বাংলা প্রধান তিন ছন্দের পার্থক্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা করো।

বাংলা প্রধান তিন ছন্দের পার্থক্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা

 বাংলা কবিতায় প্রধান তিনটি ছন্দ হলো অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, এবং তালবদ্ধ ছন্দ। এই তিনটি ছন্দের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, যা কবিতার গঠন, rhythm (গতি), এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়। এই তিনটি ছন্দের পার্থক্য এবং তাদের উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

১. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ (Aksharvriddh

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতার এক পুরনো এবং জনপ্রিয় ছন্দ। এতে প্রতিটি পংক্তিতে নির্দিষ্ট সংখ্যা অক্ষর থাকে এবং সেই অক্ষরগুলো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে বা ধ্বনি মিলের ভিত্তিতে সাজানো হয়। এই ছন্দে পংক্তির মধ্যে উচ্চারণের ধারাবাহিকতা এবং সুরের গঠন গুরুত্বপূর্ণ।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য:

  • এখানে প্রতিটি পংক্তিতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক অক্ষর থাকে। এটি সাধারণত ৮, ১০, ১২, ১৪, বা ১৬ অক্ষরের পংক্তি হতে পারে।
  • শব্দের ধ্বনির মিল এবং দীর্ঘ/সংক্ষিপ্ত অক্ষরের পরিমাপ অনুসরণ করা হয়।

উদাহরণ: “পৃথিবীটা ভালোবাসে সবারে,
মাঝে মাঝে কেউ ভাবে নিরাশায়।”

এখানে প্রতিটি লাইন ১০ অক্ষরের, এবং মিলের মাধ্যমে ছন্দের গঠন হয়েছে।

২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ (Maatrabritti):

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে শব্দের মাত্রার পরিমাপ অনুসরণ করা হয়। এখানে প্রতি পংক্তিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে, এবং সেই মাত্রার সঙ্গে সুরের সমন্বয় তৈরি হয়। সাধারণত এই ছন্দে দুটি ধরনের মাত্রা থাকে— দীর্ঘ (অর্থাৎ, দুটি অক্ষর) এবং সংক্ষিপ্ত (একটি অক্ষর)। ছন্দের গঠন প্রক্রিয়া, দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত একে অপরের সঙ্গে বৈসাদৃশ্য তৈরি করে এবং কবিতার rhythm তৈরি হয়।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য:

  • প্রতিটি পংক্তিতে নির্দিষ্ট মাত্রার সংখ্যা থাকে, যা সাধারণত ৪ বা ৬।
  • প্রতি পংক্তির মধ্যে দীর্ঘ এবং সংক্ষিপ্ত অক্ষরের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে।

উদাহরণ: “পড়ার মাঝে দুষ্টুমি করো,
একে তুই কি মন দিয়ে পড়ো।”

এখানে প্রতি লাইনে ৪টি মাত্রার পরিমাপ আছে। প্রতিটি শব্দের মধ্যে মাপের ভিত্তিতে দীর্ঘ এবং সংক্ষিপ্ত আওয়াজের সমন্বয় করা হয়।

৩. তালবদ্ধ ছন্দ (Taalbaddha):

তালবদ্ধ ছন্দ বাংলা কবিতায় এক প্রকার নিয়মিত ছন্দ, যেখানে নির্দিষ্ট একটি তাল (rhythm) অনুসরণ করা হয়। এই তাল ছন্দে সাধারণত উচ্চারণের ধরন, শব্দের গতি এবং তার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে কবিতার rhythm তৈরি হয়। তালবদ্ধ ছন্দে গঠিত পংক্তিগুলি একটি বিশেষ rhythm বা গতি তৈরি করে যা শোনার সময় সুন্দর এবং সংগীতের মতো শোনায়।

তালবদ্ধ ছন্দের বৈশিষ্ট্য:

  • এতে একটি নির্দিষ্ট তাল বা rhythm থাকে, যা কবিতার মূল গঠনকে চিহ্নিত করে।
  • এতে সাধারণত কিছু ধ্বনি বা শব্দের পুনরাবৃত্তি ঘটে, যা পাঠক বা শ্রোতাকে এক ধরনের musical বা গান্দ্রবগান অনুভূতি দেয়।

উদাহরণ: “এখন থেকে আগুনে পুড়তে হবে,
রাস্তায় যাবো গিয়ে যা হবে।”

এখানে “যাবে” এবং “হবে” শব্দের পুনরাবৃত্তি এবং নির্দিষ্ট rhythm পালনের মাধ্যমে একটি তালবদ্ধ ছন্দ তৈরি হয়েছে।

তিনটি ছন্দের মধ্যে পার্থক্য:

ছন্দের নামবৈশিষ্ট্যউদাহরণ
অক্ষরবৃত্ত ছন্দপংক্তিতে নির্দিষ্ট অক্ষরের সংখ্যা থাকে।“পৃথিবীটা ভালোবাসে সবারে, মাঝে মাঝে কেউ ভাবে নিরাশায়।”
মাত্রাবৃত্ত ছন্দপ্রতিটি পংক্তির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পরিমাপ থাকে, যেখানে দীর্ঘ এবং সংক্ষিপ্ত অক্ষরের পরিমাপ করা হয়।“পড়ার মাঝে দুষ্টুমি করো, একে তুই কি মন দিয়ে পড়ো।”
তালবদ্ধ ছন্দনির্দিষ্ট rhythm বা তাল অনুসরণ করা হয়।“এখন থেকে আগুনে পুড়তে হবে, রাস্তায় যাবো গিয়ে যা হবে।”

উপসংহার:

এই তিনটি ছন্দ বাংলা কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং প্রতিটি ছন্দের নিজস্ব বিশেষত্ব রয়েছে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নির্দিষ্ট সংখ্যক অক্ষরের পরিমাপের মাধ্যমে কবিতার গঠন তৈরি করে, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ শব্দের মাত্রার ভিন্নতা দ্বারা rhythm তৈরি করে, এবং তালবদ্ধ ছন্দ শব্দের পুনরাবৃত্তি ও rhythm-এর মাধ্যমে কবিতার গতি সৃষ্টি করে। ছন্দের ব্যবহারে কবির মনের অভিব্যক্তি, কবিতার সৌন্দর্য এবং পাঠকের উপর এর প্রভাব অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।

Share
Scroll to Top

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading