বাংলা নাটকের প্রথম পর্বে একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০)। ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় যাঁরা হাত পাকিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্র অন্যতম। উনিশ শতকের বাংলা নাটকে যে নবজাগরণ, তার
মূল কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র ও মধুসূদন দত্ত। তবে বাংলা নাটকে প্রথম গণজাগরণ নিয়ে এলেন দীনবন্ধু মিত্র। সমালোচক সুশীলকুমার দে’-র মতে, “এ কথা আমরা আজকাল ভুলিয়া যাই যে, মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রের মত দীনবন্ধু সেকালের হইলেও চিরকালের বাঙ্গালী। তাঁহারা যুগসন্ধির সময় যে অভিনব সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহার প্রেরণা ও আদর্শ ইংরেজি সাহিত্য হইতে আসিয়াছিল সত্য, কিন্তু তাহার প্রাণশক্তির মূলে ছিল বাঙালীর নবজাগ্রত জাতীয় চেতনা।”
দীনবন্ধুর নাট্যতালিকায় মধ্যে আমরা পাই-‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০), ‘নবীন তপস্বিনী’ (১৮৬৩), ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭), ‘কমলে কামিনী’ (১৮৭৩)। প্রহসনের মধ্যে রয়েছে- ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬), ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬) ও ‘জামাই বারিক’ (১৮৭২)। দীনবন্ধুর প্রথম নাটক ‘নীলদর্পণ’। প্রথম নাটকে দীনবন্ধু বাংলাদেশের এক বাস্তব সমস্যার দিকে নজর দিলেন। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে বাংলাদেশের কৃষকসমাজ কীভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল, সেই মর্মকাহিনি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। তবে তিনি ছদ্মনামে লেখেন। তবে ‘নীলদর্পণ’ উদ্দেশ্যমূলক নাটক। নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার জানিয়েছেন- “নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অর্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ মুখ সন্দর্শনপূর্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা-কলঙ্ক-তিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার-শ্বেতচন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার সাফল্য ও বিলাতের মুখরক্ষা।” চরিত্র নির্মাণে দীনবন্ধু কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ভদ্র ও ভদ্রতর শ্রেণির চরিত্র নির্মাণ করে বাংলাদেশের জনজীবনের প্রকৃত স্বরূপ তিনি ফুটিয়ে তোলেন। বাংলাদেশের কৃষকসমাজ এই প্রথম নাটকে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠল। দীনবন্ধুর কমেডিমূলক নাটক নবীন তপস্বিনী। রমণীমোহন-তপস্বিনী, বিজয়-কামিনীর কাহিনি ও জলধর-মালতীর মাধ্যমে হাস্যরস সৃজন করেছেন।
উনিশ শতকের সামাজিক সমস্যা নিয়ে দীনবন্ধু প্রহসনে অবতীর্ণ হয়েছেন। উনিশ শতকের ইয়ং বেঙ্গলের জীবন্ত চিত্র নিয়ে ‘সধবার একাদশী’ প্রহসন লিখলেন। ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলের সমস্ত আদর্শের বিসর্জন ঘটেছিল তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই, সে সমাজকে ব্যঙ্গ করতেই দীনবন্ধু এই প্রহসন লিখলেন। নিমচাঁদ, অটলবিহারী, কেনারাম, ঘটিরাম ও রামমাণিক্যের মাধ্যমে সমাজের এক বীভৎস রূপ ফুটিয়ে তোলেন। উনিশ শতকের যে নব্য জমিদার ও বাবু কালচার, তার প্রতিনিধি নিমচাঁদ। শুধুমাত্র নিমচাঁদ চরিত্রের জন্যই এই নাটক উৎকর্ষ লাভ করেছে। সমালোচক সুকুমার সেন-এর মতে-“শুধু নিমচাঁদের জন্যই সকল ত্রুটি সত্ত্বেও ‘সধবার একাদশী’ বাঙ্গালার দুই চারিখানি শ্রেষ্ঠ নাট্যগ্রন্থের অন্যতম বলিয়া চিরদিন পরিগণিত হইবে।” দীনবন্ধুর অপর প্রহসন ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’। এ প্রহসনে মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের প্রভাব রেয়েছে। মধুসূদনের ভক্তপ্রসাদের সঙ্গে এ প্রহসনের রাজীবলোচন চরিত্রের সাদৃশ্য দেখা
যায়। উনিশ শতকের কৌলীন্য প্রথাকে ব্যঙ্গ করতেই দীনবন্ধু লিখলেন ‘জামাই বারিক’ প্রহসন। হাস্যরস সঞ্চারে দীনবন্ধুর সার্থক প্রহসন ‘জামাই বারিক’। তাই রামগতি ন্যায়রত্ন লিখেছেন-“কৌলিন্যানুরোধে যাঁহারা ঘরজামাই রাখেন বা ঘরজামাই থাকেন এই পুস্তক পাঠে তাঁহাদের অনেকেরই চৈতন্য হইবার সম্ভাবনা।”
এক সামাজিক সহানুভূতি ও সমাজজীবনের তীব্র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বাংলা নাটকে প্রবেশ করেছিলেন। বাংলা নাটকের যে বাস্তবতা, তা প্রথম দীনবন্ধু মিত্রেরই অবদান। দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ নাটক দিয়েই সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা হয়েছিল। আসলে দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন ডাকবিভাগের কর্মী, ফলে বাংলাদেশের জনজীবন সম্পর্কে প্রবল অভিজ্ঞতালাভ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ফসলই তাঁর নাট্যসাহিত্য। সেইসঙ্গো মিশেছিল হাস্যরস সৃজনের এক প্রবণতা। সেই প্রবণতাই তাঁর নাটকগুলিকে প্রাণদান করেছে। এজন্যই বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন-“অনেক সময়েই তাঁহাকে
টডের ‘রাজস্থানের ইতিহাস’ থেকে মধুসুদন এ নাটকের কাহিনি গ্রহণ করেন। ‘কৃষ্ণকুমারী’ ট্র্যাজেডি নাটক। স্বদেশ রক্ষার জন্য কুমারী কৃষ্ণার আত্মত্যাগ নাটকে বিষাদের সুর বহন করে এনেছে। এই আপাত বিষাদের মধ্যেও মদনিকা, ধনদাসের আপাত রসিকতা ও ছলনা নাটকের গতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। সমালোচক অজিত কুমার ঘোষ এ নাটকের মূল্যায়নে লিখেছেন-“কৃয়কুমারী শুধু মাত্র প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি নহে, ইহা মধুসূদনের নাট্য প্রতিভার প্রধানতম কীর্তি।”
মধুসূদনের দুটি প্রহসন বাংলা নাট্যসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। হাসারস ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের অসংগতি তুলে ধরাই যদি প্রহসনের প্রধান উদ্দেশ্য হয়, তবে মধুসূদনের দুটি প্রহসনকে প্রথম শ্রেণিতে রাখতে হবে। ইয়ং বেঙ্গলের পদস্খলন নিয়ে মধুসুদন লিখলেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসন। উনিশ শতকের যে বাবু কালচার তাকে যেন ব্যঙ্গ করতেই এই প্রহসন লেখা। জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা, নবকুমার, কালীনাথ, মহেশ, বলাইয়ের মধ্য দিয়ে হাস্যরস সৃজন করেছেন নাট্যকার। ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী’ সভার সদস্যদের উদ্দেশ্য হরকামিনীর বক্তব্যে সব প্রকাশ পেয়ে যায়-“মদ মাস খেয়ে ঢলাঢলি কল্লেই কি সভ্য হয়? একেই কি বলে সভ্যতা?” ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে মধুসূদনের লক্ষ্য প্রাচীন সমাজ। লোকাচারসর্বস্ব যে হিন্দুসমাজ, তার গভীরে যে ভণ্ডামি, তা মধুসুদন দেখিয়ে দেন ভক্তপ্রসাদের মাধ্যমে। বাইরে ঈশ্বরবিশ্বাসী ও হিন্দু সমাজের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষায় সদা সচেষ্ট ভক্তপ্রসাদ অন্তরে অন্তরে অর্থলোলুপ ও নারীসন্ত। ভক্তপ্রসাদের এই চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে ফতেমা।