বাংলা নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হয়েও নাট্যকার রূপে জনগণমন হরণে সক্ষম হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (সংক্ষেপে ডি. এল. রায়)। কৃষ্ণনগরে ১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে জুলাই তার জন্ম হয়। পিতা ছিলেন সুবিখ্যাত আত্মচরিত রচয়িতা এবং বঙ্কিম প্রমুখ বহু গুণীজন-সুহৃৎ দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়। কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালের বাংলা নাটকের আসরে প্রবেশ মুহূর্ত কিছুটা বিলম্বিত। গিরিশ-প্রতিভা তখন মধ্যগগনে। আবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এমনকি, অমৃতলাল বসু ও ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ পর্যন্ত নাট্যকাররূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বভাবতই দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভা। আপন গুণের অভিনবত্বে এইসব ব্যক্তিত্বের সমকক্ষ হওয়ার শক্তি আয়ত্ত করেছিল। কবি এবং নাট্যকারের যুগ্ম ভাবনায় সেই গুণের আত্মপ্রকাশ।
বস্তুত, উনিশ শতকের বাংলাদেশে নব দেখা চেতনার বিকাশে নাটক হয়ে উঠেছিল সর্বোত্তম মাধ্যম। আর দ্বিজেন্দ্রলালের মধ্যে দেখা যায় তার শক্তিশালী প্রকাশ। (নাটক লেখার পূর্বে নাটকপাঠ ও দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা তিনি নিজেই বলেছেন : “বাল্যাবধি আমার কবিতা ও নাটকপাঠে আসক্তি ছিল। বিলাত যাইবার পূর্বে হইতেই অভিনয় ব্যাপারটিতে আমার আসক্তি হয়। বিলাতে যাইয়া বহু রঙ্গমঞ্চে বহু অভিনয় দেখি এবং ক্রমেই অভিনয় ব্যাপারটি আমার কাছে প্রিয়তর হইয়া উঠে। বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমি কলকাতার রঙ্গমঞ্চসমূহে অভিনয় দেখি এবং সেই সময়েই বঙ্গভাষায় লিখিত নাটকগুলির সহিত আমার পরিচয় হয়”।
এই দেশী-বিদেশী নাটক-পাঠ ও অভিনয় দর্শনের (যেমন ‘হেমলতা’, ‘নীলদর্পণ’, ‘সধবার একাদশী’, ‘গ্রন্থকার’, Addison এর Cato এবং Shakespeare এর ‘Julius Caesar’ প্রভৃতি নাটকের কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করে গেছেন) সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রত্যক্ষ জীবনবীক্ষা, সহানুভূতি এবং মানবচরিত্র বিশ্লেষণের নৈপুণ্য।
প্রথমে প্রহসন, তারপরে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক রচনায় দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভা বিকশিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল পরিবেশে নাটকে জাতীয় আন্দোলনের যে প্রকাশ দেখা যায়, দ্বিজেন্দ্রলালের মধ্যেও সেই ভাবোচ্ছ্বাস সঞ্চারিত হয়। ফলে (১) পৌরাণিক নাটকের ধর্ম-নির্ভর পরকাল-চিন্তা নবভাবদীপ্ত ইহলৌকিক চেতনায় রূপান্তরিত হয়। (২) দৈবলীলার পরিবর্তে ইতিহাসাশ্রিত এবং স্বদেশভাবনায় উদ্বুদ্ধ নর-নারীর জীবনচিত্র আঁকা হয়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচনাসমূহ:
দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকগুলিকে প্রধানতঃ চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায় :
• প্রহসন,
• নাট্যকাব্য,
• ঐতিহাসিক নাটক,
• সামাজিক নাটক।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রহসন : ‘এক ঘরে’ (১৮৮৯), ‘সমাজবিভ্রাট বা কল্কি অবতার’ (১৮৯৫), ‘বিরহ’ (১৮৯৭), ‘ত্র্যহস্পর্শ বা সুখী পরিবার’ (১৯০১), ‘প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০২), ‘পুনর্জন্ম’ (১৯১১), ‘আনন্দ-বিদায়’ (১৯১২)।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাট্যকাব্য : (ক) পৌরাণিক- ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা’ (১৯০৮), ‘ভীষ্ম’ (১৯১৪)। (খ) ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক নাট্যকাব্য- ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩), ‘সোরাব রুস্তম’ (১৯০৮)।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক : ‘রাণা প্রতাপসিংহ’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬), ‘নূরজাহান’ (১৯০৮), ‘মেবার-পতন’ (১৯০৮), ‘সাজাহান’ (১৯০৯), ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১), ‘সিংহলবিজয়’ (১৯১৫)।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সামাজিক নাটক : ‘পরপারে’ (১৯১২), ‘বঙ্গনারী’ (১৯১৫)।
প্রহসনকার রূপে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম আবির্ভাব। প্রহসন রচনার কারণ সুরুচিপূর্ণ বিশুদ্ধ হাস্যরসের পরিবেশন। তার নিজের কথায় “প্রথমত প্রহসনগুলির অভিনয় দেখিয়া সেগুলির স্বাভাবিকতা ও সৌন্দর্য্যে মোহিত হইতাম বটে, কিন্তু সেগুলির অশ্লীলতা ও কুরুচি দেখিয়া ব্যথিত হই” (“আমার নাট্য জীবনের আরম্ভ’, পূর্বোক্ত)। তাঁর প্রথম রচনা ‘একঘরে’। ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে বিলেত থেকে দেশে ফেরার পর বিনা প্রায়শ্চিত্তে হিন্দুসমাজ তাঁকে গ্রহণে অসম্মত হয়। সমাজের এই অন্যায় ব্যবহারে ক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়ায় এই রচনা প্রকাশিত হয়। নাট্যকারের মতে, “ইহার ভাষা অন্যায় ক্ষুব্ধ তরবারির বিদ্রোহী ঝনৎকার। ইহার ভাষা পদদলিত ভুজঙ্গমের ক্রুদ্ধ দংশন।” তাঁর পরবর্তী প্রহসন ‘কল্কি অবতার’-এ নব্যহিন্দু, ব্রাহ্ম, রক্ষণশীল, পণ্ডিত ও বিলাত-ফেরত —এই পাঁচটি সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যঙ্গবাণ নিক্ষিপ্ত। নাটকের সংলাপগুলি সমিল গদ্যে লেখা। প্রহসনটি কয়েকটি বিচ্ছিন্ন কৌতুকচিত্রের সমষ্টিমাত্র।
‘বিরহ’ নাটকটি বিশুদ্ধ প্রহসন। এখানে আখ্যান-বিন্যাস যথেষ্ট জটিল। সামাজিক বিদ্রূপ অনেক কম। এর গানগুলি কৌতুকরসে প্লাবিত। নাটকগুলির উৎসর্গপত্রে হাস্যরস ও প্রহসনের প্রকৃতি বিশ্লেষণে নাট্যকারের মুন্সীয়ানার পরিচয় আছেঃ “সব বিষয়ের দুটি দিক আছে। একটি গম্ভীর ও অপরটি লঘু। ‘বিরহ’-এরও তাহা আছে। হাস্যরস দুই প্রকারে উৎপাদন করা যাইতে পারে। এক—সত্যকে প্রভূত পরিমাণে বিকৃত করিয়া, আর এক প্রকৃতিগত অসামঞ্জস্য বর্ণনা করিয়া।” তুলনামূলকভাবে তাঁর ‘ত্র্যহপর্শ’ বা ‘সুখী পরিবার’ প্রহসনটি আখ্যান-পরিকল্পনা বা হাস্যরস কোন দিক থেকেই তেমন সার্থক হয় নি। তবে দুটি হাসির গান—“পারত জন্ম না কেউ বিষ্যুৎবারের বারবেলা” এবং “হতে পার্তাম আমি মস্ত একটা বীর” বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
‘প্রায়শ্চিত্ত’ প্রহসনটি ‘বহুত আচ্ছা’ নামে ক্ল্যাসিক থিয়েটারে অভিনীত হয়। এখানে আছে বিলাৎ-ফেরৎ সমাজের “অর্থলোলুপতা, কৃত্রিমতা ও বিলাসিতার” বিরুদ্ধে বিদ্রূপ বর্ষণ। এই প্রহসন রচনার ন-বছর পরে রচিত হয় ‘পুনর্জন্ম’। এখানে এক কৃপণ, নির্মম ও স্বার্থপর সুদখোরের হাস্যকর পরিণতি দেখানো হয়েছে। নাট্যকার ভূমিকায় জোনাথন সুইফটের কাছে কাহিনীঋণ স্বীকার করেছেন।
‘আনন্দবিদায়’ প্রহসনটিতে রবীন্দ্র-বিরোধিতার এক জুলন্ত স্মৃতিখণ্ড আছে। এটি অতুলকৃষ্ণ মিত্রের ‘নন্দ-বিদায়’ (১৮৮৮) গীতিন্যট্যের প্যারডি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কাব্যে অস্পষ্টতা ও নীতিমূলক প্রবন্ধ রচনা নিয়ে যে মতান্তর ঘটেছিল, তার অশালীন ব্যক্তিগত আক্রমণ দেখা গিয়েছিল এই প্রহসনে। অন্যদিকে এই প্রহসন মঞ্চস্থ হবার মুহূর্তে রবীন্দ্র-ভক্তের দল হট্টগোল করে নাটকটির অভিনয় পণ্ড করে দিয়েছিল। এ সম্পর্কে কৌতুককর বিবরণ দিয়েছেন এক সমালোচকঃ “আনন্দ বিদায়ের অভিনয় ভণ্ডুল করার জন্য রবীন্দ্রানুরাগীরা সদলবলে স্টারে যান, প্রেক্ষাগৃহে বসেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দ্বিতীয় দৃশ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত জুতো খুলে মঞ্চে ছুঁড়ে মারেন, রবীন্দ্রভক্তরা দ্বিজেন্দ্রলালকে তাড়া করেন এবং অভিনয় বন্ধ করে দেন”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক নাটক:
দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যকাব্যগুলির বিষয় পুরাণ এবং ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। তবে পৌরাণিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি স্পষ্টতই ভিন্ন পথের অভিযাত্রী। এই নাটকগুলির বৈশিষ্ট্য : (ক) পুরাণ কাহিনী ইচ্ছামত গ্রহণ বর্জন করে বস্তুবাদী ও সমাজবাদী মনোভঙ্গী অনুযায়ী পুরাণ-চরিত্রগুলিকে আধুনিক রূপদান। (খ) পূর্ববর্তী নাট্যকারদের (যেমন গিরিশচন্দ্র) ভক্তিভাব ও আধ্যাত্মিকতা বর্জন করে চরিত্রগুলির মধ্যে সাধারণ নরনারীর মতো রক্তমাংসের কামনাকে ব্যক্ত করার প্রয়াস। (গ) সংলাপের মধ্যে গীতিময়তা সঞ্চার। (ঘ) পুরাণের ভাবগাম্ভীর্য ও ওজস্বিতা রক্ষার পরিবর্তে রোমান্টিক নাট্যকাব্য লেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ‘অহল্যা’ নাটকটিতে অভিশাপের প্রভাবে অহল্যার পাষাণ হওয়ার কাহিনী পরিত্যক্ত। এখানে অহল্যা কামনাময়ী নারী, ইন্দ্র পরস্ত্রীলুব্ধ লম্পট পুরুষ। ‘‘সীতা’ নাটকটির কাহিনী অংশ ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত এবং বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে আহরিত। এই নাটকের অন্যতম অবদান কাব্যময় সংলাপ। রাম ও সীতার অনেক উক্তি বিচ্ছিন্ন গীতিকবিতা ব’লে ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ‘ভীষ্ম’ নাটকটিও মহাভারতের সর্বাংশে অনুকরণ নয়।
