বিদ্যাসাগরের চারটি অনুবাদ গ্রন্থের নাম লেখো। বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান সংক্ষেপে লেখো।

বিদ্যাসাগরের অনুবাদমূলক গ্রন্থগুলি হল- কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ থেকে ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪), ভবভূতির ‘উত্তরচরিত’ ও বাল্মীকির রামায়ণের ‘উত্তরকাণ্ড’ অবলম্বনে ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০), ‘ঈশপের ফেবলস্’ অবলম্বনে ‘কথামালা’ ও মার্শম্যানের ‘History of Bengal’ অবলম্বনে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ ও ‘বৈতালি পচ্চীসী’ থেকে ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’।

বাংলা গদ্য প্রথম সুসংহত, সুপরিণত ও ও সহজ গতিময়তায় চলতে শুরু করেছিল বিদ্যাসাগরের হাত। তিনি প্রথম বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী। বাংলা গদ্যকে সুশৃঙ্খল রূপ দিয়ে তিনিই প্রথম যাত্রা শুরু করেছিলেন। এজন্যেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- “বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্য সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলা-নৈপুণ্যের অবতারণা করেন।”

বাক্যকে তিনি প্রয়োজনে সরল ও হ্রস্ব যেমন করেছেন, তেমনি বিষয় অনুসারে গম্ভীরও করেছেন। সেইসঙ্গে তৎসম শব্দ ও ক্রিয়াপদের ব্যবহার লক্ষণীয়-“উজ্জয়িনী নগরে গন্ধর্ব্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারেরা সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন।”

বিধবাবিবাহের প্রবর্তন ও বহুবিবাহ রদের জন্য বিদ্যাসাগরকে কলম ধরতে হয়েছিল। ফলে সমাজসংস্কারমূলক প্রশ্নগুলিতে ভিন্ন গদ্য আমরা দেখি। বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক রচনার মধ্যে রয়েছে-‘বিধবাবিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ ও ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’। প্রশ্নগুলিতে অভ্রান্ত যুক্তি, তথ্যের পর তথ্য ও বিশ্লেষণে নিপুণ ভঙ্গির উপস্থাপন স্মরণীয়।

বিদ্যাসাগরের গল্পের ভাষা পাওয়া যাবে তাঁর ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’ গ্রন্থে। গদ্যের নিজেরও যে গতি আছে তা দেখান এ গ্রন্থে। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য রসিকতা করে এই গ্রন্থগুলি সম্পর্কে লিখেছিলেন-“এইরূপ উচ্চ অঙ্গের রসিকতা বাঙ্গালা ভাষায় অতি অল্পই আছে।”

সাহিত্যিক গদ্য বলতে আমরা যা বুঝি, বিদ্যাসাগরের হাতেই আমরা প্রথম তা পেলাম।

ক্রিয়াপদ, বাক্যগঠন, যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহার বিদ্যাসাগরই প্রথম যথার্থভাবে করলেন। এজন্যেই মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন-“যাহা ছিল না তাহা সৃষ্টি করা যে কত বড়ো প্রতিভার কাজ-‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’র ভাষা তাহারই পরিচয় দিতেছে।” মধ্যযুগীয় যে বাংলা ভাষা, যা বাঙালিকে বৃহৎ সভায় নিয়ে যেতে কোনোদিন পারত না, তা থেকে বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে মুক্তি দিয়েছেন। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“বিদ্যাসাগর গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুশৃঙ্খল, সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন।”

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading