প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট সমালোচক এবং প্রাবন্ধিক, যিনি বাংলা সাহিত্য সম্পর্কিত নানা দিক থেকে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর “বর্তমান বাংলা সাহিত্য” প্রবন্ধে তিনি বাংলা সাহিত্যকে উন্নতির পথে এবং নতুন দিশা প্রদর্শনকারী এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রমথ চৌধুরীর এই প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থান এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
এখানে তিনি বর্তমান বাংলা সাহিত্যকে একটি পরিবর্তনশীল এবং বিভিন্ন ধারা ও প্রবণতায় বিভক্ত বলে উল্লেখ করেছেন, এবং এর মধ্যে তিনি সাহিত্যর বিবিধ স্তরের কথা বলেছেন, যেমন কাব্য, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি। তিনি বাংলা সাহিত্যের বর্তমান স্তরকে দেখেন, যা একটি যুগান্তকারী পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে তার সমৃদ্ধি এবং পরিপক্বতা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবে, এটি এখনও সমাজ এবং সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতা অনুসারে এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের বর্তমান লক্ষ্য হিসেবে উন্নতি এবং সমাজের সার্বিক পরিবর্তনকে দেখেছেন। তাঁর মতে, সাহিত্য শুধুমাত্র একটি সৌন্দর্যবোধ নয়, এটি সমাজের প্রতিফলন এবং মনের সঞ্চালক। সাহিত্য এমন একটি মাধ্যম, যা মানবতার সার্বজনীনতা, অন্তর্দৃষ্টি এবং গণমানুষের সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে। তিনি মনে করেন যে, বাংলা সাহিত্যকে তার ঐতিহ্য এবং অতীত থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক সমাজের কথা বলতে হবে।
সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা:
প্রমথ চৌধুরী বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অবস্থা বিশ্লেষণ করে বলেন, এটি বিভিন্ন প্রবণতার মধ্যে বিভক্ত। যেমন, ঐতিহ্যবাদী সাহিত্য এবং আধুনিক সাহিত্য—দু’টি প্রবণতা পাশাপাশি চলতে থাকে। ঐতিহ্যবাদী সাহিত্য তখনকার সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট, যেখানে প্রচলিত ঐতিহ্য, ধর্মীয় দর্শন এবং সমাজের পুরোনো কাঠামোই প্রধান বিষয় ছিল। অন্যদিকে, আধুনিক সাহিত্য সমাজের পরিবর্তনশীল অবস্থা, পশ্চিমী প্রভাব, বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গঠিত।
প্রমথ চৌধুরী বলেন যে, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে সাহিত্যের মধ্যে সমাজের নতুন ভাবনা এবং উন্নত চিন্তা পরিস্ফুটিত হবে। তিনি আরো বলেন, আধুনিক সাহিত্যে রুচির পরিবর্তন এসেছে, এবং সাহিত্য এখন আর শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক প্রশ্ন নয়, এটি মানুষের বাস্তবিক দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা, আবেগ এবং সামাজিক অবস্থা নিয়ে কথা বলছে।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক দিক:
প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের আধুনিক দিকগুলোকে বিশ্লেষণ করে বলেন, নাটক, গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ সব ক্ষেত্রেই তিনি পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। নাটক ও উপন্যাসে যে বিশাল পরিবর্তন এসেছে, তা আধুনিক চিন্তাধারা এবং সমাজের জন্য একটি নতুন উপস্থাপনা। বিশেষত, তিনি উপন্যাসের নতুন ধারা এবং বৈচিত্র্য সম্পর্কে আলোচনা করেন, যেখানে মৌলিকতা এবং অন্তর্দৃষ্টি প্রাধান্য পাচ্ছে।
তিনি মনে করেন, সাহিত্য এখন লোকভাষার কাছে ফিরে আসছে, অর্থাৎ বাঙালির জীবনযাত্রা, দৈনন্দিন কষ্ট এবং প্রত্যাশার সাথে সংযোগ স্থাপন করছে। এই নতুন সাহিত্য সমাজের ঘর-বাড়ি, মানুষের মনের ভাবনাগুলো, তাদের সাধনা এবং অজানা সংকল্পের কথা বলছে। এটা কেবলমাত্র নকশাল আন্দোলন, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বা বিভাজনের কথা নয়, বরং জীবনযাত্রার সত্যিকারের বিশ্লেষণ।
বাঙালি সাহিত্যের সামাজিক দিক:
প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের গুরুত্ব শুধু সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখেননি, বরং তিনি ভাষা এবং সমাজের অনেক স্তরের বিচ্ছেদ দেখেছেন। তিনি সমাজের প্রতি সাহিত্যকের দায়িত্বকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। সাহিত্য সমাজকে দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনোভাবের পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারে। তাঁর মতে, সাহিত্যকে মানুষের আবেগ এবং মানসিক কষ্টের স্তরে পৌঁছাতে হবে, এবং এতে যে মানবিকতা থাকা দরকার, তা কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়।
তিনি বলেছেন, বাংলা সাহিত্যকে গণমানুষের মনের কথা বলতে হবে, কেবলমাত্র প্রজ্ঞা বা রুচিবোধ নয়। জনগণের বাস্তবতার মধ্যে, তাদের অভ্যন্তরীণ কষ্ট এবং আদর্শের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি। এটি যে শুধুমাত্র কাব্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং ভাষার মাধ্যমে এক বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলা, তা স্বামী বিবেকানন্দের মতো অন্যান্য মনীষীদের মতেও চিহ্নিত হয়েছে।
উপসংহার:
প্রমথ চৌধুরীর “বর্তমান বাংলা সাহিত্য” প্রবন্ধে সাহিত্যের বর্তমান অবস্থান এবং তার উদ্দেশ্য অত্যন্ত বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণ এবং সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নিয়ে বিশদভাবে বলেছেন, বাংলা সাহিত্য যেন বিশ্ববোধ, সমাজবোধ এবং মানবিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। সাহিত্যের এই নতুন দিশায় সামাজিক প্রেক্ষাপট, আবেগ এবং আধুনিকতা মিলিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যা সাধারণ জনগণের জীবনের প্রকৃত প্রতিফলন হবে।