বাংলা নাটকের প্রথম যুগে একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ব। বাংলা নাটকে প্রথম বাস্তব জীবন, একই সলো হাস্যরসের আমদানির জন্য তাঁকে উপমা দেওয়া হয়েছিল ‘নাটুকে রামনারায়ণ’। রামনারায়ণ তর্করত্নের যাবতীয় খ্যাতি ‘কুলীনকুল সর্বস্থ’ নাটকের জন্য। বাংলা নাটকের ইতিহাসে প্রথম সামাজিক নাটক ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’। কৌলিন্য প্রথার বিষময় ফলকে তুলে ধরার জন্য রামনারায়ণ এই নাটক লেখেন। সেদিক থেকে ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটককে উদ্দেশ্যমূলক নাটকও বলা যেতে পারে। এ নাটক সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই জানিয়েছেন-“পুরাকালে বল্লাল ভূপাল, আবহমান প্রচলিত জাতি মর্যাদা মধ্যে স্বকপোলকল্পিত প্রচার করিয়া যান। তৎপ্রথায় অধুনা বলাস্থলী যেরূপ দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছে, তদ্বিষয়ে কোনো প্রস্তাব লিখিতে আমি নিতান্ত অভিলাষী ছিলাম।” এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার চার বিবাহযোগ্যা কন্যার বিবাহ দিতে না-পারায় যে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং একই সঙ্গে চার কন্যার বিবাহকে কেন্দ্র করে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল, তা নাট্যকার দেখিয়েছেন। নাট্যকারের উদ্দেশ্য যেহেতু সমাজ সংশোধন, আর তা করেছেন হাস্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে। ফলে নাটকের চরিত্রগুলি টাইপ চরিত্র হয়ে উঠেছে। এমনকি হাস্যরস সৃজনের জন্য নাট্যকার চরিত্রগুলির নামও কৌতুকবহ করে তুলেছেন-বিবাহবাতুল, বিবাহবণিক, অভব্যচন্দ্র, অধর্মবুচি ও , অনৃতাচার্য। লঘু সংলাপে ও পরিবেশগুণে নাটকে এক আপাত মাধুর্য লক্ষ করা যায়, যা হাস্যরস সৃজনে সক্ষম-
“কি বলিব দিদি মোর কপালের গুণ।
দেখ কপালের গুণ লো কপালের গুণ।।
নগরে উঠিতে লাগে বাজারে আগুন।
দিদি বাজারে আগুন লো বাজারে আগুন।।
‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম নাটক যেখানে নারীজীবনের শোষণের দিকগুলি তুলে ধরা হয়েছে। নাটকটি ছ-টি অংশে বিভক্ত। প্রত্যেক অংশের সঙ্গে প্রত্যেক অংশের তেমন যোগ নেই। সংযোগ রক্ষা করতে পারেননি নাট্যকারী। ভাষ্য হয়ে উঠেছে কাব্যগন্ধী। উপমা, অনুপ্রাসের বহুল প্রয়োগ লক্ষ করা যায়-
“বসন্ত অশান্ত বড়ো দুরন্ত নিতান্ত।
বিরহী বধিতে বুঝি হইল কৃতান্ত।।
কূটিল বিরহিমন বকুল।
জুটিল মধুপাবলি হইয়া ব্যাকুল।।”
মধুসুদনের গ্রহসনগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত দুটি প্রহসন রচনা করেছেন। যথা-‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০)। প্রহসন মূলত সমাজের নঞর্থক দিকগুলিকে ব্যলা করতেই রচনা করা হয়। মধুসূদনও সে অর্থেই এ দুটি প্রহসন রচনা করেছেন। মধুসূদনের দুটি গ্রহসন বাংলা নাট্যসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। হাসারস ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজে অসংগতি তুলে ধরাই যদি প্রহসনের প্রধান উদ্দেশ্য হয় তবে মধুসূদনের দুটি গ্রহসনকে প্রথম শ্রেণিতে রাখতে হবে। ইয়ংবেঙ্গলের পদস্খলন নিয়ে মধুসূদন লিখলেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ গ্রহসন। উনিশ শতকের যে বাবু কালচার তা যেন ব্যঙ্গ করতেই এই গ্রহসন লেখা। জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা, নবকুমার, কালীনাথ, মহেশ, বলাইয়ের মধ্য দিয়ে হাস্যরস সৃজন করেছেন নাট্যকার। ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী’ সভার সদস্যদের উদ্দেশ্য হরকামিনী বক্তব্যে সব প্রকাশ পেয়ে যায়-“মদ মাস খেয়ে ঢলাঢলি কল্পেই কি সভ্য হয়?-একেই কি বলে সভ্যতা?” রামগতি ন্যায়রত্ন এ প্রহসন সম্পর্কে লিখেছেন-“আমাদিগের বিবেচনায় এরূপ প্রকৃতির যতগুলি পুস্তক হইয়াছে, তন্মধ্যে এইখানি সর্বোৎকৃষ্ট।”
‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে মধুসূদনের লক্ষ্য প্রাচীন সমাজ। লোকাচারসর্বস্ব যে হিন্দু সমাজ, তার গভীরে যে ভন্ডামি, তা মধুসূদন দেখিয়ে দেন ভক্তপ্রসাদের মাধ্যমে। বাইরে ঈশ্বরবিশ্বাসী ও হিন্দু সমাজের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষায় সদা সচেষ্ট ভক্তপ্রসাদ অন্তরে অন্তরে অর্থলোলুপ ও নারীর প্রতি আসক্ত। ভক্তপ্রসাদের এই চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে ফতেমা। প্রহসনটি দুই অঙ্কবিশিষ্ট। ভক্তপ্রসাদ সচেতন জমিদার। প্রজার খাজনা সে কিছুতেই মাপ করে না। অথচ নারী-পিপাসার সময় সে উদার। জীবনের রস যেন কানায় কানায় পূর্ণ। নারীর রূপময়ী চেহারা দেখলে তাঁর ভারতচন্দ্রের কবিতার কথা মনে আসে। বঙ্গীয় জমিদারদের প্রকৃত স্বরূপ মধুসূদন এই প্রহসনের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। উনিশ শতকে এ-দুটি প্রহসন বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর প্রহসনে মধুসুদন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ভক্তপ্রসাদের চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ নাটকের শেষে উন্মোচিত হয়েছে। সে সকলের হাসির পাত্র হয়ে উঠেছে- “বাইরে ছিল সাধুর আকার, মনটা কিন্তু ধৰ্ম্ম-ধোয়া। পুণ্য-খাতায় জমা শূন্য, ভণ্ডামিতে চারটি পোয়া।”