ইতিহাসাশ্রিত নাট্যকাব্যের মধ্যে তারাবাঈ’ উল্লেখযোগ্য। দ্বিজেন্দ্রলালের মোগল রাজপুত সম্পর্ক অবলম্বন করে নাটক লেখার এখানেই সূচনা। ইতিহাসের ধূসর জগতের মধ্যে নাট্যপ্রসঙ্গ অনুসন্ধানের প্রাথমিক প্রয়াসও এখানে সুস্পষ্ট। ‘তারাবাঈ’ নাটক রূপে অবশ্য ততটা সার্থক হয়নি। কিন্তু কাব্যসংলাপ বর্জন করে কাব্যধর্মী গদ্যসংলাপ ব্যবহারের গুরুত্ব নাট্যকার বুঝেছিলেন : “প্রথম Shakespeare-এর অনুকরণে Blank Verse-এ নাটক আরম্ভ করি। তারাবাঈ প্রকাশিত হইবার পরে নবীনচন্দ্র সেন এই মত প্রকাশ করেন যে এ নূতন ধরনের অমিত্রাক্ষর—মাইকেলী ছন্দোমাধুরী ইহাতে নাই—এ অমিত্রাক্ষর চলিবে না। সেই সঙ্গে স্বর্গীয় মাইকেল মধুসূদনের দৈববাণী মনে হইল যে— অমিত্রাক্ষরে নাটক এখন চলিতে পারে না। দীর্ঘ বক্তৃতা অমিত্রাক্ষরে চলে। কিন্তু দ্রুত কথোপকথনে কথা তো গদ্যের মত হইতেই হইবে” (পূর্বোক্ত)।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাট্যরঙ্গ:
দ্বিজেন্দ্রলালের ‘নাট্যরঙ্গ’ জাতীয় নাটক ‘সোরাব রুস্তম’। ফিদৌসির ‘শাহনামা’ গ্রন্থটি এর মূল উৎস। এটি সঙ্গীতবহুল অপেরাধর্মী নাটক। ঐতিহাসিক নাটক রচনার গৌরবময় যুগে নাটকটি লেখা হয়। স্বভাবতই আফ্রিদ চরিত্রে দেশপ্রেমের দিকটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য-প্রতিভা প্রকাশের সর্বোত্তম ক্ষেত্র হল, ঐতিহাসিক নাটক। এই জাতীয় নাটকগুলি ছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সমকালে রচিত। ড. রথীন্দ্রনাথ রায় এর বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে বলেছেনঃ “স্বদেশী আন্দোলনের উন্মাদনায় বাঙালী চিত্তের যে অভিনব জাগরণ হয়েছিল, দ্বিজেন্দ্রলাল তাকে তার ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অতীতকে তিনি যুগজীবনের সমস্যার সঙ্গে সমন্বিত করে নূতন ধরনের ঐতিহাসিক নাটক পরিবেশন করেছেন। (দ্রষ্টব্য : ‘কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’)। স্বদেশী অন্দোলনের ভাবগত প্রেরণা যেমন এইসব ঐতিহাসিক নাটক রচনার মূলে বর্তমান, তেমনি ইতিহাসের তথ্যের সঙ্গে কল্পনার যথাযথ সংমিশ্রণও দেখা যায়। কল্পনার জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রয়াস এবং মুসলিম বিদ্বেষের ছদ্মপ্রচার থেকে তাঁর নাটক একেবারে মুক্ত। ঐতিহাসিক নাটক রচনায় তাঁর অবদান হল, প্রথমত, প্রধানত মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির পরিবর্তে মানব-আচরণ ও ভাগ্যের প্রতি আস্থা স্থাপন। তৃতীয়ত, জাতীয়তাবোধের বিকাশের পূর্বে জাতীয় চরিত্র পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন উপলব্ধি। চতুর্থত, মনুষ্যত্বের আদর্শকে সর্বোত্তম ব’লে স্বীকৃতিদান।
