বাংলা কাব্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের অবদান আলোচনা করো।

রবীন্দ্রবৃত্তে থেকে যে তিনজন কবি নতুন সুর শুনিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মোহিতলালের দেহবাদ ও ভোগবাদ, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের দুঃখবাদ ও নজরুলের বিদ্রোহীসত্তা বাংলা কাব্যে নতুন চেতনা নিয়ে এসেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে ইঞ্জিনিয়ার কবি যতীন্দ্রনাথ জীবনকে দেখেছেন নির্মোহ, নির্বাক দৃষ্টিতে। যতীন্দ্রনাথের কাব্যের নামগুলি দেখলেই বোঝা যাবে তিনি কোন্ সুর আরোপ করতে চেয়েছেন কবিতায়। জীবন যেন মরুভূমি। মরুভূমির মধ্যে ক্যাকটাস যেমন লড়াই করে বেঁচে থাকে, এ জীবনও তেমনি। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্য আলোচনা করতে গিয়ে সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন-“কাব্যের বহু প্রচলিত আদর্শবাদ ও সৌন্দর্যবোধকে তিনি সাধারণ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও নিপুণ যুক্তি-শৃঙ্খলার সাহায্যে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করিয়াছিলেন।”

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। কাব্যগুলি হল-‘মরীচিকা’ (১৯২৩), ‘মরুশিখা’ (১৯২৭), ‘মরুমায়া’ (১৯৩০), ‘সায়ম’ (১৯৪০), ‘ত্রিযমা’ (১৯৪৮) ও ‘নিশান্তিকা’ (১৯৫৭)। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যালোচনায় লিখেছেন-“তাঁর ভাষায় বক্তব্যে, উপমা-অলংকার-চিত্রকল্পে এবং সর্বোপরি একটি নিজস্ব দার্শনিকতায় যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রবীন্দ্রযুগের প্রথম বিদ্রোহী কবি।” যতীন্দ্রনাথের নৈরাশ্যবাদ কিন্তু জীবনকে নঞর্থক দিক থেকে বিচারবিশ্লেষণ নয়, জীবনকে গভীরভাবে ভালোবাসার নামান্তর। জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে উচ্চারিত হয়েছে এই পক্তিগুলি।

“জগৎ একটা হেঁয়ালি

যত বা নিয়ম তত অনিয়ম গোঁজামিল খামখেয়ালি।”

যতীন্দ্রনাথ ‘মরীচিকা’ কাব্যের উৎসর্গপত্রে লিখলেন-“দাহন রসের গহন সাধন/উষার তৃষার সজল স্বপন/মরুমর্মের মরীচিকা ধন।” উৎসর্গপত্রের এই পক্তিগুলিই তাঁর কাব্যের সুরকে চিনিয়ে দেয়। শুধু মানবজীবনই নয়, প্রকৃতিও যেন পুড়ে যাচ্ছে। তবে এ প্রকৃতি মানুষ ধ্বংস করেনি। প্রকৃতি আপন খেয়ালেই ধ্বংস হয়ে চলেছে। চারিদিকে বেজে উঠেছে রুদ্রবীণা। ‘ঘুমের ঘোরে’ কবিতায় শুনতে পাই-

“তোমাতে আমাতে বহুদিন হতে হয়নিক কোনো কথা ইদানিং, বন্ধু, পাঁজরে একটা ধরেছে নতুন ব্যথা।”

তিনি প্রকৃতির কবি। নিদারুণ প্রকৃতির রুদ্রবীণা তাঁর কাব্যে অপরূপ রূপ লাভ করে। আবার ব্যঙ্গও করেন। ‘কবির কাব্য’ কবিতায় ব্যঙ্গ করে লেখেন-

“সন্দেহ হয় পেয়েছে বন্ধু, কবির কু-অভ্যাস, যত দুখ পাও মিঠে সুরে গাও দুঃখেরি ইতিহাস; কবির সে দুখগান,”

এ দুঃখ কবি ভুলতে পারেন। জীবনের দুঃখ ভুলতে কবিতা লেখেন। কাব্যবীণায় দুঃখের সুর রূপ পায়। কিন্তু অপমান? কবির পক্ষে অপমান তো ভোলা সম্ভব নয়। তাই গভীর বেদানায় লেখেন-

“দুঃখ দিয়েছ, দিয়েছ বন্ধু। সে নিষ্ঠুরতাও ক্ষমিতে পারি, গভীর দুঃখ যে ভুলাইয়ে দাও এই অপমান সহিতে নারি।”

শশীভূষণ দাশগুপ্ত যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যালোচনায় লিখেছেন-“বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে মানুষকেই সর্বাপেক্ষা বড়ো করিয়া দেখিবার সদাজাগ্রত প্রবৃত্তির অনিবার্য আনুষঙ্গিক রূপেই যতীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখা দিয়াছে আর একটি প্রতিবাদ এবং সমবেদনার সুর-প্রতিবাদ সর্বপ্রকার অবিচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে সমবেদনা অসহায় লাঞ্ছিত এবং শোষিতের জন্য।” যতীন্দ্রনাথ মোহিতলালের মতো শব্দের জটিলতা নয়, আটপৌরে শব্দ প্রয়োগেই কাব্যব্যঞ্জনা ফুটিয়েছেন। তবে গভীর ব্যঞ্জনা নয়, কবিতাগুলিতে সহজ ভাষায় গভীর জীবনের সুষমা ফুটে উঠেছে। আসলে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বেদনা, অসহয়তা-তাকেই তিনি কাব্যরূপ দেবার চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading