‘সহজ’ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো যা মানুষের স্বভাবের অনুকূল, আর যা প্রতিকূল তা বক্র। এ অর্থে মনুষ্য-স্বভাবকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করে বরং স্বভাবের অনুকূল পথে আত্মোপলব্ধির চেষ্টা করাই সহজিয়ামতের লক্ষ্য। সহজিয়াদের বিশ্বাস, সাধনার যিনি লক্ষ্য তিনি জ্ঞানস্বরূপ; তাঁর অবস্থান দেহের মধ্যে, দেহের বাইরে নয়। সুতরাং দেহকে বাদ দিয়ে তাঁকে পাওয়া যায় না। তাঁকে যুক্তিতর্ক বা গ্রন্থপাঠেও জানা যায় না, জানা যায় কেবল গুরূপদেশ ও সহজ-সাধনায়। তাই সহজ-সাধনায় দেহের গুরুত্ব অনেক। দেহকে ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড মনে করা হয়। দৈহিক সাধনা বা পরকীয়া প্রেমের মধ্য দিয়েই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায় এটাই সহজিয়ামতের মূল কথা। সহজিয়াদের এই মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে যে ধর্মমত গড়ে উঠেছে তাই সহজিয়া ধর্ম। আর এই ধর্মমত প্রচারের উদ্দেশ্যে যে বিশাল সাহিত্য রচিত হয়েছে তা সহজিয়া সাহিত্য নামে পরিচিত।
বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদ সহযান নামে পরিচিত। বজ্রযানী বৌদ্ধদের মধ্যে মন্ত্র-তন্ত্র, পূজার্চনা, ব্রত-নিয়ম, শাস্ত্রপাঠ ইত্যাদির প্রাবল্য দেখা দিলে তাদেরই একটি অংশ উপলব্ধি করে যে, এসব শাস্ত্রাচার পালন নিরর্থক; প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বোধি বা বুদ্ধ আছেন এবং কেবল সহজ-সাধনায় তাঁকে উপলব্ধি করতে পারলেই মোক্ষলাভ করা যায়। এভাবেই পাল রাজাদের আমলে বাংলায় বৌদ্ধ সহজিয়া মতের উদ্ভব হয়। যা মানুষের মধ্যে শাশ্বত স্বরূপের উপলব্ধি আনে, তার মাধ্যমে জগতের প্রাণিকুল ও বস্ত্তনিচয়কে অনুভব করার দর্শনই বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মমতের অন্তর্নিহিত সত্য। এই উপলব্ধি মনুষ্য-স্বভাবকে সহজে চেনা এবং বিষয়বুদ্ধি পরিহারে অনুপ্রেরণা জোগায়। বৌদ্ধগান বা চর্যাপদের পদকর্তা লুইপা, ভুসুকুপা, সরহপা, শান্তিপা, শবরপা প্রমুখ সিদ্ধাচার্য সহজিয়া ধর্মমতে দীক্ষিত ছিলেন। এঁদের অধিকাংশই বাংলা, মিথিলা, উড়িষ্যা ও কামরূপের অধিবাসী ছিলেন বলে সহজিয়া-সাধনতত্ত্বে পূর্বভারতীয় জীবনাচার প্রাধান্য পায়।
শৈব নাথধর্ম ও তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে চুরাশি সিদ্ধা বা ধর্মগুরুর মধ্যে ভুসুকুপা, কাহ্নপা প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এঁরা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বা সহজিয়া বৌদ্ধধর্মপন্থী হয়ে নিজেদের কুল ও জাতি পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। চর্যাপদে সহজিয়াপন্থীদের সাধনতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের কথা হেঁয়ালির আকারে সন্ধ্যা ভাষায় নানা উপমা-রূপকের মাধ্যমে বিবৃত হয়েছে।
বৃহত্তর অর্থে বৌদ্ধধর্মের যে মহাযান ধর্মমত, তাই পরে বজ্রযান, কালচক্রযান, মন্ত্রযান, সহজযান ইত্যাদি উপবিভাগে বিভক্ত হয়। ধর্মসাধনার ক্ষেত্রে এসব মতবাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও নির্বাণ সম্পর্কে সকলে একমত। সহজিয়া ধর্মসাধনার অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু এবং ভাগ্যচক্রে সংঘটিত পুনর্জন্মের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে নির্বাণ লাভ করা। এমতে যারা দীক্ষিত তারা কতগুলি তান্ত্রিক আচার-আচরণের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে বলে বিশ্বাস করে। এই সাধনতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বৌদ্ধগান ও দোহার পদগুলি রচিত। তাই প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ সহজিয়া মতের পদসংকলন। এগুলিতে সহজযানভিত্তিক তান্ত্রিক যোগসাধনার কথাই ব্যক্ত হয়েছে।
বৌদ্ধ সহজিয়ামতে স্বরূপের উপলব্ধি প্রধানভাবে বিবেচিত। এতে যে চিত্তশুদ্ধির ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, বৌদ্ধগান ও দোহার রচয়িতৃগণও তার ওপরই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ধর্মে বিশ্বাসী সিদ্ধাচার্যগণের ধর্মসাধনা ও মতবাদের ব্যাখ্যাটি হলো: চিত্তকে শুদ্ধ করতে হলে বিষয়াসক্তি ত্যাগ করতে হবে এবং চিত্তকে শূন্যতাবোধে স্থাপন করতে হবে। করুণার সংস্পর্শে চিত্তের নির্বাণ লাভ হয়, তাতে পরিতৃপ্তি আসে এবং পরিতৃপ্ত নির্বাণের মাধ্যমে মহাসুখ লাভ হয়। এই মহাসুখই হলো জীবের মূল লক্ষ্য এবং তাতেই সহজানন্দ অর্থাৎ সহজ স্বরূপকে উপলব্ধির এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ লাভ হয়।
বৌদ্ধশাস্ত্রের পারিভাষিক শব্দ, যেমন শূন্য, ত্রিশরণ, বোধি, তথাগত, জিনরত্ন, দশবল, নির্বাণ ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থী সিদ্ধাচার্যগণ বৌদ্ধদর্শনের ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছেন এবং বিশেষ অনুভবের এই শব্দগুলিকে একটি তাত্ত্বিক সম্পর্কসূত্রে গ্রথিত করেছেন। এছাড়া আছে গুরুবাদের ওপর অপরিমেয় গুরুত্বারোপ। কাহ্নপাদের চলিশ সংখ্যক পদে বলা হয়েছে: ‘গুরু বোবা শিষ্য কালা।’ এর অর্থ গুরু আভাস-ইঙ্গিতে যা বোঝান, শিষ্য তা সহজেই বুঝতে পারে।
সতেরো শতকে বৈষ্ণব সমাজে এবং আঠারো শতকে বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে সহজিয়া ধর্মমতের সম্প্রসারণ ঘটে। বৌদ্ধ সহজিয়াদের মতো বৈষ্ণব ও বাউল সাধকরাও সাধনার এই পথ ধরে জীবনের স্বরূপ উপলব্ধিতে বিশ্বাসী। তাদের উপলব্ধি ও বিশ্বাসের কথা বৈষ্ণবপদ ও বাউলগানে বিধৃত হয়েছে। বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মমত ও সাধন-প্রণালী ব্যাখ্যা করে সংস্কৃত, ও বাংলা ভাষায় অনেক ও তার ভাষ্য, দোহা এবং চর্যাগীতি রচিত হয়েছে। সেগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া সাহিত্য নামে পরিচিত।