প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে জীবনব্যাপী শিক্ষার বিকাশ আলোচনা কর। Discuss the development of lifelong learning in ancient and medieval India

প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে জীবনব্যাপী শিক্ষার বিকাশ :

ভারতে প্রাচীনকালে সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। শিক্ষা ছিল কেবল শাসক, পুরোহিত ও সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্য। চতুর্বর্ণের সর্বনিম্ন স্তরে থাকা শূদ্রদের এবং সকল বর্ণের নারীদের, শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। প্রাচীন ভারতে শূদ্ররা ছিল জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ। তাদের সবার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। প্রাচীন ভারতে বেদ পাঠ ছিল শিক্ষালাভের একটি প্রধান দিক।

প্রাচীন ভারতের শিক্ষার বিষয় নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। এই কালপর্বে শিক্ষা যেমন সর্বজনীন ছিল না, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপও বহুকাল পর্যন্ত লক্ষ করা যায় না। মহাভারত থেকে জানা যায়, উপনয়নের পরই শিক্ষার শুরু। হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখিত ষোড়শ সংস্কারের অন্যতম হলো উপনয়ন। উপনয়ন সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত কেউ দ্বিজ হতে পারে না। দ্বিজ কথাটার অর্থ হলো দ্বিতীয় জন্ম। দ্বিজত্ব লাভের সারকথা হলো ব্রহ্মচর্যের সঙ্গে পরিচয়। দ্বিজত্বপ্রাপ্তির মানে তাই শিশুর প্রথম জন্ম পিতামাতার দ্বারা, আর দ্বিতীয় জন্ম গুরুর কাছে শিক্ষালাভের মাধ্যমে। উপনয়নের মাধ্যমে গুরু আনুষ্ঠানিকভাবে শিষ্যকে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। উপনয়ন-কালে নতুন শিষ্যকে মূলত গায়ত্রী মন্ত্র শেখানো হয়। প্রাচীন সমাজে উপনয়ন সংস্কার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সমাজের নানা কাজে যুক্ত হওয়ার অধিকার জন্মাত বর্ণহিন্দুর। উপনয়নের মাধ্যমে দ্বিজত্ব লাভ করলে তবেই বেদবিদ্যা অধ্যয়নের অধিকার জন্মায়। সুপ্রাচীনকালে উপনয়নই ছিল বিদ্যারম্ভের একমাত্র বা প্রধান সংস্কার।

প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় তাই উপনয়নের স্থান ছিল সর্বাগ্রে। দ্বিজত্ব লাভ বা উপনয়নের মধ্য দিয়েই একটি বালক সমাজের পূর্ণসদস্য হয়েছে বলে গণ্য করা হতো। উপনয়ন সংস্কারের জন্য নির্ধারিত বয়স ব্রাহ্মণের জন্য আট, ক্ষত্রিয়ের ১১, আর বৈশ্যদের বেলায় ১২। উপনয়নের পর শিক্ষার্থী একজন ব্রাহ্মণ গুরুর গৃহে কয়েক বছর থেকে শিক্ষা অর্জন করত। পণ্ডিতগণ উপনয়ন অনুষ্ঠানের আরেকটি অর্থ করেছেন, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ব্রত, সংযম, নিয়ম, গুরু ও দেবতার সংস্পর্শে আসতেন। ব্রহ্মচর্যকালে শিক্ষার্থীর বেশভূষা বলতে ছিল নিম্নাঙ্গে বাস, ঊর্ধাঙ্গে অজিন, মুণ্ডিত মস্তক, দণ্ডধারী ব্রহ্মচারীর বেশ। দণ্ড ধারণের অর্থ হলো শিক্ষাজীবনে দীর্ঘ পরিক্রমার জন্য প্রয়োজনীয় অবলম্বন। এ ছাড়া থাকত যজ্ঞোপবীত বা পৈতা। উপনয়ন অনুষ্ঠানে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করে নাম ও জন্মপরিচয় দিয়ে নবীন শিক্ষার্থী গুরুর কাছে শিষ্যত্বলাভের আবেদন জানাতেন। শিক্ষাজীবনে একনিষ্ঠ থাকার শপথ নিতে হতো শিক্ষার্থীর। এই অনুষ্ঠানে শিষ্যের উদ্দেশ্যে গুরু যা বলতেন তার ভাবার্থ এ রকম: তাঁর হূদয়ের সঙ্গে শিষ্যের হূদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হোক, শিষ্যের অন্তর গুরুর অনুগামী হোক এবং গুরুতেই যেন শিষ্যের অবিচল মতি থাকে, শিষ্যের চিন্তা-ভাবনা-শ্রদ্ধা সবকিছু যেন গুরুতেই কেন্দ্রীভূত হয় ইত্যাদি। শিক্ষার প্রধান অবলম্বন ছিল বেদ।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর কাছে বেদসংহিতা ছিল কিছু দুর্বোধ্য মন্ত্রের সংকলন। সব মন্ত্রের অর্থও সবার জানা ছিল না। খুব চমত্কার ভাষায় পরিব্রাজক আল বিরুনি লিখেছেন, ব্রাহ্মণরা বেদ আবৃত্তি করেন না বুঝেই এবং তা কণ্ঠস্থ করেন লোক পরম্পরায় শুনে শুনে। ঋষিদের মধ্যে এমন লোক অল্পই রয়েছেন, যাঁরা বেদের ব্যাখ্যা করতে পারেন। ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের বেদ শিক্ষা দেন। ক্ষত্রিয়রা বেদ শিক্ষা নিতে পারেন কিন্তু শিক্ষা দেওয়ার অধিকার তাঁদের নেই। বেদ শিক্ষা দেওয়ার একমাত্র অধিকার সংরক্ষণ করেন ব্রাহ্মণরা। প্রাচীনকালে বেদ লেখার অনুমতি দেওয়া হতো না। কারণ, বেদপাঠ করার সুনির্দিষ্ট সুর ও পদ্ধতি রয়েছে। বেদ লেখনী পরিহার্য বলেই বিবেচিত হয়। কারণ, তাতে ভুল-ত্রুটি থাকা সম্ভব এবং লিখিত পাঠে সংযোজন এবং বিয়োজন ঘটতে পারে।৩ ফলে বেদ শুধু মুখস্থই রাখতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, বেদপাঠে কেন শূদ্রদের অধিকার নেই? ঋগ্বেদ-এর দশম মণ্ডলের পুরুষসূত্রে বলা হয়েছে, ব্রহ্মার শির থেকে ব্রাহ্মণের জন্ম, রাজা বা ক্ষত্রিয়র জন্ম বাহু থেকে, বৈশ্য তার জঙ্ঘা থেকে ও শূদ্র তার পদযুগল থেকে সৃষ্ট। ব্রহ্মার পদযুগল থেকে সৃষ্ট—তাই শূদ্র খুবই নিম্নজাতের, এ কারণেই তার বেদপাঠে অধিকার নেই। বিদেশি পর্যটক আল বিরুনির রচনায় এ বিষয়ে বিশদভাবে বলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, হিন্দুধর্মে মানুষকে চার বর্ণে বিভক্ত করা হয়েছে, যা চতুর্বর্ণ নামে পরিচিত। সর্বোচ্চ বর্ণ হলো ব্রাহ্মণ। প্রাচীন ভারতে সৃষ্ট এই বর্ণভেদ-প্রথা তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এই প্রথার ফলেই শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘকাল ধরে সর্বজনীন চরিত্র লাভ করতে পারেনি। সর্বনিম্ন বর্ণের শূদ্রদের বেদ উচ্চারণ বা আবৃত্তি করা তো দূরের কথা, বেদপাঠ শোনার অধিকার পর্যন্ত ছিল না।   

প্রাচীন ভারতে শিক্ষার্থীদের কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলতে হতো। ছাত্রাবস্থায় ব্রহ্মচর্য পালন বাধ্যতামূলক ছিল। সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার মূল বা চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীর আত্মিক উন্নতি সাধন। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাধারা জাতি বা বর্ণভিত্তিক সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসকে লোকমানসে মান্যতা দিতে কার্যকর সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের একাধিপত্যের জোরে ধর্মের অভিভাবক হিসেবে ব্রাহ্মণরা সব ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি, নীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের টীকাকার, ব্যাখ্যাকার ও ভাষ্যকার হয়ে উঠেছিলেন। ভূস্বামী বা জমিদার শ্রেণী স্বাভাবিক কারণেই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে নিষ্কর ভূমিদান করে এই ব্রাহ্মণ সমাজকে সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করত। ব্রাহ্মণরা কার্যত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আবশ্যিক বিশেষ অঙ্গ হিসেবে দমনমূলক প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তাদের আনুগত্যের অনুশাসন প্রশাসনিক ব্যয় কমাতেও সাহায্য করেছিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে জাতি বা বর্ণভেদব্যবস্থা বিশেষ বলপ্রয়োগ ছাড়াই শ্রমজীবী মানুষকে কৃষি উত্পাদনব্যবস্থায় নিযুক্ত রাখার প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করত। সন্দেহ নেই, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃত শাস্ত্রীয় শিক্ষাধারা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক অঙ্গ হিসেবে, শোষণমূলক সামাজিক স্তরভেদকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারতীয় শিক্ষাধারা ছিল গুরুমুখী, শুনে শেখার ঐতিহ্য। কারণ, বেদ কণ্ঠস্থ করতে হতো এবং মুখস্থ রাখতে হতো। ছাত্রদের জন্য কোনো গ্রন্থ ছিল না। তাই বই পড়ে বেদ মুখস্থ করা চলত না। জোর গলায় পাঠ করা এবং বেদবর্ণ কর্ণগোচর করা বেদ-অধ্যয়নের অঙ্গ এবং গুরুর কাছে শুনেই তা করতে হতো। শ্রবণ হলো শিক্ষক বা গুরু কর্তৃক উচ্চারিত শব্দ বা পাঠ্যবিষয়। এই ব্যবস্থাটিকে ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা’ বলা হয়। গুরুর কাছ থেকে শিষ্য, শিষ্য থেকে তার শিষ্য—এই রূপে পরম্পরায় জ্ঞান প্রবাহিত ও সংরক্ষিত হতো। এই কারণে সে যুগে জ্ঞান গ্রন্থনাকে বলা হতো ‘স্মৃতি’ বা ‘শ্রুতি’। অর্থাত্ যা স্মৃতিতে ধরে রাখা হয়েছে বা যা শোনা গেছে। গুরুর মুখে শুনে শুনে শিক্ষালাভের আর একটি উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার সুযোগ সীমাবদ্ধ করে রাখা। এতে শূদ্ররা শিক্ষালাভের সব ধরনের সুযোগ হারাল। পাঠদানের লিখিত পদ্ধতি বা গ্রন্থ না থাকায় শূদ্ররা চাইলেও লুকিয়ে এই শিক্ষালাভ করতে পারত না। ঠিক এভাবে সমাজের বিরাট এক অংশকে শোষণ করার জন্য প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রথম থেকেই চাতুর্যের পথ গ্রহণ করেছিল, পরবর্তী সময়ে যা শূদ্রদের জন্য শাপে বর হয়েছিল।

ব্রাহ্মণ্য যুগে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা আবর্তিত হয়েছিল যজ্ঞানুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। বর্ণাশ্রম প্রথা এবং চতুরাশ্রম ব্যবস্থা এই যজ্ঞানুষ্ঠানকে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্র দান করেছিল। সংস্কৃত উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য ছিল জ্ঞান আহরণ। প্রকৃত জ্ঞান বলতে বোঝানো হতো আত্মনিবেদনের মাধ্যমে পরমাত্মায় বিলীন হওয়া। আত্মনিবেদন বা আত্মোত্সর্গের শিক্ষা বলতে পিতৃঋণ, দেবঋণ, ঋষি বা গুরুঋণ পরিশোধের জন্য যজ্ঞানুষ্ঠান, অধ্যয়ন প্রভৃতি কর্তব্য সম্পাদন করাকে বোঝানো হতো। বেদ কথাটার সঠিক অর্থ হলো অজ্ঞাত কিছুর সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান আহরণ। হিন্দুদের মতে, বেদ হলো ধর্মশাস্ত্র, যা ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত। ঠিক এই রকম বক্তব্য দানের মধ্য দিয়েই বেদের বিধানকে তাঁরা অনড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ ঋষিরা শিক্ষাজীবনকে এক অপরিবর্তনীয় সর্বজনীন জীবনধারার সমার্থক বলেই মনে করতেন। আর এই জীবনধারা গ্রথিত হয়েছিল ব্রহ্মচর্যের বাঁধনে। গুরুর আশ্রমে প্রাচীন ঋষিরা শিষ্যকে পুত্র, স্বামী এবং পিতা হিসেবে কী কী কর্তব্য পালন করতে হবে সে সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। দণ্ডনীতি, ধনুর্বেদ, সামাজিক বিধি-বিধান এবং বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল সমাজজীবনের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের কথা মনে রেখে। একদিকে পরমজ্ঞান, সত্যোপলব্ধি এবং অন্যদিকে পার্থিব দায়িত্ব পালন—এই দুই লক্ষ্য পূরণের জন্য গুরুগৃহে-তপোবন আশ্রমে বিদ্যাকে দুভাবে পরিবেশন করা হতো—পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা। ‘পরাবিদ্যা’ হলো পরমজ্ঞান লাভের জন্য তিন বেদ ছয় বেদাঙ্গ অনুশীলন করা; আত্মসংযম এবং যোগসাধনা দ্বারা এই বিদ্যা অর্জন করতে হতো। আর ‘অপরাবিদ্যা’র অর্থ হলো পার্থিব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনে যা কিছু প্রয়োজন তার অনুশীলন করা। বৈদিক শিক্ষা এই ‘পরা’ ও ‘অপরা’ বিদ্যার সমন্বয় ছিল।

প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় স্মৃতির উন্নতি সাধন করা ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সময়কার শিক্ষায় বাচনিক স্মৃতির ক্ষমতা এত বেশি উত্কর্ষ লাভ করেছিল, যা আধুনিক কালে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। গুরুর মুখে শুনে বেদ কণ্ঠস্থ করার মধ্যে যত দিন শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল তত দিন অবশ্যই অন্তত ব্রাহ্মণদের প্রাক্-উপনয়ন শিক্ষার তেমন দরকার ছিল না। শিক্ষার সীমা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে লেখার ও গ্রন্থের গুরুত্ব অবশ্যই বাড়তে লাগল। ক্রমে বেদ ছাড়াও অন্যান্য বিষয় শিক্ষার অঙ্গীভূত হলে লিখিত বিষয়ের অধ্যয়ন ও চর্চা চালু হয়। সেই সঙ্গে প্রাক্-উপনয়ন লেখাপড়ার প্রথা সীমাবদ্ধভাবে হলেও চালু হয়েছিল বলেই মনে হয়। প্রাচীন স্মৃতির যুগে লেখার যথেষ্ট প্রচলন ছিল সন্দেহ নেই। তবে তা রাজকার্যেই বেশি প্রচলিত ছিল, শাস্ত্রচর্চায় নয়। ধর্মসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র-এর সাক্ষ্যে মনে হয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে লেখা বা গণিত শেখার প্রথা বিশেষ ছিল না। কিন্তু প্রাচীন ভারতে গণিতশাস্ত্রের চর্চা যথেষ্ট এগিয়ে ছিল। বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতে যে অগ্রগতি ঘটেছিল তার প্রমাণ, হিন্দুরাই প্রথম ‘শূন্যে’র আবিষ্কারক। গণিতবিদ্যা যে সব বিদ্যার শ্রেষ্ঠ, বৈদিক সাহিত্যের একাধিক স্থানে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। সহজ ভগ্নাংশের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের সঙ্গে বৈদিক হিন্দুরা পরিচিত ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় গণিতের বা লিপির ব্যবহার ছিল না। ভারতে ব্যবহূত প্রাচীনতম সংখ্যালিপির যে নমুনা পাওয়া যায় তা খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী। অশোকের শিলালিপিতে এই উভয়বিধ সংখ্যালিপির নিদর্শন মেলে। সমাজব্যবস্থাকে অনড় রাখার জন্য ব্রাহ্মণরা লিপির ব্যবহার না করে শূদ্রদের বেদ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছিল। কিন্তু দেখা যায়, বেদ পাঠের অধিকার না থাকলেও শূদ্ররা ভিন্ন ধারার এক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। সব শূদ্র নয়, শূদ্রদের একটি অংশ। ব্রাহ্মণদের বেদ শিক্ষায় দেখা গেছে সেখানে লেখা বা অক্ষর শেখার ব্যাপার ছিল না। শিক্ষা ছিল শ্রুতি এবং স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল। অথচ শূদ্রদের শিক্ষাধারায় লেখা এবং পড়া দুটোরই স্থান ছিল। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতেই পারে নিম্নবর্ণের পক্ষে কী করে সেটা সম্ভব হলো?

শূদ্রদের পড়াশোনার ব্যাপারটা যে হঠাত্ ঘটে গিয়েছিল তা নয়। ধীরে ধীরে বিবর্তনের পথেই সেটা হয়েছিল। ভারতে মহাবীরের জৈনধর্ম এবং সিদ্ধার্থের বৌদ্ধধর্ম প্রচার প্রধানত ছিল একটি রাজনৈতিক ঘটনা। ক্ষত্রিয়রা শাসক হলেও সমাজে তাদের অবস্থান ছিল দ্বিতীয় স্তরে। ক্ষত্রিয় হিসেবে মহাবীর এবং বুদ্ধ কেউই ব্রাহ্মণদের এই আধিপত্য মেনে নিতে চাননি। কিন্তু তাঁরা জানতেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে নতুন কোনো ধর্মমত প্রচার না করে তাকে প্রতিহত করা যাবে না। ভারতে জীব হত্যা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। ধর্মের নামে সেই একই প্রশ্ন তুলেছিলেন মহাবীর এবং বুদ্ধ। ভারতের মন্দিরে মন্দিরে গো হত্যার উত্সব ছিল একদা। পশু বলি পূজার প্রধান অঙ্গ ছিল। মন্দিরে মন্দিরে পশু বলির মহা-উত্সবের কারণে হালচাষের জন্য পশুর অভাব দেখা দিয়েছিল। মহাবীর তখন জীবহত্যা নিষেধ করলে সাধারণ কৃষকেরা খুব খুশি হয় এবং মহাবীরের ধর্মমত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। কিছুদিন পর দেখা গেল, জীব হত্যার ব্যাপারে মহাবীরের নিষেধের কারণে চাষের জমিতে পোকামাকড় বা ইঁদুরের উপদ্রব দেখা দিলেও সেগুলোকে মেরে ফেলা যাচ্ছে না। জীব হত্যা নিষেধে গরু রক্ষা পেল ঠিকই, কিন্তু খেতের ফসল নষ্ট হতে লাগল পোকামাকড় ধ্বংস করতে না পারায়। কৃষকদের সেই সংকটে বুদ্ধ নতুন মত, ধর্মের নতুন বাণী প্রচার করলেন। তিনি জীব হত্যা নিষেধ করলেন না। বললেন, অকারণে জীব হত্যা কোরো না। সে কারণেই বুদ্ধদের একটি সম্প্রদায় মাংস খেয়ে থাকে। বুদ্ধের নতুন বাণীতে গো হত্যা যেমন রোধ করা গেল, তেমনি ফসলের খেতের পোকামাকড় হত্যায় কোনো বাধা রইল না। বুদ্ধের ধর্মমত তাই মহাবীরের চেয়ে বহুগুণ বেশি সাফল্য লাভ করে।

ভারতে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব শূদ্রদের লেখাপড়ার পথকে সুগম করে দিয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম বর্ণপ্রথার বিরোধিতা না করলেও সকল বর্ণের মানুষকে সম্মান দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। বৌদ্ধধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল বৈশ্যরা। নালন্দার বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠার জন্য ৫০০ বণিক ১০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে একটি ভূমিখণ্ড ক্রয় করে বুদ্ধকে দান করে বলে হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেছেন।১০ ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বুদ্ধের মতকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ব্যাপারে বৈশ্য বা বণিক সম্প্রদায়ের বিরাট ভূমিকা ছিল। কারণ বুদ্ধ শূদ্র ও বৈশ্যদের স্বার্থকে রক্ষা করেছিলেন। ইতিহাসের গতিপথের কিছু দ্বান্দ্বিক নিয়ম রয়েছে। শূদ্রদের লেখাপড়া শেখার ক্ষেত্রে সেই দ্বান্দ্বিক নিয়ম কাজ করেছিল। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এক পর্বে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা কায়িক পরিশ্রম থেকে সরে দাঁড়ালে চাষাবাদের দায়িত্ব পুরোটাই এসে পড়ে বৈশ্য ও শূদ্রদের ওপর। ফলে ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়মেই শূদ্রদের ওপর ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। শূদ্রদের উত্পন্ন দ্রব্য না পেলে ব্রাহ্মণদের চলে না। প্রাচীনকালের কোনো এক পর্বে যেসব শূদ্র প্রধানত গৃহভৃত্য, দাস, কারিগর ও কৃষিশ্রমিক ছিল, আদি মধ্যযুগে তাদের কৃষক হিসেবে রূপান্তর ঘটে।

হিউয়েন সাঙ শূদ্রদের দেখেছেন কৃষিজীবী হিসেবে। বিভিন্ন পুঁথিতেই তাদের কৃষক বলা হয়েছে। কৃষির প্রসার কৃষিমজুর বা কৃষকের সংখ্যা বাড়ায়। শূদ্ররা এই পেশায় যোগ দিতে থাকে। একটা পেশাগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গেই অবশ্য শিক্ষার পরিবর্তন ঘটেছে। বারো শতকে কল্হনের বিবরণে দেখা যায়, পথে পাওয়া একটি বাচ্চাকে শূদ্রা-ধাত্রী মানুষ করে। লেখাপড়া শিখে সে কোনো এক গৃহস্থের বাড়িতে শিশুদের জন্য শিক্ষক নিযুক্ত হয়। দুই দিক দিয়ে ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, শূদ্রা-ধাত্রীর কাছে মানুষ হয়েও সে লেখাপড়া শিখেছে এবং দ্বিতীয়ত, সে গৃহশিক্ষকের কাজ করে। সেকালে শূদ্রের পড়ালেখা শেখা তাহলে একেবারে অসম্ভব ছিল না। বরং শূদ্রদের মধ্যে লেখা, পড়া আর গণিত শেখার রেওয়াজ কিছুটা চালু হচ্ছিল। ধনী বৈশ্য বা শূদ্ররা বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণেই আগ্রহী ছিল। কারিগরি বা বৃত্তি শিক্ষণের ব্যবস্থা থাকত বণিক সংঘের কাছে বা নির্দিষ্ট পরিবারের ওপর। জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যাটুকুই সাধারণত তারা শিখত। বর্ণমালার সঙ্গে সঙ্গে এসব শিশুকে সাধারণ গণিত শেখানো হতো। এ ধরনের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিল বণিক, গ্রাম্য করিগর ও কৃষকেরা। এই শিক্ষায় লেখার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। সে কারণেই ছাত্রদের অক্ষর চিনতে হতো, নিরক্ষর হলে চলত না। সন্দেহ নেই তখনো জনশিক্ষার প্রচলন হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষির প্রসার শূদ্রদের জন্য লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে এবং একটা পেশাগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কিন্তু এতে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে প্রাচীন ভারতে শিক্ষার কোনো সাধারণ প্রথাবদ্ধ ধারা গড়ে উঠেছিল। প্রধানত ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মধ্যেই পড়াশোনা সীমাবদ্ধ ছিল।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading