বাংলা গদ্যের বিকাশ হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে। বিদেশ থেকে আগত সিভিলিয়ানদের এদেশীয় ভাষা, সংস্কৃতিতে শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে গড়ে উঠেছিল এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল বাঙালি পন্ডিতদের। কেননা এদেশের ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে সিভিলিয়ান পন্ডিতদেরও তেমন স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তবে এর মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্যের বিকাশ খুব সহজেই হয়েছিল। এই পন্ডিতদের মধ্যে অন্যতম মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। তাঁর সম্পর্কে সমালোচক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন-“তিনি বাংলা লিখতে বসে একটি নিজস্ব স্টাইল বাড়া করেছিলেন এবং সাধু ও চলিত-এই দুই ভিন্ন রীতির পার্থক্য বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন।”
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যতম পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। তাঁর গ্রন্থগুলি হল-‘বত্রিশ সিংহাসন’ (১৮০২), ‘হিতোপদেশ’ (১৮০৮), ‘রাজাবলি’ (১৮০৮), ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ (১৮১৭) ও ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ (১৮১৩)। রাজা বিক্রমাদিত্যকে সামনে রেখে মৃত্যুঞ্জয় বত্রিশটি গল্প শুনিয়েছেন ‘বত্রিশ সিংহাসন’ গ্রন্থে। এটি সংস্কৃত রীতিতে সাধুগদ্যে লেখা। তবে ভাষার মধ্যে একটি দীপ্তি লক্ষ করা যায়-“হে মহারাজ শুন রাজলক্ষ্মী কখন কাহাতেও স্থির হইয়া থাকেন না। রক্তমাংস মল-মূত্র নানাবিধ ব্যাধিময় ও শরীরও স্থির নয়…”। গদ্যের সরসতা সহজেই লক্ষ করা যায়। অতীত ও সেকালের ইতিহাসকে সামনে রেখে লেখক গড়ে তুলেছিলেন ‘রাজাবলি’ গ্রন্থ। সজনীকান্ত দাস এ গ্রন্থ সম্পর্কে লিখেছেন- “বাংলা ভাষার ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস তাহাতে সন্দেহ নাই।”
ব্যাকরণ, অলংকার, ইতিহাস নিয়ে ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ প্রশ্ন গড়ে উঠেছে। এ প্রশ্ন প্রকাশের পরেই মার্শম্যান প্রশংসা করেছিলেন। রচনারীতি ও ভাষাবোধে লেখকের পরিণত মনের চিত্র ফুটে উঠতে দেখি। তবে ভাষারীতিতে সাধু-চলিতের মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। কথ্যরীতির একটি দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে-“মোরা চাস্ করিব ফসল পাবো রাজার রাজস্ব দিয়া যা থাকে তাহাতেই বছরশুদ্ধ অল্প করিয়া খাবো ছেলেপিলাগুলো পুষিব।” এমন সরস গদ্য সে আমলে সত্যিই বিস্ময়কর ছিল। বিদ্যাসাগরের পূর্বে মৃত্যুঞ্জয়ই প্রথম যথার্থ গদ্যশিল্পী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
রামমোহনের ‘বেদান্তগ্রন্থ’ ও ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থের উত্তর দিতে মৃত্যুঞ্জয় লিখেছিলেন ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’। তিনি এ গ্রন্থকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন, যথা-কর্মকাণ্ড, উপাসনাকান্ড ও আনকাণ্ড। প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুঞ্জয় এ প্রশ্নে বেদান্তশাস্ত্রের মূল তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। বলা ভালো, তা তিনি দক্ষতার সঙ্গেই পেরেছিলেন।
বাংলা গদ্যের প্রথম পর্বের এক দক্ষ নাবিক মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। বাদ-প্রতিবাদ, যুক্তিতর্ক যে গদ্যের বাহন, তেমনি গদ্যের যে নিজস্ব তাল আছে তা তিনি দেখেছিলেন। অনেকেই মৃত্যুঞ্জয়ের সমালোচনা করে লিখবেন-‘এই এই’ ছিল না। কিন্তু সময়ের কথাও তো আমাদের ভাবতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই বলা যায়, বাংলা গদ্যের প্রথম পর্বে মৃত্যুঞ্জয়ের অবদান বিশেষ স্মরণীয়।