মোগল এবং রাজপুত, এই দুই বীর জাতিকে কেন্দ্র করে দ্বিজেন্দ্রলাল ইতিহাস-নির্ভর নাটক লিখেছেন। ‘দুর্গাদাস’, ‘রাণা প্রতাপসিংহ’, ‘মেবারপতন’ নাটকগুলিতে রাজপুতদের বীরত্ব, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের পরিচয় পরিস্ফুট। ‘দুর্গাদাস’ এবং ‘মেবারপতন’ নাটকের উৎস, টডের গ্রন্থ। তবে এখানে যথাযথ ঐতিহাসিক আনুগত্য সর্বত্র লক্ষিত হয় না। ঘটনার আতিশয্য ও বিছিন্ন দৃশ্যাবলীর উপস্থাপনায় নাটকীয় ঐক্য ব্যাহত হয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবোধের বাণী আবেগময়তায় মন্থর : “হিন্দু-মুসলমান একবার জাতিদ্বেষ ভুলে পরস্পর পরস্পরকে ভাই বলে আলিঙ্গন করুক সেদিন হিমালয় হতে কুমারিকা পর্যন্ত এমন এক সাম্রাজ্য স্থাপিত হবে যা সংসারে কেহ কখনও দেখে নাই।” ‘মেবারপতন’ নাটকে রাণা অমরসিংহের কাহিনীটি বিস্তৃত, কিন্তু ইতিহাস এখানে ভাবের ছায়ায় আচ্ছন্ন। ভূমিকায় নাট্যকার বলেছেন : “এই নাটকে আমি একটি মহানীতির আলোচনা করিতে অবতীর্ণ হইয়াছি। এই মহানীতি মনুষ্যত্বের আদর্শবাণী।”
‘নূরজাহান’ এবং ‘সাজাহান’ নাটকদ্বয় যথাক্রমে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং সাজাহানের পরিবারের কলহ ইত্যাদি ঘটনার পটভূমিতে লেখা হয়। প্রথমটিতে ক্ষমতার আকাঙক্ষার সঙ্গে নায়িকা চরিত্রের মনস্তত্ত্ব নিপুণভাবে উদ্ঘাটিত হয়। দ্বিতীয়টি ঔরংজেবকে উপলক্ষ করে বৃদ্ধ পিতা সাজাহানের সম্রাটসত্তা ও পিতৃসত্তার দ্বন্দ্ব-প্রবণ দোলাচলময়তা রূপায়িত হয়। স্নেহের সুধা বা গরলে পূর্ণ সাজাহানের জীবনপাত্র। এই সর্বনাশা স্নেহই ঔরংজেবের বিরুদ্ধে দারার অভিযানে দ্বিধান্বিত হয়েছে, স্বেচ্ছায় বিদ্রোহী পুত্রকে সসৈন্যে দিল্লী প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে এবং পর পর তিনটি পুত্রের হত্যাকারী ঔরংজেবকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করেছে। নাটকের প্রথম অঙ্কেই আছে এই দুর্বলতার বীজ : “সাজাহান। তর্ক করিস না জাহানারা। আমার কোন যুক্তি নাই! আমার কেবল এক যুক্তি আমার কেবল এক যুক্তি আছে। সে স্নেহ” তার এই সর্বনাশা স্নেহই আমাদের মধ্যে যুগপৎ ‘pity and fear’ জাগিয়ে তোলে “সাজাহান। ঈশ্বর! পিতাদের এই বুকভরা স্নেহ দিয়েছিলে কেন? কেন তাদের হৃদয়কে লৌহ দিয়ে গড়নি! – ও!”
সাজাহান আসলে স্নেহ-মমতায় দুর্বল আমাদেরই জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত এক সাধারণ মানুষ। শেকসপিয়রের ‘কিং লীয়ারে’র ছায়া তার উপর থাকতে পারে। তবে ছায়া কায়া পায়নি, সর্বত্র কৃতিত্বসূচক হয়নি তা স্বীকার্য। গ্রীক নাট্যকার সৃষ্ট রাজা অ্যাগামেননের মতো স্নেহের তরঙ্গেই বিক্ষিপ্ত হয় তাঁর হৃদয়। কিন্তু গ্রীসের মর্যাদারক্ষা এবং সন্তানম্নেহের দ্বন্দ্বে এই ধরনের কোন কর্তব্যনিষ্ঠ পিতার বলিষ্ঠ অভিভাষণ তাঁর মধ্যে পাওয়া যাবে না : “What calls for pity, and what not, I know I love my children, else I should be void of reason to dare this is dreadful to me, and not to dare is dreadful. I perforce must do it.” তবু নাট্যকাররূপে দ্বিজেন্দ্রলালের কৃতিত্ব এখানেই যে, অতীত ইতিহাসের প্রায় অপরিচিত একটি চরিত্রের মধ্যে বাঙালী পিতার পুত্রপ্রাণতা, স্নেহমমতার দুর্বলতাসহ জীবনের বিড়াম্বনাকে সুপরিচিত অভিজ্ঞতায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। শেকসপিরীয় ট্র্যাজেডি রীতির অনুসরণে নাটকটি সার্থক শিল্পসৃষ্টি। জনপ্রিয়তা এবং মঞ্চসাফল্যের দিক থেকেও এই নাটক দ্বিজেন্দ্র প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
