর্গে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে নারী প্রত্যহের পরিচিত পরিবেশে জননী,জায়া, কন্যা, ভগ্নীরুপে গৃহসংসারে আসীনতাকেই তিনি সীমা স্বর্গের ইন্দ্রানী করে একেছেন। নারীর রােমান্টিক ও আইডিয়াল মূর্তির সঙ্গে বাঙালির ঘরের নারীমূর্তির এই অভূতপূর্ব সমন্বয় বিহারীলালের একটি বিশিষ্ট দান।
(চ)বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রেম প্রবাহিনী: কাব্য টি পতন বিরাগ বিষাদ অন্বেষণ নির্বাণ এই পাঁচটি সর্গে বিন্যস্ত।কাব্যটিতে বিহারীলালের কবি প্রাণের যথার্থ জাগরণ ঘটেছে।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবি ভাবনার বৈশিষ্ট্য :
বিহারীলালের কবি ভাবনার বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হলাে –
এক. বাংলা সাহিত্যে যখন মহাকাব্যের গাম্ভীর্যে মহামান্বিত এবং আখ্যানকাব্য ধারায় উজ্জ্বল তখন বিহারীলালের কাব্যে গীতি কবিতার সুর ঝংকার হয়।
দুই. বিহারীলাল রােমান্টিক ও মিস্টিক কবি। তাঁর কাব্যে রােমান্টিকতার সঙ্গে মিস্টিসিজম এর সম্পর্ক নিকট ও নিবিড়।
তিন. বিহারীলাল সুন্দরীর উপাসক বিশ্বের তাবৎ পদার্থের অন্তরালে এক পরম সুন্দরকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
চার. তার কাব্যে ক্লাসিক রীতীর অনেকটাই ছিন্ন হয়েছে, যদিও সে প্রভাব তিনি সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
পাঁচ. তার কাব্যে গভীরভাবময়তা, প্রবল আবেগ-উচ্ছ্বাস পূর্ণ থাকলেও ভাষার অস্পষ্টতা ও সাজসজ্জায় অপূর্ণতা দেখা দিয়েছে।
ছয়. কবি হিসাবে বিহারীলালের অন্যতম কৃতিত্ব এই যে তিনি তাঁর কবিতার অনুসারী এক গােষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছেন।
বিহারীলাল গীতি শাখার এক অভিনব যুগ সৃষ্টি করলেও বিহারীলাল সে যুগে গীতিকাব্যের যুগন্ধর পুরুষ হতে পারেননি। তার মধ্যে গীতিকাব্যের নব সম্ভাবনা মুকুলিত হলেও পরবর্তীকালে তার শিষ্যদের মধ্যে তা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠল। তা সত্ত্বেও আধুনিক গীতিকাব্যের অগ্রদূত হিসেবে কবি বিহারীলাল চিরদিনই শ্রদ্ধার আসন লাভ করেন। বিহারীলালই উনিশ শতকের গীতিকাব্যের জনক। কেননা সে যুগের গীতি কবিরাও তাকে গুরু বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাইতাে রবীন্দ্রনাথ বিহারীলাল সম্পর্কে বলেছেন- “সে প্রত্যুষে অধিক লােক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত হয়ে ওঠে নাই। সেই ঊষালােকে কেবল একটি ভােরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল।”