ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যতম পণ্ডিত উইলিয়াম কেরী। বাংলা গদ্যের বিকাশে যেসব বিদেশিদের নাম স্মরণীয় তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম কেরী অন্যতম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনিই প্রথম সিভিলিয়ানদের এদেশীয় ভাষা সংস্কৃতি শেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি নিজে যেমন গ্রন্থ রচনা করেছেন, তেমনি বাঙালি পন্ডিতদের দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন রচনা করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। উইলিয়াম কেরীর নামে দুটি গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়। যথা– ‘কথোপকথন‘ (১৮০১) ও ‘ইতিহাসমালা‘ (১৮১২)। ‘কথোপকথন‘ সংলাপের ঢঙে লেখা। বাঙালি জীবনের ঘরোয়া নানা সংবাদ নিয়ে তিনি প্রশ্নটিকে সাজিয়েছেন। যেমন–হাটের বিষয়, স্ত্রীলোকের হাটকরণ, মাইয়া কোন্দল, চাকর ভাড়াকরণ ইত্যাদির মতো হালকা বিষয়গুলি নিয়ে তিনি সিভিলিয়ানদের জনজীবন সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন। কেরীর ‘ইতিহাসমালা‘ ঠিক ইতিহাস বলতে আমরা যা বুঝি তা নয়, অনেকটা গল্পের ছলে লেখা। তবে গ্রন্থের আখ্যাপত্রে লেখা ছিল-“A collection of stories in the Bengali Language collected from various sources.”। বলাদেশে প্রচলিত নানা প্রশ্ন (পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ)-এর কাহিনিগুলিই তিনি এখানে সহজ সরলভাবে পরিবেশন করেছেন। যদিও সেদিনের ভাষা সহজ ছিল না। কেরীর এই গ্রন্থদুটিতে ভাষাগত জড়তার চিহ্ন হয়তো স্পষ্ট, তবে
তিনিই প্রথম গ্রন্থ রচনার মধ্যে দিয়ে বাংলা গদ্যের বিকাশে প্রভৃত সাহায্য করেছিলেন। সংগতভাবেই গোপাল হালদার কেরী সম্পর্কে লিখেছিলেন-“প্রতিভার একটি সংজ্ঞা নাকি পরিশ্রম করবার অশেষ শক্তি। তা‘হলে উইলিয়াম কেরী নিশ্চয়ই প্রতিভাবান পুরুষ।“
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত রামরাম বসুর কৃতিত্ব আলোচনা করো। উত্তর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যতম বাঙালি পন্ডিত রামরাম বসু। বাংলা গদ্যের বিকাশপর্বে এঁদের অবদান নানাভাবে স্মরণীয়। বাঙালির গদ্যচর্চার যাত্রাপথকে এইসব পণ্ডিতরাই সুগম করে দিয়েছিলেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি শ্রীরামপুর মিশনে যোগ দেন। তারও পূর্বে তিনি ছিলেন খ্রিস্টান মিশনারি জন টমাসের বাংলা শিক্ষক। রামরাম বসুর দুটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন হল-‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র‘ (১৮০১) ও ‘লিপিমালা‘ (১৮০২)। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র‘ বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক গ্রন্থ। ইতিহাসের প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে তিনি গল্পের অবতারণা করেছেন এই গ্রন্থে। ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনা, কিংবদন্তী নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গ্রন্থটি। আলোচ্য গ্রন্থ সম্পর্কে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন-“বাঙালির লেখা ইতিহাস সংক্রান্ত প্রথম গদ্যকাহিনি ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র‘ নানা কারণে বাংলা গদ্য ও ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে গুরুত্বসহ আলোচনাযোগ্য।” রামরাম বসুর অপর গ্রন্থ ‘লিপিমালা‘-তে পত্ররচনার ঢঙে বাঙালি জীবনের কথা লিখেছেন। পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে সামনে রেখে তিনি কাহিনি গড়ে তুলেছেন। দক্ষযজ্ঞের কথী, চৈতন্যের কথা, রাজা পরীক্ষিতের কথা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বাঙালির ভাষাশিক্ষার পাঠ দিতে চেয়েছেন। এইসব পৌরাণিক ইতিবৃত্তকে তিনি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। বাঙালির চিরাচরিত কাহিনিগুলির স্বাদ বাঙালি আবার গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে নতুন করে গ্রহণ করল, যার পুরো কৃতিত্বই রামরাম বসুর। তবে গদ্যের ক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই সহজ সরল করে তুলতে পেরেছিলেন, যা সে যুগের ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ কারণেই সুকুমার সেন লিখেছেন-“লিপিমালার গদ্যরীতি আরও সহজ এবং মুখের ভাষায় বেশ কাছাকাছি।“