প্রাচীন ভারতের হিন্দুযুগ থেকে বিষয় নির্বাচন করেও দ্বিজেন্দ্রলাল দুটি নাটক লিখেছিলেন—‘চন্দ্রগুপ্ত’ এবং ‘সিংহল-বিজয়’। প্রথমটিতে নাটকীয় কথাবস্তু পুরাণ, সংস্কৃত নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’ এবং গ্রীসীয় ইতিহাস অবলম্বনে রচিত হয়। তবে উপকরণের অভাবে কাহিনী অনেকটাই হয় কল্পনা-ভিত্তিক। নাটকের কাহিনী চন্দ্রগুপ্তকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও মূল আকর্ষণীয় চরিত্র হল চাণক্য। জনৈক সমালোচকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী –“বিদ্বান, বিচক্ষণ ও কুশাগ্র-বুদ্ধি, এই ব্রাহ্মণ ভাগ্যবিড়ম্বিত ও নিপীড়িত। ভাগ্যবিড়ম্বিত চাণক্য সৌন্দর্য, করুণা ও বিশ্বাসের স্বর্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন। তাই তাঁর চরিত্রে ক্ষমা, সমবেদনা প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি তিরোহিত হয়েছে; তাঁর স্থান অধিকার করেছে জ্বলস্ত প্রতিহিংসা-স্পৃহা ও নির্মম অবিশ্বাস।” চাণক্যের বক্তব্য হল “যখন ছুরি শানাচ্ছ তখন মুখে হাসতে হবে, যখন পানীয়ে বিষ মেশাচ্ছ তখন আলাপে মোহিত করতে হবে। এরই নাম চাণক্যের রাজনীতি।” নাটকের শেষে দস্যু কর্তৃক অপহৃতা কন্যা আত্রেয়ীকে ফিরে পাবার পর এই চাণক্যের পরিবর্তন-দৃশ্য বাংলা নাট্যসাহিত্যে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে; যেমন : “কাত্যায়ন! শোন কুঞ্জবনে একটা সামস্তোত্র উঠছে না ? দেখ, ঐ নদী আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে। আকাশ থেকে একটা স্নিগ্ধ সৌরভ হিল্লোল ভেসে আসছে”। এই অংশের “মহাসিন্ধুর ওপার হতে কি সঙ্গীত ভেসে আসে” গানটি আজও সর্বজনপ্রিয় হয়ে আছে। পরবর্তী ‘সিংহল-বিজয়’ নাটকে ইতিহাস-অংশ নগণ্য। ইতিহাস অপেক্ষা ইতিকথা বা পুরাবৃত্তই প্রধান হয়ে উঠেছে।
নাট্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান:
দ্বিজেন্দ্রলালের বাংলা নাটকে অবদান স্মরণে দেখা যায় কিছু নতুন রীতি বৈচিত্র্য। সেইগুলি হলঃ (১) নাটকের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা এবং অলৌকিকতা বর্জন করে আধুনিক জীবনভাবনা প্রকাশ করা। (২) ইউরোপীয় নাট্যরীতির আদর্শে মঞ্চসজ্জার অনুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া। (৩) নাটকীয় সংলাপে স্বগতোক্তি বর্জন করে চরিত্রের একাত্ম ভাষণ (Monologue) প্রচলন করা। ‘নূরজাহান’ নাটক থেকে তিনি এই স্বগতোক্তি বর্জন করেন। (৪) চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব-রূপায়ণে যথোচিত গুরুত্বদান। (৫) হাস্যরস-সৃষ্টিতে বিদূষক জাতীয় চরিত্র-বর্জন করা। (৬) কাব্যময় গদ্যসংলাপ প্রচলন করা।বাংলা নাটকের ধারায় দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক এক অনন্য সংযোজন।