প্রাচীন গ্রীক দর্শনের প্রকৃতি:
দর্শন শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘philosophy’ অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা বা জ্ঞান অর্জনের জন্য যে অনুসন্ধান। যখন কোন একটি বিষয়বস্তু সম্পর্কে চুল ছেড়া বিশ্লেষণ করা হয়, খুঁটিনাটি সব কিছু পর্যবেক্ষণ করা হয় তখন সেই শাস্ত্রকে বলা হয় দর্শন শাস্ত্র। প্রাচীন গ্রিকদের মতে দর্শন হচ্ছে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য অর্জিত জ্ঞান। যার মধ্যে শিল্পকলা, বিজ্ঞান, ধর্ম ও দূরকল্পনামূলক চিন্তাভাবনা এই সমস্ত ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত। দর্শনে সুগভীর চিন্তা ও খুঁটিয়ে দেখা এই দুইটি বিষয়ের ব্যবহার বেশি লক্ষণীয় এবং প্রয়োগের ব্যবহার কম। অনেকের মতে সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল এরা হচ্ছেন দর্শনের আদি পুরুষ এবং এরা ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক। কিন্তু ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে এই চিন্তাভাবনাটি ভুল।
প্রাচীন মিশরীয় চিন্তার প্রভাব পাওয়া গেছে প্লেটোর দর্শন চর্চার ফলে। অপরদিকে ‘এরিস্টটল’ নিজ বক্তব্যে স্বীকার করেছেন,
“মিশরের ধর্মগুরুদেরকে জগতের আদিম দার্শনিক-গোষ্ঠী বলে অভিহিত করা উচিৎ”।
তাই বলা যায় যে, মিশর থেকেই সর্ব প্রথম আবির্ভাব ঘটে এই দর্শন চিন্তার। আশাকরি কিছুটা হলেও পাঠকদের বুঝাতে পেরেছি। এবার আসা যাক মূল লিখনিতে।
দর্শন নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে যুগে যুগে দেশে দেশে অনেক ধরনের দর্শন শাস্ত্র পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল এবং আছে। যেমন গ্রিক দর্শন, মিশরীয় দর্শন, ভারতীয় দর্শন ইত্যাদি। সব দর্শন সম্পর্কেই আলোচনা করা হবে।
প্রথমে শুরু করা যাক গ্রিক দর্শন নিয়ে। বোঝানর সুবিধার জন্য গ্রিক দর্শন এর সময়কালকে তিনটি যুগে ভাগ করা যায় –
১.সক্রেটিস
২.সক্রেটিস
৩.সক্রেটিস পরবর্তী যুগ
সক্রেটিস পূর্ব যুগঃ
কিছু কিছু দার্শনিক সক্রেটিসের জন্মের পূর্ব থেকে তাঁর সময়কাল অবধি জীবিত ছিলেন। কিন্তু এদের চিন্তাধারা ছিল সক্রেটিসের চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা স্বাধীন চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। সে সময়কার বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন ভাবে পৃথিবীর আদি উপাদানগুলোকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করেছেন। সক্রেটিস পূর্ব যুগের কিছু দার্শনিকদের নাম ও তাদের বিভিন্ন চিন্তাধারা সম্পর্কে আলোকপাত করছি।
দার্শনিক থেলিস
দর্শনশাস্ত্রের আদি পিতা হিসেবে ধরা হয় ‘থেলিস’ কে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ সালে তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ নগরী ‘মাইলেটাস’ এ জন্মগ্রহণ করেন। থালিসের জন্মের আগে ধর্ম এবং দর্শন এই দুই এর মধ্যে কোন তফাৎ ছিল না। যে কোন বিষয়ে ধর্মীয় সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়া হতো।তখনকার সময় গ্রিকরা ‘ওশেনিয়া’ নামের এক দেবতার পূজা করত। সেই সময় ওশান মানে নদীকে বুঝানো হতো।পরবর্তীতে এর নাম হয় মহা সমুদ্র।
দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার:
এরিস্টটলের অনুমান অনুযায়ী তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। মাইলেসিয়ার অধিবাসী ছিলেন তিনি। অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতে পৃথিবীর জন্মের কারণ ছিল অসীম কোন একটি বস্তু যার প্রচণ্ড গতির কারণে এবং তার সাথে শীতল ও উষ্ণর সংস্পর্শে জন্ম হয় আগুন, গাছপালা, মাটি ও পানির।
অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতে মাছ ছিল পৃথিবীর প্রথম প্রাণী এবং তিনি বিশ্বাস করেন এই মাছ থেকেই মানুষের জন্ম। তিনি সর্বপ্রথম পৃথিবীর ম্যাপ অঙ্কন করেন। তার মতে পৃথিবী ছিল গোলকের মত এবং সূর্যের আয়তন ছিল পৃথিবী থেকে ২৯ গুন বড়। থালিসের মত তিনিও জ্যোতির্বিদ্যায় প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন।
দার্শনিক পিথাগোরাস:
দর্শনে অঙ্কশাস্ত্রের যুক্তির আবির্ভাব করেন পিথাগোরাস। সামস দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন তিনি। তার জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭০ সালে এবং মৃত্যু খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৫ সালে। পিথাগোরাসের মতে দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল সংখ্যা। তিনি বিশ্বাস করতেন এই সংখ্যার মধ্যে অলৌকিক কোন ক্ষমতা বিদ্যমান আছে, তাই এই সংখ্যাকেই তিনি পৃথিবীর আদি উপাদান হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এছাড়া গ্রিক দার্শনিকদের মতে, তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি অমরতা ও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন। পিথাগোরাসের জন্মের আগে মানুষ জীবন যাপন করার জন্য ধর্মীয় নিয়ম কানুন কে প্রাধান্য দিত বেশি, এক কথায় ধর্মকেই জীবন যাপনের প্রধান পদ্ধতি মনে করা হতো।
দার্শনিক হেরারিক্লিটাস:
এই দার্শনিকের চিন্তাভাবনা ছিল একটু বিদঘুটে প্রকৃতির। অনুমান করা হয় যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে তিনি জীবিত ছিলেন। যুদ্ধ, ঝগড়া-বিবাদ এইসব নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল অত্যধিক। এই দার্শনিকের মতে পৃথিবীর আদি উপাদান ছিল আগুন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের আত্মা আগুন ও পানি থেকে তৈরি।
দার্শনিক পারমিনাইডস:
খ্রিষ্টপূর্ব ৫১৫ সালে ইতালির ইলিয়া শহরে জন্মগ্রহন করেন এই দার্শনিক। ‘ইলিয়া স্কুল’ এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।পারমিনাইডাস এর মতবাদ ছিল হিলারিক্লিটাস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মতে বিশ্বে কোন কিছুই পরিবর্তনশীল নয়, সবই অক্ষত। তাঁর সুদীর্ঘ ‘প্রকৃতি’ কবিতার মাধ্যমে তিনি তার দার্শনিক চিন্তাভাবনার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করেছিলেন। বলে রাখা ভালো সক্রেটিস ছিলেন পারমিনাইডাসের ছাত্র।
দার্শনিক ডেমোক্রিটাস:
ডেমোক্রিটাসের জন্ম গ্রিসের ‘আবদেরা’ শহরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ সালে। অনেকের মতে ডেমোক্রিটাস অন্যান্য সকল দার্শনিকদের চেয়ে জ্ঞানার্জনের দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। দর্শন শাস্ত্রে অনুতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডেমোক্রিটাস। তার মতবাদ ছিল মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর আত্মা ও এই মহাবিশ্ব অসংখ্য অণুর সমষ্টিতে গঠিত। এক অণু থেকে অন্য অণুর পার্থক্য শুধু তাদের আকারে, এছাড়া তাদের মাঝে আর কোন পার্থক্য নেই। তিনি আরও বলেন যে বস্তুর নিজস্ব কোন গুনাগুণ নেই, মানুষের জিভ, নাক, চোখ বস্তুর ভেতরের বিভিন্ন গুনাগুণ কে প্রকাশ করে থাকে।
অ্যানাক্সগোরাস
তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্যের আয়নিয়ান দ্বীপে খ্রিষ্টপূর্ব ৫১০ সালে তাঁর জন্ম। মৃত্যু খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৮ সালে।
এই দার্শনিক জগতের সকল প্রাণীর মনকে বস্তু বলে বিবেচনা করতেন এবং তিনি এও মনে করতেন যে মানুষ তার দৈহিক কাঠামোর জন্য জগতের অন্যান্য প্রাণীর থেকে বেশি বুদ্ধিমান, মনের জন্য নয়। তাই এই দার্শনিক জগতের পরিবর্তনের জন্য মনকে দ্বায়ী করেন।
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যঃ
নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবগত হওয়া ব্যতীত প্রাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস কল্পনাতীত। নিম্নে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা করা হলােঃ
(১) যুক্তিবােধঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় যুক্তিবােধের স্থান ছিল সর্বোচ্চ। গ্রিকগণ বিশ্বাস করত যে, সমগ্র বিশ্বজগৎ এক প্রকার সৃজনশীল যুক্তিবােধ থেকে উৎসারিত হয়েছে। তারা প্রকৃতিকে ভীতিপ্রদ ও প্রতিশােধমূলক কোনাে অকল্যাণকর বস্তু বলে মনে করেননি। বরং প্রকৃতিকে তারা কল্যাণকর বলে মনে করেছেন- যার অন্তর্নিহিত মৌল উপাদান হলাে যুক্তি। ধর্ম, ঈশ্বর, প্রকৃতি সবকিছুর মাঝেই গ্রিকগণ যুক্তিকে প্রত্যক্ষ করেছে।
(২) রাজনীতি ও নৈতিকতার সম্পৃক্ততাঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার অপর একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এতে রাজনীতি ও ধর্মনীতি তথা নৈতিকতার একাত্মতা ঘটেছে। গ্রিক যুগে রাজনীতি ও ধর্মনীতির মধ্যে কোনরূপ সুনির্দিষ্ট সীমারেখা টানা হতাে না। গ্রিক দার্শনিকদের মতে, জনকল্যাণের জন্য যে সংগঠনের প্রয়ােজন সেটাই রাষ্ট্র। তারা নৈতিকতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন।
(৩) ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের একাত্মতাঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন বিরােধ ছিল না। ব্যক্তির নৈতিক উন্নতি ও রাষ্ট্রের নৈতিক উন্নতির মধ্যে কোনাে পার্থক্য করা হতাে না। রাষ্ট্রসত্তার মধ্যেই ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণতা। ব্যক্তির স্বার্থকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে জড়িত করে গ্রিক দার্শনিকগণ ব্যক্তি অপেক্ষা রাষ্ট্রকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র বলে কোন কথা তারা কল্পনাও করতে পারতেন না। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পােষণ করাকে গ্রিকগণ এক উন্নততর সত্তার প্রতি আনুগত্য পােষণ বলে মনে করতেন।
(৪) অবাধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বঃ গ্রিকগণ মনে করতেন যে, কেবলমাত্র রাষ্ট্রের মাধ্যমেই মানুষের জীবনের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভবপর। কাজেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে সীমিত করার কোনাে প্রয়ােজন তারা অনুভব করেননি। মানুষের কল্যাণে নিয়ােজিত যেকোনাে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার অধিকার রাষ্ট্রেরই ছিল। ব্যক্তি ও রাষ্ট্র যেহেতু এক ও অভিন্ন কাজেই সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্র বলে কিছুই ছিল না।