পল্লব শিল্প ও স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা কর।

পল্লব শিল্প ও স্থাপত্য:

দক্ষিণ ভারতে পল্লবদের সাফল্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তারা তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ইতিহাস পল্লব আমলের মন্দিরগুলি থেকেই শুরু হয়।

এই মন্দিরগুলিতে সর্বপ্রথম দ্রাবিড় শিল্পনীতির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। দ্রাবিড় রীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রধান দেবগৃহ বা গর্ভগৃহ এর বিমানটি হতো পিড়ামিটের মতো এবং বহু তলে বিন্যস্ত। প্রতিটি তল গর্ভগৃহের অনুরূপ এবং নিচের তলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র।

মন্দিরের শীর্ষ দেশ গম্বুজ আকৃতি, শিল্প শাস্ত্রে যাকে বলে স্তুপ বা স্তুপিকা। গর্ভগৃহের সামনে হলঘর নির্মাণ করা হতো, যাকে বলা হতো “মন্ডপ”। সমগ্র বিন্যাসটির চারিদিকে উচ্চ দেওয়াল বেষ্টিত প্রাঙ্গন থাকতো। দেওয়ালের মধ্যে ছিল সুউচ্চতোরণ, যাকে বলা হতো গোপুরম।

পল্লব আমলে নির্মিত মন্দিরগুলি ছিল দুই ধরনের –

  1. পাহাড় খোদাই করে নির্মিত মন্দির
  2. স্বাধীনভাবে তৈরি মন্দির

পাহাড় খোদাই করে নির্মিত মন্দির


পল্লব আমলের প্রথম দিকে পাহাড় খোদাই করে নির্মিত মন্দিরগুলিতে বৌদ্ধ গুহার মন্দিরের প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও পরবর্তীকালে এযুগের শিল্পভাবনার স্বতন্ত্র ও বিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা যায়। পল্লব শিল্পের এই ক্রমবিবর্তনের ধারা ধরে এই শিল্পকে চারটি শিল্পরীতিতে ভাগ করা হয়েছে, যথাক্রমে-

  1. প্রথম মহেন্দ্র বর্মনের রাজত্বকাল মহেন্দ্র শিল্পরীতি (600-625 খ্রিস্টাব্দ)।
  2. প্রথম নরসিংহ বর্মনের রাজত্বকালে মহামল্ল শিল্পরীতি বা মামল্ল শিল্পরীতি (625-675 খ্রিস্টাব্দ)।
  3. দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মনের রাজত্বকালে রাজসিংহ শিল্পরীতি (695-722 খ্রিস্টাব্দ)।
  4. অপরাজিত বর্মনের রাজত্বকালে অপরাজিত শিল্পরীতি।

মহেন্দ্র শিল্পরীতি:


পাহাড় কেটে গুহা মন্দির নির্মাণ ছিল মহেন্দ্র শিল্পরীতির প্রতিপাদ্য বিষয়। এই মন্দিরে ছাদ ধরে রাখার জন্য ত্রিকোণ বা গোলাকার স্তম্ভ বা থামের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ একাম্বর ধাথের মন্দির, অনন্ত শায়ন মন্দির, ভৈরব কুণ্ড মন্দির ইত্যাদি মন্দিরে কথা বলা যায়।

মহামল্ল বা মামল্ল শিল্পরীতি:


প্রথম নরসিংহ বর্মন এর রাজত্বকালে মহাবলীপুরমে মহামল্ল বা মামল্ল শিল্পরীতির বিকাশ ঘটে। এই শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য হলো, গ্রানাইট পাথরের পাহাড় একটি কেটে একটি প্রস্তর খন্ডে রথের আকৃতিতে মন্দির নির্মাণ। এই রথ মন্দিরের সংখ্যা আটটি। পাঁচটি রথ পঞ্চ পান্ডের নামে এগুলিকে একত্রে সপ্ত প্যাগোজ বলা হয়।
সবকটি রথ মন্দিরই শৈবধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। রথগুলির ভিতরের দিক অসম্পূর্ণ হলেও এর বাইরের দিক অসাধারণ সূক্ষ্ম ভাস্কর্যের কাজে পূর্ণ। সবগুলি রথ মন্দিরের আয়তন মোটামুটি একই। কয়েকটি রথকে বিহার বা চৈত্যের অনুলিপি বলে মনে হয়। বিশেষ করে ভীম, সহদেব ও গণেশের নামাঙ্কিত রথগুলি। এছাড়া মহামল্ল রীতি অনুসারে পাহাড় কেটে গুহামন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে আদি বরাহ, বরাহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

রাজসিংহ শিল্পরীতি:


মহামল্ল যুগের পর দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মনের আমলে গুহামন্দির বা রথ মন্দিরের পরিবর্তে পাথর দিয়ে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মন্দির নির্মাণ শুরু হয়।

দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মনের উপাধি অনুসারে এই শিল্পরীতির নাম হয় রাজসিংহ শিল্পরীতি। এই শিল্পরীতিকে নির্মিত মন্দিরের সংখ্যা ছয়টি। তার মধ্যে তিনটি যথাক্রমে- তীর মন্দির, ইশ্বর মন্দির ও মুকুন্দ মন্দির আছে মহাবলীপুরমে, বাকি তিনটি হলো- কাঞ্চির কৈলাসনাথ মন্দির ও বৈকুণ্ঠ পেরুমল মন্দির এবং দক্ষিণ আকিটের পনমলই এ অবস্থিত তল গিরিশ্বর মন্দির।

অধ্যাপক সরষী কুমার স্বরসতী কৈলাসনাথ মন্দিরকে দ্রাবিড় স্থাপত্য শৈলির অন্যতম নিদর্শন বলে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া দ্রাবিড় শিল্পরীতির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেমন প্রাচীর বেষ্টিত চত্ত্বর, গোপুরম স্তম্ভ যুক্ত মন্ডপ সবই এই মন্দিরে দেখতে পাওয়া যায়।

অপরাজিত শিল্পরীতি:


পল্লব স্থাপত্যের শেষ ধাপে অপরাজিত শিল্পরীতি। অপরাজিত বর্মন এই শিল্পরীতির প্রবর্তন করেছিলেন। এই শিল্পরীতির নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না। চলে স্থাপত্য নীতির অনুকরণে এই শিল্পনীতির গঠিত হয়েছিল। পন্ডিচেরিতে এই শিল্পরীতির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।

পল্লব স্থাপত্য শিল্প:


স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পেও পল্লবরা তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পল্লব ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো স্বাভাবিকত্ব- মানুষ, দেবতা, জীবজন্তু কোন ক্ষেত্রেই কোনরকম গোপনীয়তা দ্বারা মূর্তিকে ভরাক্রান্ত করা হয়নি।
পল্লব ভাস্কর্যের যুগান্তকারী নিদর্শন হলো মহাবলীপুরমের “কিরাতার্জুনীয়ম রিলিফ”। এটি লম্বা 90 ফুট এবং উচ্চতায় 23 ফুট ছিল। একদা এই ভাস্কর্যকে গঙ্গাবতরণ অথবা অর্জুনের প্রায়শ্চিত নামে অভিহিত করা হতো। সমুদ্র পাহাড়ের প্রায় পুরো অংশ জুড়ে এই ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ করা হয়েছে। দেবতা, মানুষ, জীবজন্তু প্রকৃতির সবকিছুই এতে স্থান পেয়েছে। মূর্তিগুলি যেমন স্বাভাবিক তেমনি সজীব। শিল্প সমালোচকরা এটিকে সর্বকালের ভাস্কর্য বলে মনে করেন।

এছাড়া কৃষ্ণ মন্ডপের কাছে একটি ষাঁড় সহদেব রথ সংলগ্ন একটি হাতি দৌপদী রথের সম্মূখে দণ্ডায়মান সিংহ, অর্জুন রথের পাশে অবস্থিত একটি ষাঁড় ইত্যাদি মহাবলি পুরমের চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ভাস্কর্য মন্দির গুলিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

পল্লব চিত্রকলা:


পল্লব যুগের শিল্পকলার প্রভূত সমাদর ছিল। প্রথম মহেন্দ্র বর্মনের রাজত্বকালে সিওন ভাসল এর জৈন মন্দিরে অপূর্ব চিত্রকলার নিদর্শন আছে। এছাড়াও মহেন্দ্র বর্মনের আমলেই কিছু গুহামন্দির যেমন- মামুন্দুরে পল্লব চিত্রকলার অল্প কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়া পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মনের আমলে নির্মিত পনম লই ও কাঞ্চী পুরের মন্দিরগুলিতে পল্লব চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। পনমলই মন্দিরে রয়েছে শিবনৃত্য প্রতক্ষরতা, পার্ব্বতী চিত্রাকাঞ্চীর কৈলাশনাথ মন্দির গাত্রে আছে সোমস্কন্দ অর্থাৎ শিব, পার্বতী ও তাদের পুত্র স্কন্ধ অর্থাৎ কার্তিক।


পল্লব রাজ্যের অভ্যুত্থান ভারতের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। অসংখ্য যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়েও পল্লব নৃপতিরা স্থাপত্য-ভাস্কর্য, চিত্রকলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের উন্নতিকল্পে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ভারতের একদিকে যেমন ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে, তেমনি অন্যদিকে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান জয়যাত্রা শুরু হয়।

Share
error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading