বাংলা নাটকের প্রথম পর্বের নাট্যবিকাশে রামনারায়ণ তর্করত্বের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

মধুসুদন, দীনবন্ধু-পূর্ববর্তী বাংলা নাটকে একজন স্মরণীয় নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন। তখন বাংলা নাটকের প্রস্তুতিপর্ব। সে-পর্বেই রামনারায়ণ সমাজের বাস্তব সমস্যার দিকে যেমন নজর দিয়েছিলেন তেমনি সরস মননের দ্বারা নাটকে এক আপাত হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিলেন। এজন্যই তাঁকে বলা হয় ‘নাটুকে রামনারায়ণ’। কেননা দুঃখ অপেক্ষা হাস্যরসের প্রতি তাঁর বেশি নজর ছিল। এমনকি প্রাচীনপন্থী সমাজে জন্মেও সব সংস্কার ভেঙে দিলেন। এক উদার চেতনা নিয়ে বাংলা নাটককে তিনি এগিয়ে দিলেন। মনে পড়ে, সমালোচক অজিতকুমার ঘোষের কথা-“নাট্যক্ষেত্রে সংস্কারের মুদ্গর লইয়া অবতীর্ণ হইলেন রামনারায়ণ তর্করত্ব। রামনারায়ণের জন্ম ও মানসিক চর্যা গ্রামীনপন্থী রাষ্মণ-পন্ডিত সমাজে, অথচ এই সমাজের বিরুদ্ধেই তিনি মুদ্গর হানিলেন। এটা আপাতদৃষ্টিতে একটু অদ্ভুত ঠেকিতে পায়ে, কিন্তু বিদ্যাসাগরের কথা স্মরণ করিলে বিস্মিত হইবার কিছু নাই।”

রামনারায়ণের নাটকগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-

ক। সামাজিক নাটক: ‘কুলীনকূলসর্বস্ব’ (১৮৫৪),  ‘নবনাটক’ (১৮৫৬), ‘স্বপ্নধন’ (১৮৭৩)।

খ। প্রহসন: ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ (১৮৬৫), ‘উভয়সঙ্কট’, ‘চক্ষুদান’।

গ। পৌরাণিক নাটক ‘বুক্মিণী হরণ’, ‘কংসবধ’ (১৮৭৫)।

ঘ। নাট্যানুবাদ: ‘বেণীসংহার’, ‘রত্নাবলী’, ‘মালতীমাধব’।

রামনারায়ণের প্রথম নাটক ‘কুলীনকূলসর্বস্ব’। প্রথম নাটকেই সামাজিক সমস্যার ওপর জোড় দেন। পূর্বে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথার ফলে বাঙালি নারীর যে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তা তাঁকে আঘাত করেছিল। তবে ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটক উদ্দেশ্যমূলক। নাট্যকার নিজেই জানিয়েছেন-“পুরাকালে বল্লাল ভূপাল, আবহমান প্রচলিত জাতি মর্যাদা মধ্যে স্বকপোলকল্পিত কুলমর্যাদা প্রচার করিয়া যান, তৎপ্রথায় অধুনা বঙ্গস্থলী যেরূপ দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছে, তদ্বিষয়ে কোনো প্রস্তাব লিখিতে আমি নিতান্ত অভিলাষী ছিলাম…” এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার চার বিবাহযোগ্যা কন্যার বিবাহ দিতে না-পারায় যে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, এবং একই সঙ্গে চার কন্যার বিবাহকে কেন্দ্র করে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল তা নাট্যকার দেখিয়েছেন। নাট্যকারের উদ্দেশ্য যেহেতু সমাজ সংশোধন, আর তা করেছেন হাস্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে। ফলে নাটকের চরিত্রগুলি টাইপ চরিত্র হয়ে উঠেছে। এমনকি হাস্যরস সৃজনের জন্য নাট্যকার চরিত্রগুলির নামও কৌতুকপূর্ণ করে তুলেছেন-বিবাহবাতুল, বিবাহবণিক, অভব্যচন্দ্র, অধর্মবুচি ও অনুতাচার্য। লঘু সংলাপে ও পরিবেশগুণে নাটকে এক আপাত মাধুর্য লক্ষ করা যায়, যা হাস্যরস সৃজনে সক্ষম-

“কি বলিব দিদি মোর কপালের গুণ।

                                                             দেখ কপালের গুণ লো কপালের গুণ।।

                                                               নগরে উঠিতে লাগে বাজারে আগুন।

                                                              দিদি বাজারে আগুন লো বাজারে আগুন।।”

কৌলীন্য প্রথার পাশাপাশি বহুবিবাহ প্রথা দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি নারীর জীবনে ট্র্যাজেডি ডেকে এনেছিল। উনিশ শতকেই বিদ্যাসাগর তা রোধের প্রয়াসে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়েছেন। বহুবিবাহকে ব্যঙ্গ করে রামনারায়ণ লেখেন ‘নবনাটক’। এই দুটি নাটক রচনা করেই রামনারায়ণ জনসমাজে যেমন পরিচিত হন, তেমনি আর্থিক পুরস্কার লাভও ঘটেছিল। দুটিই উদ্দেশ্যমূলক নাটক হলেও ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’তে তিনি যতটা সফল হয়েছেন, ‘নবনাটক’-এ তা হতে পারেননি।

সামাজিক নাটকের পাশাপাশি প্রহসন রচনাতেও সমান দক্ষ ছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। যুব মানুষের লাম্পট্য, পরস্ত্রীর প্রতি লালসা, অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া এবং তাকে কেন্দ্র করে নায়কের হাস্যকর শাস্তি নিয়ে ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ নাটকটি রচিত। মূর্খ মুন্সেফ সমাজের করুণ পরিণতি নিয়ে তিনি যে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন, তা সমাজের বুকে এক চাপেটাঘাত। পুরুষের বহুমুখী কামাসক্তকে ব্যঙ্গ করে লেখেন ‘চক্ষুদান’ প্রহসন। উনিশ শতকের বাবুবৃত্তান্তের প্রতিনিধিস্থানীয় পুরুষের বহু নারী না হলে মন উৎফুল্ল হত না। সেই প্রবৃত্তিকে সামনে রেখে রামানারায়ণ এখানে ব্যঙ্গ করেছেন। নিকু বিহারী নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীতে আসক্ত হয়েছিল, কিন্তু স্ত্রী বসুমতী নানা ছলনার মধ্য দিয়ে স্বামীর ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। নাটকের শেষে নিকুঞ্জবিহারী

সব ভুল স্বীকার করে নিয়েছে-“বসুমতি, তুমি আজ কেবল আমাকেই চক্ষুদান দিলে এমন নয়, সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই চক্ষুদান হলো।”

নাট্যগুণের বিচারে রামনারায়ণের নাটকগুলি হয়তো সফল নয়। তবে বাংলা নাটকের প্রথম পর্বে নাট্যসৃষ্টির যে চেষ্টা তিনি শুরু করেছিলেন তা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। বাংলা নাট্যসাহিত্যে তিনিই প্রথম সামাজিক নাটক লেখেন। রামনারায়ণ দুটি নাটকেই উনিশ শতাকের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাই সমালোচক অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন-“সামাজিক সমস্যা লইয়া তিনিই সর্বপ্রথম নাটক লিখিতে আরম্ভ করেন এবং নিজে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হইলেও তাঁহার মতের উদারতা আমাদের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। তাঁহার নাটকে একদিকে যেমন উপমা- অনুপ্রাসবহুল সংস্কৃত শব্দের আধিক্য আছে, অন্যদিকে আবার তেমন ছড়া, প্রবচন ও গ্রাম্য কথোপকথনের মধ্য দিয়ে দেশের নিজস্ব রসধারাও স্ফূর্তি লাভ করিয়াছে।”

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading