বন্দীর বন্দনা কবিতার নামকরণের সার্থকতা

বুদ্ধদেব বসুর ‘কন্দীর বন্দনা’ মূলত প্রেমের কাব্য। ‘বন্দীর বন্দনা’ থেকে চিরন্তন মানবিক চিত্তবৃত্তি প্রেমকে তিনি যেভাবে অবলোকন করেছেন তাকে বুদ্ধদেবের প্রেমভাবনার প্রথম পর্যায় বলা চলে; আর এই অবলোকন চলেছে ‘নতুন পাতা’ (১৯৪০) পর্যন্ত। পরবর্তী পর্যায় ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত ‘দময়ন্তী’ থেকে ‘শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর’ (১৯৫৫) পর্যন্ত। এই পর্বে বুদ্ধদেবের প্রেমচেতনার বৈশিষ্ট্য হল নারীর দেহ কণিকা, প্রেমের মূলপ্রেরণা রূপে যৌনলিপ্সাকে স্বীকৃতি প্রদান। কিন্তু পরিণামী ফলশ্রুতিতে কবি দেহাতীত সুকুমার প্রেমকেই স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষ বাস্তবকে অবলম্বন করে কবির এই যে দেহোত্তীর্ণতা একে রোমান্টিক ইন্দ্রিয়বাদ বলা যেতে পারে। বাংলা কবিতায় নারীর শরীর এবং কামনা-বাসনা যে অনুপস্থিত নয় তার প্রমাণ আছে গোবিন্দচন্দ্র দাস, মোহিতলাল মজুমদার, নজরুল ইসলাম প্রমুখের কবিতায়। বুদ্ধদেব বসুর সমকালীন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অজিত দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রায় সকলের কবিতাতেই নারীর শরীর মুখ্য।

কিন্তু “বুদ্ধদেব সমস্ত বিষয়টিকে একটি নতুনভাবে উপস্থাপিত করেছেন: একদিকে বয়ঃসন্ধিকালের উদ্দাম কামকালিমা, অপরদিকে তা থেকে উত্তরণের অভীপ্সা; একদিকে ‘সহস্র পঙ্গুতা’, ‘ভঙ্গুর হৃদয়’, অপরদিকে দেবতার মতো অপরূপ, ভাস্করের মতো জ্যোর্তিময় কান্তি; একদিকে পঙ্কতিলক, আর একদিকে পঙ্কজের কোল; এক কথায়: একদিকে প্রকৃতি, আরেকদিকে সংস্কৃতি। মানুষের এই নিরন্তর সংঘর্ষ চিরকালের, তবু প্রথম যৌবনোন্মেষ কালে এ যেমন তীব্র আকার ধারণ করে, সে রকম আর কখনো নয়; এই প্রকৃতি বা প্রবৃত্তি… প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট; কিন্তু একে হঠিয়ে যে মানবিকতা তা তো ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছা-চেষ্টা শ্রমের কাম্য। বুদ্ধদেব সেই ব্যক্তি মানুষটিকে জানিয়েছেন সালাম, এখানে সেই শ্রদ্ধাপাত্রটি কবি |

‘বন্দীর বন্দনা’ কাব্যে এমন কতকগুলি শব্দবন্ধ আছে যা কবির দেহবাদী সম্ভোগ সংরক্ষণের পরিচয় যেমন প্রদান করে তেমনি দেহোত্তীর্ণ প্রেমের পরিচয়ও প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি শব্দবন্ধের উল্লেখ করা চলে। যেমন: সলজ্জ বিকাশ, আরক্তিম কামনা, তরুণ রক্তিমা, অসহ্য লজ্জা, শীতল প্রণয়, নিরুদ্ধ বেদনা, সংগোপনে প্রণয়গুঞ্জন, অবরুদ্ধ ক্রন্দন, প্রণয়ের চন্দন কুমকুম, প্রণয়ের সুরাপান, প্রেয়সীর লাজুক কিঙ্কিনী, রৌদ্ররাগদীপ্ত পরিপূর্ণ দেহ, অন্তহীন প্রেমপত্র, বহ্নির চুম্বন রাগ, বিদ্যুৎময় বিরহগৌরব, মূর্তিমতী বেদনা, কুমারীর সুন্দর লজ্জা, রমণীর লীলাচ্ছলে, শৃঙ্গারকামনা, মদিরামত্তা রাত্রির প্রেয়সী, কটাক্ষ ঈক্ষণ, ওষ্ঠাধর, বাহলতিকা স্তনচূড়ার স্পর্শ, ওষ্ঠাধারে প্রবল উত্তাপ, রক্তিম স্তনাভা, মধুরাত্রে রতিক্রীড়া ইত্যাদি।

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের ‘বন্দীর বন্দনা’ কবিতায় প্রথম প্রেমের বাসনার এমন লজ্জাহীন কুণ্ঠাহীন প্রকাশ। বুদ্ধদেব বসুর কাছে প্রেম এক মানবিক চিত্তবৃত্তি এবং কবি তাকে দীর্ঘজীবনব্যাপী দৃষ্টিতে নানা বিচিত্র ভঙ্গিতে অবলোকন করেছেন। তাঁর কাছে মানবিক চিত্তবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ প্রেম; আর সে প্রেমভাবনায় নারীর দেহরূপ প্রশংসনীয় গৌরবে স্বীকৃত। কিন্তু তাঁর প্রেম ভাবনায় দেহবাদী সম্ভোগ সংরাগ প্রাধান্য পেলেও, তাঁর পরিণামী বক্তব্য কিন্তু দেহোত্তীর্ণ সুকুমার প্রেম; ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষীভূত বাস্তবতার কুসুম থেকেই তাঁর দেহাতীত প্রেমের সুরভি বিহার। মানুষের আদিম জৈবকামনার অলজ্জ প্রকাশ ‘বন্দীর বন্দনা’য় যেমন রূপায়িত, তেমনি কামনা থেকে প্রেমে উত্তরণের মন্ত্রধ্বনি তাঁর কাব্যে অনুপস্থিত নয়। আসলে মানুষ তো বিধাতার সৃষ্ট প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে বন্দি; এ যেন নিয়তি-নির্ধারিত যে প্রবৃত্তির ও কামনার কারাগার থেকে মানুষের মুক্তি নেই:

‘প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী করি’ রচেছো আমায় -নির্মম নির্মাতা মম। এ কেবল অকারণ আনন্দ তোমার।

আমি শুষ্ক নিশাচর, অন্ধকার মোর সিংহাসন, আমি হিংস্র, দুরন্ত, পাশব।

সুন্দর ফিরিয়া যায় অপমানে অসহ্য লজ্জায় হেরি মোর রুদ্ধদ্বার, অন্ধকার মন্দির প্রাঙ্গণ।

দৈন্যভরা গৃহ মোর শূন্যতায় করে হাহাকার। যৌবন আমার অভিশাপ।

অবচেতন অন্ধকার কক্ষে যদি থাকে কামনার তপ্ত নাগপাশ তাহলে বহিপ্রকৃতিতে আছে স্নিগ্ধতা ও শাস্তি। তাই বোধ হয় বিহঙ্গের উদাসী কলকণ্ঠ তাঁকে জানায় ‘শাপভ্রষ্টদেব তুমি’। মানুষের আদিম জৈবধর্ম এবং যৌবন-বাসনাকে স্বীকার করেই কবি তাদের অভিশাপ রূপে চিহ্নিত করেন। কেন-না, যৌবনের অগ্নিদাহ, বাসনা-ব্যাকুলতা সৌন্দর্যের সোপান কলঙ্কিত করে; সুন্দরের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে:

অক্ষম দুর্বল আমি নিঃসঙ্গের নীলিমার তলে,

ভঙ্গুর হৃদয়ে মম বিজড়িত সহস্র পঙ্গুতা-

জীবনের দীর্ঘপথে যাত্রা করেছিনু কোন স্বর্ণরেখাদীপ্ত ঊষাকালে

আজ তার নাহিক আভাস।

‘মানুষ’ কবিতার চারটির পর্যায়ের (১, ২, ৩, ৪) প্রথম পর্যায়ে মানুষ কামনা প্রলুব্ধ রতি সম্মোহিত; আর কবি স্বয়ং

প্রলুব্ধ অস্থির

অসাঙ্গ বাসনা পঙ্গু আমি সেই নিলজ্জ কামুক;

সারঙ্গ সঙ্গীত স্বনে শিহরিছে উৎসব-উৎসুক

হেমচ্ছটাবিচ্ছুরিত বাতায়ন প্রতি পণ্য স্ত্রীর।

ওই কবিতার দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বপ্নসঞ্জাত সুন্দরের ব্যাকুল প্রার্থনা কবির বিধাতা শোনেননি। ফলত, তৃতীয় পর্যায়ে ‘অন্ধকার শূন্যগৃহে’ জমে-থাকা বিষণ্ণতারাশি দূরীকরণের জন্য কবিকে নিজ হাতে দীপ জ্বালাতে হয়, যার আলোকে গৃহতল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আর চতুর্থ পর্যায়ে কবির-উপলব্ধ সত্য ‘মানুষ শুধু জীবসৃষ্টি যন্ত্রমাত্র নহে’। কবির মনে হয় ‘এ জীর্ণ পাতার স্পর্শ নারীমাংস চেয়ে সুখকর’। কবি প্রবৃত্তির কারাগারে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বন্দি হয়েও শিল্প সফলতার মহিমাময় সৌন্দর্যের দিক অবলোকন করে বিস্ময়-বিমূঢ় হন: হেরিতেছি একসঙ্গে শত শিল্প, সংগীত কবিতা,

বাসনার বক্ষো মাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,

দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।

রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ উপযোগী শৃঙ্গার কামনা

রমণী রমণ রণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি,-

তাদের মেটাতে হয় বঞ্চনার দুর্দম বিক্ষোভ।

আছে ক্রুর স্বার্থদৃষ্টি, আছে মূঢ় ক্লেদালিপ্ত লোভ

হিরণময় প্রেমপাত্রে হীন হিংসা সর্প গুপ্ত আছে।

কবিচিত্তের ক্ষুধিত যৌবনের ঝড় আর আদিম শৃঙ্গার কামনাজনিত সংকট জিজ্ঞাসা যা উঠে আসে কবির অবচেতনার গভীরতার থেকে আমূল আলোড়িত হয়ে, কবি শেষপর্যন্ত তা থেকে মুক্তি প্রয়াসী। কবি বিশ্বাস করেন, আদিম বাসনার জন্যই কবি স্বয়ং এবং সমগ্র মানবজাতি আকণ্ঠ প্রবৃত্তির পক্ষে নিমজ্জিত; আর এর জন্য দায়ী স্রষ্টা-যিনি মানুষকে বাসনা-কামনার নাগপাশে চিরন্তন বন্দি করে রেখেছেন। আদিম বাসনা-কামনাই ভেঙে দেয় কবির সুন্দরের স্বপ্ন আরাধনা। ‘শাপভ্রষ্ট’ কবিতায় কবি একই অঙ্গে, প্রত্যক্ষ করলেন, প্রভাত সূর্যালোকে ‘কামনার বহ্নি’ যা হল ‘স্বপনের সলজ্জ-বিকাশ’; আর ‘গোলাপের বর্ণে বর্ণে স্বপ্নসুরমাখা আরক্তিম কামনার আলিঙ্গন’। কবি মনে করেছেন, তাঁর অবস্থান ‘গোপন গভীর গর্তে’ এবং তিনি সুন্দরের সঙ্গ বঞ্চিত এক ‘শাপভ্রষ্ট’ সত্তা; কিন্তু শাপভ্রষ্ট হলেও সুন্দর তাঁর প্রার্থিত:

শাপভ্রষ্ট দেব আমি।

আমার নয়ন তাই বন্দী যুগ-বিহঙ্গের মতো

দেহের বন্ধন ছিঁড়ি শূন্যতায় উড়ি যেতে চায়

আকণ্ঠ করিতে পান আকাশের উদার নীলিমা।

যেখানে মঙ্গল শুচি, সৌন্দর্যময়তার ধ্যানে তন্ময়; বুদ্ধদেব বসু সেখানে পাপ-অমঙ্গলবোধ, আদিম বাসনা কামনাকে অঙ্গীকার করেই তা থেকে মুক্তি প্রয়াসী। লোলুপ ভোগলালসা সত্ত্বেও কবি অমৃতপিয়াসী। মানুষ যে অসম্পূর্ণ ও প্রবৃত্তি সর্বস্ব তার জন্য দায়ী বিধাতা; আর বিধাতার সেই ত্রুটিকে কবি নিজস্ব মহিমায় সংশোধন করতে চান; অর্থাৎ এক অর্থে কবি নিজস্ব শিল্পলোক গড়তে প্রয়াসী। প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় বুদ্ধদেব বসুর স্মরণীয় উক্তি: “যে ভগবান ও মানুষ পরস্পরের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বী, কেন-না যে আদিমানব বিধাতার সৃষ্টি সে অসহায়ভাবে পাশব বৃত্তির অধীন, কিন্তু সেই মানুষই তার আপন সাধনার দ্বারা নিজেকে সংস্কৃত ও রূপান্তরিত করেছে, হয়ে উঠেছে কবি ও শিল্পী, ঈশ্বরের মতোই স্রষ্টা। নবযৌবনের স্পর্ধা বলতে যা কিছু বোঝায়, এই কবিতাটি তার দৃষ্টান্তরূপে গণ্য হতে পারে, এবং এর প্রথম প্রকাশের কাল আমাদের সাহিত্য পঞ্জিকায় বিদ্রোহের ঋতু বলে চিহ্নিত।” (সঙ্গ নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ।) যদিও বিধাতা কবিকে ‘অন্ধকার অমারাত্রি সম’ কামনা প্রদান করেছেন তবুও কবি আপন সাধনায় তা শোধন করে স্বপ্নসুধাসম প্রেম রচনা করেছেন। প্রবৃত্তির কারাগার থেকে এইভাবেই মানুষ মুক্তিলাভ করে প্রেমের অমৃতলোক সৃজন করে। আদিম জৈবতায় স্পন্দমান মানুষ বাসনাতুর সত্তাকে পরাভূত করে, যদিও বিধাতা মানুষকে সৃষ্টি করেন জৈবতার প্রতিমূর্তি রূপে। ‘মানুষ’ কবিতাতেও বিশ্বস্রষ্টার প্রতি অভিযোগ ধ্বনিত:

স্রষ্টা শুধু এই চাহে, এ বীভৎস ইন্দ্রিয় মিলন

নির্বিচারে প্রাণীসৃষ্টি করে থাকে যেমন পশুরা।

মোর তিক্ত চিত্ত ঠেলি উঠিছে যে ব্যাকুল প্রার্থনা

স্বপ্নসত্ত্বাত সেই সুন্দরের সুদূরের তরে-

বিধাতা শোনেনি তাহা।

(মানুষ/বন্দীর বন্দনা)

‘বন্দীর কন্দনা’, ‘শাপভ্রষ্ট’, ‘কালস্রোত’, ‘অমিতার প্রেম’-এই কবিতা চতুষ্টয়ে ব্যবহৃত শব্দ ও চিত্রকল্প প্রমাণ করে যে প্রবৃত্তি পরাবশ্যতার অধীন, দেহসচেতন, কামনাবদ্ধ, আবার একই দেহোত্তীর্ণ সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল।

আলোচ্য কাব্যের ‘প্রেম ও প্রাণ’ পর্যায়ের ছয়টি সনেটে আরক্ত শরীরী সংরাগ থেকে প্রেমে উত্তরণের পর্যায়টি যথাযথভাবে বর্ণিত হয়েছে। কৈশোর ও কৈশোর যৌবনের সম্মিলগ্নে প্রেম রহস্যময়; যোবনে প্রেম কামকলঙ্কিত, বাস্তব পৃথিবীর জ্বালাভরা। কবি বিশ্বাস করেন, তা অপবিত্র হলেও সত্য। তবুও প্রেমের দ্বন্দু সংগ্রাম-কামনা-বেদনা অতিক্রম করে যথার্থ প্রেমের উপলব্ধিতে উপনীত হতে হবে।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Scroll to Top

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading