ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃতি:
The Nature of secularism in India ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সংবিধানের ২৫-২৮ নং ধারাগুলিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিধানের ১৫ নং ধারায় ভিত্তিতে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে, সংবিধানের ১৬নং ধারার সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৭ নং অস্পৃশ্যতার আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি একটু ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হয়। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ করতে সক ধর্মকে সমান মর্যাদা দেওয়াকে বোঝানো হয়। এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে দিয়ে ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম রূপকার আমেনার (G. Ayyangar) ১৯৪৮ সালের ৭ই ডিসেম্বর গণপরিষদে বলেন, “আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই। ধর্মনিরপেক্ষ বলতে আমরা একথা বোঝাতে চাইছি না যে, কোনো ধর্মের প্রতি আমাদের বিশ্বাস নেই এবং আমাদের জীবনে এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মনিরপেক্ষ কথাটির অর্থ হল রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মকে সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা করবে না এবং এক ধর্ম অপেক্ষা অন্য ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না। ১৯৭৬ সালের ১৬ই অক্টোবর নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক কনভেনশনে ভাষণদানকালে তপ্ত সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া মন্তব্য করেন, সব ধর্মের প্রতি আমাদের গভীর শ রয়েছে। দেশের মধ্যে
সম্প্রদায়ের সমান মর্যাদা ও সম্মান রাষ্ট্র আশ্রণী ভূমিকা পালন করবে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ এবং প্রকৃতি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন গণপরিষদের সদস্য পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৪৮, গণপরিষদে এই প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শ্রী মৈত্র মন্তব্য করেন, “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে বোঝায় রাষ্ট্র ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কোনোরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। কোনো বিশেষ ধর্ম রাষ্ট্র থেকে বিশেষ আনুকুল্য পাবে না। কোনো বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের লোক বলে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে বাড়তি সুযোগসুবিধা দেবে না। একই সঙ্গে এটাও দেখতে হবে যে কোনো ব্যক্তি যেন তার পছন্দমতো ধর্ম প্রচার ও অনুসরণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।” কে. এম. পানিকর (K. M. Panikkar) বলেছেন, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ফলে অধার্মিক (irreligious) হয়ে যায়নি। এখানকার ধর্মনিরপেক্ষতা এক অর্থে নেতিবাচক, কারণ এখানে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিচার বিবেচনাকে প্রায় দেওয়া হয় না। এইচ. ডি. কামাথ (H. V. Kamath) প্রায় একইভাবে বলেন, “আমার মতে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেমন ঈশ্বর-বিহীন নয়, তেমনি অধার্মিক বা ধর্মবিরোধী নয়। “Recovery of Faith গ্রন্থে বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে অধার্মিক ধর্ম বা ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন রাষ্ট্রকে বোঝায় . . . (D. E. Smith) বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে এমন একটি রাষ্ট্রকে বোঝায়, যা ব্যক্তি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করে, যা ধর্মমত নির্বিশেষে সকল ব্যক্তিকে নাগরিক হিসাবে গণ্য করে এবং যা সাংবিধানিকভাবে কোনো বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা বা বিরোধিতা করে না। ভারতী সংবিধানের অন্যতম রূপকার আম্বেদকর (Dr. BR Ambedkar) বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অর্থ হল রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মকে জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবে না। ভারতীয় সংবিধানের অপর এক স্থপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মের বিরোধিতা করা না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হল সেই তাই যা সকল ধর্মবিশ্বাসের প্রতি এবং সকল ধর্মকে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এইধরনের রাষ্ট্র নিজেকে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করে সুতরাং দেখা যাচ্ছে পশ্চিমি গণতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, ভারতবর্ষে তা হয় না। পশ্চিমি ধর্মনিরপেক্ষতার অान, কার ইত্যাদি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখা। এখানকার ধর্মশিক্ষার মূল লক্ষ্য হল সমাজ ও রাজনীতির ওপর থেকে ধর্মের পরম্পরাগত প্রভাবকে দুর্বল করা। কিন্তু ভারত ধর্মকে করি পর্যায়ে রাখা হয় না এবং রাজনীতি, শিক্ষা ইত্যাদি থেকে করা হয় না। বিভিন্ন ধর্মকে রক্ষা করা বা তার মনে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি নয় হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত ডঃ সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দেখ সব ধর্মের পূজাপার্বণে ছুটি দর্শনের বিপরীতততবর্ষে সেটাই করা হয়। ভারতবর্ষে সকল ধর্মকে সমান চোখে দেখা হয় এবং ধর্মকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টায় সুতরাং বলা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা খানে সর্বধর্ম সম ধর্মনিরপেক্ষতা বলে চালাবার চেষ্টা করা হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় সকল ভারতীয় দার্শনিকের চিন্তার ও কর্মে রাজনীি ধর্মের সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। পরিমাজ দেশমাতৃকাকে দেবীরূপে কল্পনা করেছেন দেশবাসীকে সেই দেবীর আরাকনার চিবুদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। ভারতের জাতীয় নেতৃত্ব রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মাধ্যামাদিকে প্রভার দিয়েছেন। স্ত্রী বিশ এর মতে, যাঁরা বলেন ধর্ম ও রাজনীতি মানুষের জীবনের দুটি পরস্পর-বিচ্ছিন্ন দিক, তারা শুধু হাসির খোরাক যোগান। গান্ধিজি-র মতে পারে না। ধর্মবিবর্জিত রাজনীতিকে তিনি এমন একটি মৃত্যু (death-trap) বলেছেন যা মানুষের আম্মাকে (soul) হ্যা করে।
বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের আচরণের সংকীর্ণ ধর্মবিশ্বাসকে প্রায় শেষে দেখা যা নেতারা নিজেদের ধর্মীর গতিতে আনা রেখে রাজনৈতিক উঠে আ গুরুদুয়ার, গীর্জা প্রভৃতি ধর্মস্থানগুলিতে ধর্মীয় আলোচনার পাশাপাশি রাজনীতি বিষয়ক আলোচনাও স্থান পাচ্ছে। নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে, এমনকি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিচারবিবেচনাকে প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। এককথায়, ভারতবর্ষে ধর্মকে রাজনীতি থেকে স্বপ্ন না করে ধর্মকে নিয়েই রাজনীতি করা হয়।
এই সমস্ত দুর্বলতা থাকলেও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার এমন কতকগুলি বিশেষ দিক আছে যা নিঃসন্দেহে অভিনব।