পল্লী শিল্পের ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে প্রাবন্ধিকের বক্তব্য যথার্থ এবং প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। তিনি বাস্তবিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। পল্লী শিল্প একসময়ে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির একটি মজবুত ভিত্তি ছিল, যা গ্রামের মানুষের জীবিকা, ঐতিহ্য এবং সামাজিক বন্ধনের অন্যতম উপায় হিসেবে কাজ করত। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন যে, আধুনিকীকরণ, উপনিবেশিক শাসনের প্রভাব, কাঁচামালের অভাব, এবং স্বল্প মূল্যের যান্ত্রিক উৎপাদনের ফলে পল্লী শিল্প ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে চলে যায়।
১. উপনিবেশিক শাসনের প্রভাব
প্রাবন্ধিক যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে, ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন পল্লী শিল্প ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ব্রিটিশরা তাদের শিল্প বিপ্লবের যুগে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার জন্য ভারতে একটি বিশাল বাজার তৈরি করতে চেয়েছিল। তারা ভারতে শিল্পের প্রসারকে সীমিত করে দিয়ে পল্লী শিল্পের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় পণ্য উৎপাদন নিষেধ বা শুল্ক আরোপ করে তাঁতিরা, কুমোররা, লোহার কারিগররা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি, কারণ সস্তায় ব্রিটেনের পণ্য আমদানি করা হচ্ছিল। এই প্রক্রিয়ায় পল্লী শিল্পীরা ক্রমশ বেকার ও অর্থনৈতিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ে।
২. কাঁচামালের অভাব ও মূলধনের সংকট
পল্লী শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল এবং মূলধনের অভাবও পল্লী শিল্পের ক্ষতির অন্যতম কারণ হিসেবে প্রাবন্ধিক তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশরা একদিকে ভারতের কাঁচামালকে নিজেদের দেশে রপ্তানি করে সস্তা মজুরি দিয়ে পণ্য তৈরি করত এবং অন্যদিকে ভারতের পল্লী শিল্পের জন্য কাঁচামালের জোগানে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে পল্লী শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং তারা আর্থিকভাবে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে থাকে। আবার পল্লী শিল্পে বিনিয়োগ ও মূলধন সংকটের কারণে শিল্পীরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ধরনের পুঁজি সংকটের কারণে তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনতে বা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
৩. প্রযুক্তিগত ও যান্ত্রিক উন্নয়নের চাপে
আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্র নির্ভর শিল্প পল্লী শিল্পের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। প্রাবন্ধিক এই কারণটিও যথার্থই উল্লেখ করেছেন। যান্ত্রিক শিল্প যেমন দ্রুত এবং স্বল্প মূল্যে বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করতে সক্ষম, তেমনি তা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে। এক্ষেত্রে হাতে তৈরি পণ্য, যেমন কাপড়, মাটি ও লোহার সামগ্রী, যেগুলি তৈরি করতে দীর্ঘ সময় এবং শ্রম প্রয়োজন, তারা যান্ত্রিক পণ্যের সাথে টিকতে পারেনি। ফলে ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প বা তাঁত শিল্পের চাহিদা কমে যায়, এবং তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে।
৪. শিক্ষার অভাব ও উন্নত প্রশিক্ষণের সংকট
প্রাবন্ধিক যথার্থই বলেছেন যে, পল্লী শিল্পীদের অনেকেই সঠিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার অভাবে নিজেদের উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিক করতে পারেননি। তাঁরা অনেকেই তাদের পিতৃপুরুষদের সময় থেকে শেখা দক্ষতাকে রক্ষা করেই পণ্য তৈরি করতেন, তবে নতুন প্রক্রিয়া বা কৌশল নিয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। আধুনিক শিক্ষার অভাবে তাঁরা নিজেদের দক্ষতাকে নতুন করে রূপ দিতে বা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন করতে সক্ষম হননি। ফলস্বরূপ, এই শিল্পেরা ধীরে ধীরে বাজার হারিয়ে ফেলেছে।
৫. সরকারের অবহেলা এবং সঠিক নীতির অভাব
প্রাবন্ধিক যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন যে, সরকারের সহায়তার অভাব এবং সঠিক নীতিমালা না থাকাও পল্লী শিল্পের ধ্বংসের অন্যতম কারণ। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতেও এই সমস্যাটি চলতে থাকে, যেখানে সরকার বৃহৎ শিল্পগুলিকে অগ্রাধিকার দেয় এবং ক্ষুদ্র ও পল্লী শিল্পের উন্নয়নে তেমন মনোযোগ দেয় না। এই অবহেলার ফলে পল্লী শিল্পের সমস্যাগুলি সমাধান হয়নি। বিশেষ করে পল্লী শিল্পের জন্য সঠিক বাজার সৃষ্টি না হওয়া, প্রচারের অভাব এবং রপ্তানি বাজারে যথেষ্ট সুযোগ না থাকায় এই শিল্প ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়েছে।
৬. জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির অবক্ষয়
প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন যে, আধুনিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং নগরায়ণের ফলে মানুষ হাতে তৈরি পণ্যের প্রতি আগ্রহ হারাতে শুরু করে। যান্ত্রিক পণ্যগুলি যেমন সস্তা এবং সহজলভ্য, তেমনই তা সময় সাশ্রয়ীও বটে। ফলে গ্রামীণ মানুষরাও নগর জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ধীরে ধীরে তাঁরা পল্লী শিল্পকে উপেক্ষা করতে থাকে। এমনকি গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি মনোভাবের পরিবর্তন পল্লী শিল্পের উপর প্রভাব ফেলে, কারণ নতুন প্রজন্ম তাদের পৈতৃক পেশায় আগ্রহী নয় এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে নগরে চলে যায়।
৭. বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের প্রভাব
বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিশ্বায়ন পল্লী শিল্পের ধ্বংসের আরেকটি কারণ হিসেবে প্রাবন্ধিকের ব্যাখ্যা অত্যন্ত যথাযথ। বৈদেশিক পণ্য ও বাণিজ্যিক মডেলের প্রচলন পল্লী শিল্পের প্রতিযোগিতাকে আরও কঠিন করে তোলে। বিদেশি পণ্য, যা উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা, তা বাজারে এসে পল্লী শিল্পের চাহিদাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। বিশ্বায়নের ফলে বৈদেশিক পণ্যের সহজলভ্যতা পল্লী শিল্পকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয় এবং গ্রামীণ কারিগরদের অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়।
উপসংহার-
প্রাবন্ধিকের ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়, পল্লী শিল্পের ধ্বংসের কারণগুলো একাধিক এবং আন্তঃসংযুক্ত। এটি শুধু অর্থনৈতিক কারণ নয়, বরং সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণগুলোর সংমিশ্রণ। এ কারণে বলা যায়, প্রাবন্ধিকের ব্যাখ্যা যথাযথ এবং গভীর পর্যবেক্ষণমূলক।