বাংলা গদ্যের বিকাশে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের অবদান-
বাংলা গদ্যের বিকাশে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২–১৮১৯) একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথমদিকের গদ্য রচয়িতা এবং প্রাচীন ধ্রুপদী গদ্যের পথিকৃৎ। তাঁর লেখনী বাংলা গদ্যকে একটি সুসংগঠিত রূপ প্রদান করে এবং বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের সূচনা ঘটায়। মৃত্যুঞ্জয়ের সময় বাংলা গদ্যের প্রাথমিক রূপ ছিল অবিচ্ছিন্ন, জটিল ও অগোছালো। তাঁর অবদান এই গদ্যশৈলীর প্রারম্ভিক উন্নয়নে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যুঞ্জয়ের প্রধান অবদান:
১. “বাত্সল্যরস” শৈলীর প্রবর্তন:
মৃত্যুঞ্জয় তাঁর গদ্যরচনায় “বাত্সল্যরস” বা স্নেহ ও মমতার এক বিশেষ ধারা প্রবর্তন করেন। তাঁর লেখায় ভাষার প্রবাহ ছিল সহজ, অথচ মর্যাদাপূর্ণ। এটি বাংলা গদ্যকে একটি নতুন রূপ দেয়, যা পাঠকের সঙ্গে সহজে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম।
২. “হিতোপদেশ” রচনা:
তাঁর বিখ্যাত রচনা “হিতোপদেশ“ বাংলা গদ্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এটি মূলত সংস্কৃত গ্রন্থের ভিত্তিতে রচিত, কিন্তু এতে সহজ-সরল বাংলায় নৈতিক শিক্ষা ও কাহিনি উপস্থাপিত হয়। এটি বাংলা গদ্যের মৌলিক ও প্রাঞ্জল রচনার একটি উদাহরণ।
৩. বাংলা গদ্যের কাঠামো উন্নয়ন:
তৎকালীন বাংলা গদ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অপ্রাঞ্জলতা এবং অগোছালো শব্দচয়ন। মৃত্যুঞ্জয় তাঁর গদ্যরচনায় বাক্যের গঠন, শৃঙ্খলা এবং বোধগম্যতা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বাংলা গদ্যকে আধুনিকতার পথে নিয়ে যায়।
৪. শিক্ষার প্রসার:
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পণ্ডিত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এখানে তিনি বাংলা গদ্য শেখানোর কাজ করতেন। তাঁর শিক্ষাদানের মাধ্যমে অনেক ছাত্র বাংলা গদ্যের সুশৃঙ্খল রচনায় দক্ষতা অর্জন করেন, যা বাংলা ভাষার বিকাশে প্রভাব ফেলে।
৫. পাঠ্যপুস্তক রচনা:
মৃত্যুঞ্জয় বাংলা গদ্যের প্রচলনে পাঠ্যপুস্তক রচনার গুরুত্ব বোঝেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ ভাষায় প্রস্তুত করা হয়েছিল, যা শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলা গদ্যের নবজাগরণে প্রভাব:
মৃত্যুঞ্জয়ের রচনাশৈলী বাংলা গদ্যের নবজাগরণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর লেখনীতে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব ছিল, কিন্তু এটি এতটাই সহজ ও বোধগম্য ছিল যে, সাধারণ মানুষের কাছে তা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
উপসংহার:
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের গদ্যরচনা বাংলা ভাষার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। তাঁর “হিতোপদেশ” এবং অন্যান্য গ্রন্থ বাংলা গদ্যের প্রারম্ভিক বিকাশে মাইলফলকস্বরূপ। সহজ, সংক্ষিপ্ত ও প্রাঞ্জল রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা গদ্যের ভিত মজবুত করেন এবং বাংলা ভাষাকে একটি মর্যাদাপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।