প্রমথ চৌধুরী ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে সেকালীন রায়তদের যে দুঃখ-কষ্টের বিবরণ দিয়েছেন তা তোমার ভাষায় ব্যক্ত করো।

প্রমথ চৌধুরী ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে সেকালীন রায়তদের দুঃখ-কষ্টের বিবরণ দিয়েছেন একটি গভীর, চমকপ্রদ এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি সেকালের (বিশেষত ১৮০০-১৯০০ সালের কাছাকাছি) বাংলার কৃষকদের, বিশেষ করে রায়তদের জীবনযাত্রার চিত্র অত্যন্ত বাস্তবিক ও নির্মমভাবে তুলে ধরেছেন। “রায়তের কথা” প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী মূলত সেই সময়ের কৃষকের দৈনন্দিন সংগ্রাম, নিঃস্বতা, অধিকারহীনতা এবং সামাজিক অবিচার বিষয়ক এক উন্মুক্ত আলোচনা করেছেন। এই প্রবন্ধে রায়তদের অভ্যন্তরীণ কষ্টের সাথে সাথে কৃষি প্রথার মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য এবং শোষণের তীব্র চিত্রও ফুটে উঠেছে।

১. ভূমির অধিকারহীনতা:

প্রথমেই যে দুঃখ-কষ্টের বিষয়টি উঠে আসে তা হলো, সেকালের রায়তদের ভূমির অধিকারহীনতা। কৃষকরা সাধারণত জমির মালিকানায় অধিকারী ছিলেন না। জমির মালিকেরা— জমিদার— নিজেদের ভূমির মালিক হিসেবে জমির থেকে কৃষকদের কাজের বিনিময়ে একটা অংশ নিতেন। এই ব্যবস্থায় জমির মালিকানার সব অধিকার জমিদারের হাতে থাকত, এবং কৃষকরা কেবল তার জন্য কাজ করতেন। জমির মালিকরা কৃষকদের শোষণ করতেন এবং তাদের ভূমি-পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট খাজনা (ট্যাক্স) আদায় করতেন, যেটি কখনো কখনো অত্যন্ত অত্যাচারী ছিল। ফলে, কৃষকরা শুধুমাত্র তাদের শ্রমের বিনিময়ে খুব সামান্য কিছু পেতেন, এবং জমির উৎপাদন এবং তার ফলাফল তারা নিজেদের জীবনের উন্নতির জন্য ব্যবহার করতে পারতেন না।

এছাড়া, জমির প্রতি এই অধিকারহীনতার কারণে, কৃষকরা কখনোই সঠিকভাবে নিজের জীবিকা উপার্জন করতে পারতেন না। তাদের জীবন ছিল একটি অস্থিরতা, যেখানে কখনোই মাটি বা ভূমি ছিল না তাদের অধিকারী। তারা চিরকালই জমির মালিকদের কাছে নির্ভরশীল ছিলেন, এবং এই শোষণমূলক সম্পর্কের কারণে তাদের জীবনে সুখের কোনো সঞ্চয় ছিল না।

২. অর্থনৈতিক শোষণ ও দারিদ্র্য:

প্রমথ চৌধুরী রায়তদের জীবনে অর্থনৈতিক শোষণের প্রভাবকেও এক গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। জমির উপর জমিদারদের একাধিপত্যের ফলে রায়তরা ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। তাদের শ্রমের মূল্য কম ছিল এবং কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর পরেও তারা সঠিক দামে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারতেন না। অর্থাৎ, তাদের জীবিকা ছিল পুরোদস্তুর বৈষম্যমূলক এবং সেই শোষণের চক্র ভাঙা প্রায় অসম্ভব ছিল। জমির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েও তাদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসত না।

এছাড়া, জমিদাররা তাদের কাচ্চা খাজনা আদায়ের জন্য নানা সময় নানান ধরনের চাপ প্রয়োগ করতেন। অনেক সময় তাদের ঋণগ্রস্ত করে ফেলতেন, যার ফলে কৃষকরা জীবনভর ঋণের জালে আটকা পড়তেন। খাজনা আদায়ের জন্য কিছু জমিদার বা তাঁদের এজেন্টরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে কৃষকদের সঙ্গে আচরণ করতেন, এবং যেকোনো প্রকার সাহায্য ছাড়াই তাদের অর্থ আদায় করতেন।

৩. সামাজিক বৈষম্য এবং শ্রেণীবিভাজন:

প্রমথ চৌধুরী ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে সেকালীন সমাজের শ্রেণীবিভাজনের চিত্রও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছেন। সেকালে রায়তরা ছিলেন একেবারে নিম্নবর্গীয় শ্রেণি, যারা প্রায় সব ধরনের সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। সমাজে তাদের একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল, যেখানে তাদের অধিকার ছিল সীমিত এবং তাদের শ্রেণিগত অবস্থান অনুযায়ী তারা অবজ্ঞিত, হেয় এবং শোষিত হয়ে থাকত।

রায়তের সমাজের অন্য শ্রেণির মানুষদের তুলনায় কম সামাজিক মর্যাদা ছিল। এই অবস্থায় তারা সবসময় নিজেদের নীচু বলে অনুভব করতেন। জমিদার, পতিত জমিদার, আধিকারী ইত্যাদি শ্রেণির মানুষের তুলনায় রায়তরা ছিল সবসময় পরাধীন। তারা তাদের প্রয়োজনীয়তার জন্য নির্ভরশীল ছিল শাসক শ্রেণির উপর, এবং তাদের শ্রেণীর মর্যাদা তাদের কর্মের ধরণ, জীবনধারা, চর্চা, স্বভাব—সবকিছুর মাধ্যমে সমাজে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হত।

৪. অত্যাচারিত ও শোষিত অবস্থান:

প্রমথ চৌধুরী তার প্রবন্ধে রায়তদের অত্যাচারের বর্ণনাও দিয়েছেন। রায়তের সাথে জমিদার বা তার এজেন্টরা কোনো সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ করতেন না। কোন সময় এই জমিদাররা তাদের জমি আদায়ের জন্য ভয়াবহ অত্যাচার, মানসিক নির্যাতন, সহিংসতা প্রয়োগ করতেন। এটি ছিল অত্যন্ত নির্দয় এবং নির্মম একটি বাস্তবতা, যা রায়তদের চরম অত্যাচারের শিকার করে তুলত।

জমির মালিকরা তাদের জমির উৎপাদন থেকে স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করলেও, কৃষকদের জীবন ছিল দিন আনে, দিন খায়। বিভিন্ন সময় তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঋণগ্রস্ত হত, এবং তাদের সমস্ত কাজের ফল জমিদারের পকেটে চলে যেত।

৫. ধর্মীয় শোষণ ও আধ্যাত্মিক সংকট:

রায়তদের জীবনযাত্রা ছিল যে শুধু অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে শোষিত, তা নয়, তারা অনেক সময় ধর্মীয় শোষণও অনুভব করতেন। প্রমথ চৌধুরী এ ব্যাপারে লেখেন, অনেক সময় ধর্মীয় নেতারা কিংবা পীর-ম্যাস্টাররা তাদের ওপর নানা ধরনের ধর্মীয় চাপ সৃষ্টি করতেন। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তারা তাদের শ্রমের কাজে আরও পরিশ্রমী হতে উৎসাহিত করতেন। ধর্মের নামে শোষণ অনেক সময় তাদের বিশ্বাসের মধ্যে প্রবাহিত হত, যা তাদের আরও নিরন্ন এবং অসহায় করে তুলত।

এছাড়া, প্রমথ চৌধুরী বর্ণনা করেন যে, কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে উপাস্য দেবতার মাধ্যমে তাদের জীবনকে সহায়তা প্রার্থনা করতেন, কিন্তু সেই সমস্ত প্রার্থনাও কোনো কাজের ছিল না। তাদের জীবনধারা এবং বিশ্বাস যেভাবে অন্তর্নিহিত দুঃখ এবং কষ্টের সাগরে প্রবাহিত ছিল, তার জন্য কোনো সঠিক উত্তর বা সমাধান তারা কখনো পায়নি।

উপসংহার:

প্রমথ চৌধুরী ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে সেকালের কৃষকদের জীবনের অন্ধকার দিকগুলো চিত্রিত করেছেন। সেকালীন রায়তদের দুঃখ-কষ্টের বিবরণ মূলত তাদের অধিকারহীনতা, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক বৈষম্য, এবং ধর্মীয় নির্যাতন এবং অত্যাচারের মুখোমুখি হওয়া এসব বিষয় নিয়ে। এই প্রবন্ধটি আমাদের চোখে আনে কিভাবে ঔপনিবেশিক শোষণ এবং জমিদারি প্রথার মাধ্যমে ভারতীয় কৃষকরা শোষিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী রায়তদের জীবনের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন, যা সমাজের শোষণমূলক কাঠামো ও শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ এবং সচেতনতা তৈরির চেষ্টা ছিল।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading