‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ প্রবন্ধে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের যে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের কথা প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন তার পরিচয় দাও।

বিজ্ঞানে সাহিত্য’ প্রবন্ধে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধসমূহ শুধুমাত্র সাহিত্যিক বা দার্শনিক ভাবনার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তাঁর চিন্তাধারা মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই গভীর প্রভাব ফেলেছে। “বিজ্ঞানে সাহিত্য” (Science and Literature) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে যে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন, তা শুধু দুটি ভিন্ন শাখার পরস্পরের সম্পর্কের আলোকে নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও মানবিক উন্নতির কথা ভাবতে গিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করেছে। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের কথা বলেছেন, তা দুইটি ক্ষেত্রের মধ্যে বিভাজন বা বিরোধ নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে একে অপরকে পরিপূরক এবং সমৃদ্ধ করার ধারণা। তিনি দেখিয়েছেন, বিজ্ঞান এবং সাহিত্য একে অপরের প্রতি সমর্থনকারী, একে অপরের অঙ্গ। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং সাহিত্যিক সৃষ্টির মানবিক অনুভূতি, অনুপ্রেরণা ও সৃজনশীলতা—এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।

১. বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মূল তাত্ত্বিক পার্থক্য

প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘সাহিত্য’ শব্দ দুটি কি বোঝাতে চান, তা আলোচনা করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে এই দুটি ক্ষেত্রের মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন।

বিজ্ঞান হলো বিশ্বের প্রকৃতির গতিপথ, ধর্ম, এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনুসন্ধান, যা গবেষণা ও পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান তৈরি করে। এটি বিশ্বের প্রকৃতি এবং মানবজাতির অজানা দিকগুলির প্রতি মানুষের কৌতূহল ও অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ উদ্ভূত। বিজ্ঞান নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করে, যা সুনির্দিষ্ট প্রমাণের মাধ্যমে সত্য আবিষ্কার করতে সাহায্য করে।

অন্যদিকে, সাহিত্য হলো মানুষের অভ্যন্তরীণ ভাবনা, অনুভূতি, মনের গভীরতা, জীবনদর্শন এবং সংস্কৃতির প্রকাশ। সাহিত্য মানুষের মনের স্বপ্ন, আশা, যন্ত্রণা, অনুভূতি, এবং যাপিত জীবনের নানা দিককে প্রতিফলিত করে। এটি চিত্রশিল্পের মতো, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণের প্রয়োজন নেই, বরং মানুষের অনুভূতির গাঢ়তা, কল্পনা, দর্শন এবং সৃজনশীলতা প্রবাহিত হয়।

এখানে রবীন্দ্রনাথ একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব তুলে ধরেছেন, যে বিজ্ঞান ও সাহিত্য পৃথক দুটি দিক হলেও, তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু এক। দুটি ক্ষেত্রই মানবজীবনের অজানা দিকগুলোকে অনুসন্ধান করতে চায়—একটি যুক্তি, পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে, আর অপরটি অনুভূতি, কল্পনা এবং অভ্যন্তরীণ অন্তর্দৃষ্টি থেকে।

২. বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সম্পর্কের মধ্যে সেতু তৈরি

রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, বিজ্ঞান ও সাহিত্য একে অপরকে পরিপূরক। তাঁদের মধ্যে একটি সম্পর্ক শুধু সমান্তরাল নয়, বরং তারা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, পরস্পরের সান্নিধ্যে আরও গভীরতর ধারণা ও অনুভূতি সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানের গাণিতিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি পৃথিবী ও প্রকৃতির নানা গূঢ় দিকের রহস্য উন্মোচন করেছে, কিন্তু সেই রহস্যকে মানবিকভাবে উপলব্ধি ও প্রকাশ করার জন্য সাহিত্যের প্রয়োজন। অন্যদিকে, সাহিত্য মানব অনুভূতির যেসব গভীর দিককে প্রকাশ করে, সেগুলিকে আরও সঠিকভাবে বোঝার জন্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

রবীন্দ্রনাথের মতে, বিজ্ঞান ও সাহিত্য দুটোই মনের অঙ্গ, এবং তাদের একটি গভীর সম্পর্ক থাকতে হবে। সাহিত্য বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত সত্যগুলোকে এমনভাবে মানুষের মনে তুলে ধরতে পারে, যাতে মানুষ তার জীবনে সেই আবিষ্কৃত সত্যগুলোকে কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একমাত্র বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা গবেষণা দিয়ে মানুষের ভেতরের অনুভূতি, শখ, সৃজনশীলতা বা অনুভব বোঝানো সম্ভব নয়। এখানে সাহিত্যের কাজ হলো মানুষের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতাগুলোকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে উদ্ভাবিত নতুন জ্ঞান বা তথ্যকে মানুষের অনুভূতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করে তোলা।

৩. বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও সাহিত্যের সৃজনশীলতা

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বিজ্ঞান প্রকৃতির মধ্যে যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম এবং সম্পর্ক আবিষ্কার করে, সাহিত্য তার মানসিক অনুভূতির মধ্যে মানব জীবনের সুনির্দিষ্টতা খোঁজে।” বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট নিয়মাবলী ও পদ্ধতি রয়েছে, যা পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে পারে। তবে এটি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আংশিকভাবে প্রযোজ্য—যেহেতু সাহিত্যও মানব জীবনের জটিল অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত, এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনেকটা উন্মুক্ত নয়। কিন্তু সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের মধ্যে যে যোগাযোগ বা সম্পর্ক, তা কিছুটা একে অপরের অভ্যন্তরে প্রবাহিত।

রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে একদিকে যেখানে বিজ্ঞানের নিখুঁত পরিমাপ, নিরীক্ষণ এবং প্রমাণের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন, তেমনি সাহিত্যের সৃজনশীলতা এবং স্বাধীনতার মধ্যেও একধরনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রত্যাশা করেন। এখানে, বিজ্ঞান সাহিত্যের সৃজনশীলতা এবং সাহিত্যের অনুভূতি ও মানবিক ভাবনা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত সত্য ও পদ্ধতির মঞ্চে উঠে আসে। তাঁর মতে, সাহিত্য এবং বিজ্ঞান একে অপরের সাহায্যে মানবজীবনের পরিপূর্ণতা এবং সৌন্দর্য খুঁজে বের করতে পারে।

৪. বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকের ভূমিকা: একটি মিলিত দর্শন

রবীন্দ্রনাথের মতে, সাহিত্যিক এবং বিজ্ঞানী দুজনেই মানবজীবনের নানা দিক নিয়ে অনুসন্ধান করে, তবে তাঁদের পদ্ধতি ভিন্ন। বিজ্ঞানী বিশ্বকে যাচাই-বাছাই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বোঝেন, তবে সাহিত্যিক মানুষের মনের গভীরতা, জীবনের নানান দুঃখ, সুখ, স্বপ্ন, এবং আশা-নিরাশার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বকে দেখতে চান। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষ নিজের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনাকে সমাজের সামনে হাজির করে। অন্যদিকে, বিজ্ঞানী তার তত্ত্ব এবং আবিষ্কার মাধ্যমে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করে, যা সবার জন্য একই।

এখানে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, একজন সাহিত্যিকের কাজ শুধু কল্পনা বা মনোভাব প্রকাশ করা নয়, বরং তাকে জীবনের নানা দিক বিশ্লেষণ করে বাস্তবতার সাথে যুক্ত করতে হয়। বিজ্ঞানীও কেবল যুক্তি বা গাণিতিক পদ্ধতিতে কাজ করেন না, তাঁর আবিষ্কারের পেছনে একটি অন্তর্নিহিত মানবিক অনুপ্রেরণা ও দর্শন থাকে—যেটি সাহিত্যিকের অনুভূতির সাথে মিলে যায়। বিজ্ঞানী যখন একটি আবিষ্কার করেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যিক সেই আবিষ্কারের মানবিক বা সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।

৫. বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ঐক্য: সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তন

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য একে অপরকে ছাড়া মানবজীবন পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। বিজ্ঞান আমাদের জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে, এবং সাহিত্য আমাদের জীবনের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক এবং আধ্যাত্মিক গভীরতাকে উপলব্ধি করতে। একদিকে বিজ্ঞান যেভাবে মানবসভ্যতার উন্নতি ঘটিয়েছে, তেমনি সাহিত্য সমাজের নৈতিক দিকগুলোকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ঐক্য সমাজের বিবর্তন ও সংস্কৃতির উন্নতির জন্য অত্যন্ত জরুরি। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “বিজ্ঞান জ্ঞান দেয়, সাহিত্যের মাধ্যমে সেই জ্ঞানের অনুভূতি সৃষ্টি হয়।” সমাজের উন্নতি এবং মানুষের মুক্তি কেবল তখনই সম্ভব, যখন এই দুইয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হবে। একদিকে বিজ্ঞান মানবজাতির শারীরিক উন্নতির কাজ করে, অন্যদিকে সাহিত্য মানুষের আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করে। এই দুই ক্ষেত্র একে অপরকে পরিপূরক, সহায়ক এবং প্রয়োজনীয়।

উপসংহার

‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞানের প্রজ্ঞা এবং সাহিত্যের সৃজনশীলতার মধ্যে যে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক তুলে ধরেছেন, তা আজও আমাদের কাছে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। তিনি দেখিয়েছেন যে, বিজ্ঞান এবং সাহিত্য দুইটি ভিন্ন ক্ষেত্র হলেও একে অপরের পরিপূরক। বিজ্ঞান প্রকৃতির নিখুঁত নিয়ম অনুসন্ধান করতে চায়, সাহিত্যের কাজ তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুভূতির সৃজনশীল প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বমানবের উন্নতির পথে একটি সুস্পষ্ট দিশা, যেখানে বিজ্ঞান এবং সাহিত্য মিলেমিশে মানবজীবনকে সমৃদ্ধ করবে।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading