বাংলা ভাষার উদ্ভব=
আগেই বলা হয়েছে, পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে তাদের মূলীভূত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে প্রধানত বারোটি ভাষাবংশে বিভক্ত করা হয়। সেই ভাষাবংশের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ইন্দো-ইউরোপীয় বা মূল আর্য ভাষাবংশ। কারণ, প্রথমত এই ভাষাবংশ-থেকে-জাত আধুনিক ভাষাগুলি পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষত ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ স্থানে প্রচলিত আছে। দ্বিতীয়, শুধু ভৌগোলিক বিস্তারে নয়, এই ভাষাবংশ-থেকে-জাত প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাগুলি সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে মোট দশটি শাখার জন্ম হয়। এই শাখাগুলির মধ্যে শুধু ইন্দো-ইরানীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘আর্য’ নামে অভিহিত করত বলে, অনেকে শুধু ইন্দো-ইরানীয় শাখাটিকে সঙ্কীর্ণ অর্থে আর্য শাখা বলে থাকেন। যদিও ব্যাপক অর্থে সমগ্র ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশকেই আর্য ভাষাবংশ বলা হয়।
ইন্দো-ইরানীয় শাখাটি দুটি উপশাখায় বিভক্ত হয়ে যায়- ইরানীয় ও ভারতীয় আর্য। ইরানীয় উপশাখাটি ইরান-পারস্যে চলে যায়। আর, ভারতীয় আর্য উপশাখাটি ভারতে প্রবেশ করে আনুমানিক ১৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের বিস্তৃতিকে ধারণ করে আছে এই আর্যভাষা।
প্রাচীন ভারতীয়, মধ্যভারতীয় স্তর পেরিয়ে আর্যভাষা উপনীত হয় তৃতীয় স্তর বা নব্যভারতীয় আর্যভাষায়। সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ঠের পরে এই ভাষা তৃতীয় স্তরে এসে একাধিক নব্যভারতীয় আর্যভাষার জন্ম দিল। যেমন- পৈশাচী অপভ্রংশ-অবহট্ট থেকে পাঞ্জাবী, মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহট্ট থেকে মারাঠী, শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ট থেকে হিন্দি, অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ট থেকে অবধী, মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে বাংলা ইত্যাদি ভাষার জন্ম হল।
অনেকেই মনে করেন, সংস্কৃত থেকেই বাংলা তথা ভারতের অন্যান্য আধুনিক ভাষাগুলির জন্ম। কিন্তু এই অনুমান ভ্রান্ত। কারণ, সংস্কৃত ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্যবংশের ভাষা। কিন্তু ভারতে আর্য-পূর্ব অস্ট্রিক, দ্রাবিড় বংশের ভাষা যেমন, তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম ইত্যাদি কখনোই সংস্কৃত-জাত নয়। দ্বিতীয়ত: পাঞ্জাবী, মারাঠী, হিন্দী, অবধী, বাংলা ইত্যাদি যেসব আধুনিক ভারতীয় ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্য ভাষাবংশ থেকে জাত, সেগুলোর জন্মও ঠিক সংস্কৃত থেকে হয়নি।
সূক্ষ্ম বিচারে সংস্কৃত হল বৈদিকের পরবর্তী একটি সাহিত্যিক ভাষা- যা পরে মৃত ভাষায় পরিণত হয়। ফলে, জীবন্ত ভাষার মতো তার কোনো বিবর্তন হয়নি এবং তা থেকে কোনো ভাষার জন্ম হয়নি। বস্তুত, বৈদিক ভাষাই ছিল জীবন্ত ভাষা। এরই কথ্যরূপ নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা-সহ অন্যান্য নব্যভারতীয় আর্যভাষাগুলির জন্ম দিয়েছে। কাজেই, নব্যভারতীয় আর্যভাষাগুলির অব্যবহিত জন্ম-উৎস হল বৈদিক ভাষার কথ্যরূপ-থেকে-জাত মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার শেষ স্তর বিভিন্ন অপভ্রংশ-অবহট্ট ভাষা।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের প্রাচীন স্তর থেকে নানা পর্যায় পেরিয়ে কীভাবে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে, তা একটি ছকের সাহায্যে দেখানো হলো।
পূর্বোক্ত বৃক্ষচিত্রটি বিশ্লেষণ করলে আমরা পৃথিবীর মোট বারোটি ভাষাবংশের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভবের ধারাটি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারব।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের মোট দশটি শাখা। সেগুলি হল- ইন্দো-ইরানীয়, বাল্টো-স্লাভিক, আলবানীয়, আর্মেনীয়, গ্রীক, ইটালিক, টিউটনিক, কেলটিক, তোখারীয় এবং হিত্তীয়। ইন্দো-ইরানীয় ভাষাবংশ থেকে উদ্ভুত হয়েছে তিনটি আর্যভাষা- (ক) ইরানীয় আর্য, (খ) দরদীয় আর্য এবং (গ) প্রাচীন ভারতীয় আর্য। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার দুইটি রূপ-কথ্য এবং সাহিত্যিক। বৈদিক ভাষাগুলি হল সাহিত্যিক রূপের অন্তর্গত। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার কথ্যরূপের শাখাটি আবার চারভাগে বিভক্ত। সেগুলি হল-প্রাচ্য, উদীচ্য, মধ্যদেশীয় এবং দাক্ষিণাত্য। এগুলির মধ্যে প্রাচ্য শাখাটি আবার প্রাচ্যমধ্যা এবং প্রাচ্যা এই দুই শাখায় বিভক্ত। প্রাচ্যা শাখার মাগধী প্রাকৃত থেকে উদ্ভব ঘটেছে মাগধী অপভ্রংশ এবং অবহট্ঠের। মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠের দুটি শাখা-পশ্চিমা এবং পূর্বী। এই পূর্বী শাখাটি আবার দুই ভাগে বিভক্ত-বঙ্গ-অসমিয়া এবং ওড়িয়া। বঙ্গ-অসমিয়া শাখাটি থেকেই বাংলা এবং অসমিয়া ভাষার উদ্ভব।