বাবরের আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে একটি নোট লেখ (Write a note on the political condition of India on the eve of Babur’s invasion)

বাবরের আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা:

বাবরের আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থাকে বিসমার্কের পূর্বে জার্মানীর একগুচ্ছ স্বাধীন রাষ্ট্রের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। মুঘল আক্রমণের প্রাক্কালে ভারত পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। দেশে তখন কোন সার্বভৌম রাজশক্তি ছিল না। সার্বভৌম শক্তি অধিকারের জন্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে এক অবিরাম সংগ্রামে লিপ্ত ছিল; তার ফলে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে বিদেশী শক্তিকে প্রতিহত করার রাজনৈতিক কোন দৃষ্টিশক্তিও তাদের ছিল না। একজন বিদেশী আক্রমণকারীর কাছে একটা নতুন দেশের জমি দখল করার যে অনুকূল পরিস্থিতির প্রয়োজন, বাবরের সমকালীন ভারতবর্ষে তা সবই ছিল |

ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনও সুসংহত শক্তিরূপে গড়ে ওঠেনি। এখানে রাষ্ট্রশক্তির যথার্থ বিকাশ সম্ভব হয়নি; কারণ, এদেশে শাসকের মৃত্যুর পর রাজত্বের উত্তরাধিকার নিয়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাত অনিবার্য ছিল। যদি কোন রাজকুমার সিংহাসনের সকল দাবি-দাওয়া নিয়ে এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তরবারির সাহায্যে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হতেন, তো ঠিক ছিল; নতুবা সাম্রাজ্যের বিচ্ছিন্নতা অবশ্যম্ভাবী ছিল। প্রকৃতপক্ষে দিল্লী সুলতানি রাষ্ট্র এমন কি রাজপুত রাজ্যগুলির পশ্চাতেও ভারতের জনগণের সমর্থন ছিল না। জাতীয় রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণা ভারতে কখনও বিকাশলাভ করেনি। হুণ আক্রমণের পর থেকে সে ধারণা ও ঐতিহ্য সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয় এবং সামরিক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই ভারতের ইতিহাসে শাসনব্যবস্থার মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইওরোপে সামন্ততন্ত্র রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষায় এবং প্রাথমিক পর্বের জাতীয়তাবাদ গঠনে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, ভারতে সামন্ততন্ত্র তা করতে ব্যর্থ হয়; অর্থাৎ তার নেতিবাচক ভূমিকাটাই প্রধান ছিল। সামন্ততন্ত্র আক্ষরিক অর্থে ভারতবর্ষে কোনদিনই ঠিকমত গড়ে ওঠেনি। যদিও এখানকার অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষি ও ভূমিনির্ভর। তার ফলে এখানে যুগ যুগ ধরে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি, অর্থাৎ সেই উপযুক্ত শোষণ, অত্যাচার ও ধর্মপীড়ন ছিল, কিন্তু সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক দিকগুলি ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এই ইতিবাচক দিকগুলির প্রধান দিক হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা; ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষা, সঞ্চয় ও ভোগাধিকার নিশ্চিত থাকলে মানুষ কাজ করতে উৎসাহী হয়, সম্পদের সৃষ্টি করে এবং দেশে উৎপাদন-মনস্কতা গড়ে ওঠে। ভারতবর্ষে এগুলির সবই অভাব ছিল এবং তার জন্যই ভারতীয় চরিত্র ছিল একান্তই কর্মবিমুখ ও নৈরাশ্যবাদী। এজন্যই ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইওরোপীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়নি এবং জনসাধারণ এই রাষ্ট্রকে নিজেদের রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করতে পারেনি। বাবরের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে এগুলির সবই ধরা পড়েছিল। বাবর তাঁর ‘আত্মজীবনী’তে ভারতের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার কথা উল্লেখ করতে ভুলে যাননি।

দিল্লী সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক নতুনত্বের ছাপ থাকলেও, যথার্থ সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে না ওঠার ফলে সুলতান ও সামরিক অভিজাত গোষ্ঠীর হাতেই কেন্দ্রীয় ক্ষমতার মূল শাসনদণ্ড ছিল। কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র শাসন-ক্ষমতায় সর্বেসর্বা ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ মুসলমান শাসনকর্তা অথবা হিন্দু অভিজাতগণ। এঁরা সুলতানকে বাৎসরিক রাজস্ব ও উপঢৌকন পাঠিয়ে সন্তুষ্ট রাখতেন এবং তার বিনিময়ে তাঁরা নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি জনসাধারণের কোন সমর্থন ছিল না বললেই চলে। প্রকৃতপক্ষে তৈমুরলঙ্গের আক্রমণের আঘাতেই দিল্লী সুলতানি রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে এবং তার ফলে এক গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তৈমুরের বিধ্বংসীকর আক্রমণে ভারতবর্ষের যে ক্ষতি হয়েছিল, তা পরবর্তী একশো পঁচিশ বছরের অব্যবস্থিত ও দুর্বল কেন্দ্রীয় শাসনের ফলে পূরণ করা সম্ভব হয়নি এবং প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিবেশে ধ্বসে-পড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোও আর আগের মতো নিখুঁতভাবে জোড়া লাগেনি। সেই কারণেই ভারতের এই অন্তঃসারশূন্য রাজনৈতিক অবস্থা বাবরের আঘাতে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। তৈমূরের আক্রমণের ফলেই ভারতে এক পুরাতন

সাম্রাজ্যের বিপদ ঘটে এবং অপর এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হয়। প্রোজেরের আক্রমণের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতীয় রাজ্যগুলির রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল সেটা পর্যালোচনা করলে, ভারতীয় পরিস্থিতি বাবরের পক্ষে কতটা অনুকূল ছিল তা সহজেই উপলব্ধি করা যাবে |

Share
error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading