বাংলা ভাষার উদ্ভবের ইতিহাস-
বাংলা ভাষার উদ্ভবের ইতিহাস অত্যন্ত দীর্ঘ ও জটিল। এটি ভারতীয় আর্য ভাষার একটি শাখা এবং সংস্কৃত থেকে বিকশিত হয়েছে। বাংলা ভাষার ইতিহাসের মূল পর্যায়গুলোকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ভাগ করতে পারি।
১. প্রাকৃত যুগ (৩ শতক – ৭ শতক খ্রিস্টাব্দ)
প্রথমে বাংলা ভাষা ভারতের প্রাকৃত ভাষার অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাকৃত ভাষা ছিল আর্য ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ, যা একে অপরের থেকে পৃথক হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। এই যুগে বাংলা ভাষার পূর্বসূরি হিসেবে কিছু আঞ্চলিক ভাষার অস্তিত্ব ছিল, যেগুলোর মধ্যে অঙ্গিকা, বিহারি, মৈথিলি প্রভৃতি প্রভাবিত করেছিল বাংলার ভাষাগত কাঠামো।
২. সংস্কৃত যুগ (৭ শতক – ১২ শতক)
বাংলা ভাষার বিকাশের পরবর্তী পর্যায় ছিল সংস্কৃতের প্রভাব। বাংলা ভাষার আদি শব্দভান্ডার এবং ব্যাকরণিক কাঠামো সংস্কৃত থেকে ধার করা হয়। বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ সরাসরি সংস্কৃত থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও ভাষাগত দিক থেকে বাংলা সংস্কৃত থেকে আলাদা, তবুও সংস্কৃতের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। এ সময়ে বাংলায় প্রথম সাহিত্য রচনার প্রচলন ঘটে, যেমন চর্যাপদ, যা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
৩. মধ্যযুগ (১২ শতক – ১৫ শতক)
মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় আরবি, ফার্সি এবং উর্দুর প্রভাব পড়তে শুরু করে। এই সময়কাল ছিল বাংলা ভাষার বিকাশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আরবি ও ফার্সি শব্দের প্রবেশ ঘটে। বাংলা সাহিত্যের সূচনা হয়, এবং কাব্য এবং গীত রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রূপ আরও সমৃদ্ধ হয়। এর মধ্যে ১৪-১৫ শতকে শ্রীচৈতন্য, কবীর, হযরত শাহ জালাল প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা বাংলা ভাষার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও গীত রচনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৪. আধুনিক যুগ (১৬ শতক – বর্তমান)
বাংলা ভাষার আধুনিক রূপের বিকাশ শুরু হয় ১৬ শতক থেকে। বিশেষ করে ইংরেজি শাসনকালে বাংলা ভাষা ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। ১৮৫৭ সালের পর বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার আবির্ভাব ঘটে, যা বাংলা গদ্য, কাব্য এবং নাটককে আধুনিক করে তোলে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরালাল সেন ও অন্যান্য সাহিত্যিকদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য গঠিত হয়।
উপসংহার
বাংলা ভাষার উদ্ভব একটি দীর্ঘ ও গঠনমূলক প্রক্রিয়া ছিল, যা একদিকে সংস্কৃতের প্রভাব এবং অন্যদিকে আরবি, ফার্সি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণ থেকে নতুন রূপ ধারণ করেছে। বাংলা ভাষার ইতিহাস শুধু ভাষাগত পরিবর্তনই নয়, এটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অমূল্য সম্পদ।