দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ইতিহাসাশ্রিত নাটক-
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩–১৯১৩) ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার ও গীতিকার। তিনি কাব্যনাট্য ও ইতিহাসাশ্রিত নাটকের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর নাটকগুলোতে আধুনিক বাংলা নাট্যের আধিক্য, নাট্যকলার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ঐতিহাসিক ঘটনার চিত্রায়ণ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষভাবে তাঁর ইতিহাসাশ্রিত নাটকগুলোর মধ্যে যুগান্তকারী স্থান রয়েছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ইতিহাসাশ্রিত নাটকগুলো
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ইতিহাসাশ্রিত নাটকগুলো মূলত ভারতীয় ইতিহাসের গৌরবময় মুহূর্তগুলির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। তিনি ইতিহাসের নানা অধ্যায়কে নাট্যরূপে উপস্থাপন করে বাংলা নাটককে গভীর এবং বৈচিত্র্যময় করেছেন। এসব নাটক শুধু ইতিহাসের বর্ণনা নয়, বরং মানবীয় আবেগ, চেতনা ও ঐতিহ্যকেও ফুটিয়ে তুলেছে।
১. বাংলা নাট্যের প্রথম ইতিহাসাশ্রিত নাটক—”বিদ্যাসুন্দর”
দ্বিজেন্দ্রলালের লেখা প্রথম ইতিহাসাশ্রিত নাটক “বিদ্যাসুন্দর” (১৮৯০) ছিল ভারতের একটি মিথ ও ইতিহাসের মিশ্রণ। নাটকটি রাজা গৌতমপুরের বিদ্যাসুন্দর নামক এক রাজপুত্রের জীবনের গল্প বলে, যে জীবনদর্শন, প্রেম, এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে গৌরব অর্জন করে। এখানে ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে রাজাদের আদর্শ, রাষ্ট্রনায়কত্ব এবং ধর্মীয় চেতনার আলোকে নাটকটি গড়ে উঠেছে। নাটকটি ইতিহাসের সত্য এবং মিথের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করে।
২. “অলকার”
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাটক “অলকার” (১৮৯৩)। এটি ইতিহাসের বাস্তব চরিত্র, বিশেষত রাজপুত রাজবংশের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী তুলে ধরেছে। অলকার একজন বিধর্মী রাজপুত্র, যে সিংহাসন দখল করতে গিয়ে মানবিকতা হারায়, এবং নাটকের শেষে নৈতিক পরিণতির শিকার হয়। এই নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় শুধু ইতিহাসের বর্ণনা দেননি, পাশাপাশি মানবিক ত্রুটি ও রাজনৈতিক নীতির চরম পরিণতি তুলে ধরেছেন। নাটকটি দর্শকদের রাজনীতি, ধর্ম এবং মানবাধিকার সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
৩. “মেঘনাদবধ কাব্য”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অন্যতম সফল ইতিহাসাশ্রিত নাটক “মেঘনাদবধ কাব্য” (১৯০১)। এটি রামায়ণের মেঘনাদ চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত। নাটকে মেঘনাদের মৃত্যুর পর তার পিতার প্রতিশোধ এবং ভারতের পুরাণের ঐতিহাসিক শক্তি নিয়ে নাটকটি আধুনিক দর্শকদের নৈতিকতা, রাজনীতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের পেছনে থাকা মানবিক সংকটগুলো বুঝতে সাহায্য করে।
৪. “চন্দ্রগুপ্ত”
“চন্দ্রগুপ্ত” (১৯১২) দ্বিজেন্দ্রলালের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নাটক, যা ভারতীয় ইতিহাসের মহান সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে নিয়ে রচিত। এই নাটকে চন্দ্রগুপ্তের জীবন ও বিজয়ের কাহিনির মধ্য দিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ ও দেশপ্রেমের মর্মকথা ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটকটির মধ্য দিয়ে তিনি দেশপ্রেম, শাসনব্যবস্থা, নেতৃত্ব এবং ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
উপসংহার
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ইতিহাসাশ্রিত নাটকগুলো বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। তিনি নাট্যকলার মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাস, পুরাণ এবং নৈতিক দর্শনের একটি নতুন রূপ উপস্থাপন করেন। তাঁর নাটকগুলো আধুনিক বাংলা নাটকের ভিত্তি তৈরি করেছে এবং দর্শকদের জীবনের মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এবং মানবিক চেতনাকে গভীরভাবে অনুভব করতে সহায়তা করেছে।