দেহ-মন সম্পর্কে সমান্তরালবাদ বিচারসহ ব্যাখ্যা কর
সাধারণভাবে মনের সংজ্ঞায় বলা যায় যে, মন হলো এমন কিছু যা নিজের অবস্থা এবং ক্রিয়াগুলো সম্পর্কে সচেতন। মনের স্বরূপ-লক্ষণ হলো যার দ্বারা মনকে জড় ও প্রাণ থেকে আলাদা করে। মনকে তিনটি অর্থে গ্রহণ করা যায়। যথা-
(১) মন বলতে চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক ক্রিয়াগুলোর সমষ্টিকে বুঝায়। এদের আড়ালে কোনো স্থায়ী অপরিবর্তিত সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না৷
(২) মন বলতে চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা- এসব মানসিক ক্রিয়াগুলো থেকে স্বতন্ত্র দেহাতিরিক্ত একক ‘স্থায়ী, অপরিবর্তিত আধ্যাত্মিক সত্তাকে বুঝায়’।
(৩) মন বলতে বুঝায় এমন মূর্ত আধ্যাত্মিক ঐক্যের সম্বন্ধ যা চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়ার অতিরিক্ত কোন কিছু নয়, অথচ যা চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে।
দেহ ও মনের সম্পর্কঃ দেহ ও মনের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা যায়। মানুষ রেগে গেলে তার দৈহিক পরিবর্তনগুলোতে রাগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমনঃ চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে, রক্তের চাপ বেড়ে যায়, দেহে কম্পন দেখা যায় ইত্যাদি। আবার মস্তিষ্কে যদি কোনো গুরুতর আঘাত লাগে তবে চেতনশক্তি লোপ পায়। মস্তিষ্কের বৈকল্য অনেক প্রকার মানসিক রোগের কারণ। দেহ ও মনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও এই সম্পর্কের আসল স্বরূপ বুঝা যায় না। এই সম্পর্কের স্বরূপ নিয়ে দার্শনিকগণ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। এরই দু’টি মতবাদ হচ্ছে- (১) ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়াবাদ এবং (২) সমান্তরালবাদ।
(১) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদঃ ডেকার্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের সমর্থক। তার মতে, দেহ ও মন দু’টি পৃথক সত্তা। দেহ বিস্তৃতিসম্পন্ন, কিন্তু মনের কোনো বিস্তৃতি নেই। দেহের চেতনা নেই, কিন্তু মনের চেতনা আছে। দেহ যান্ত্রিক নিয়মের অধীন, মর্ন উদ্দেশ্য বা আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং দেহ ও মনের দ্বৈতভাবই লক্ষ করা যায়। কিন্তু ডেকার্ট বলেন, তবুও তাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। জ্ঞানের বেলায় দেহ মনের ওপর কাজ করে আর কাজ করার সময় মন দেহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কোনো কিছু জানতে গেলে ইন্দ্রিয়ের সাথে বস্তুর সন্নিকর্ষ হয়। এই সন্নিকর্ষ দেহের স্নায়ুতন্ত্রীতে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। মন যখন এই উত্তেজনার কারণ নির্দেশ করে ব্যাখ্যা দেয়, তখনই জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। সুতরাং জ্ঞানলাভের সময় দেহও মনের ওপর কোনো একটা উত্তেজনা চাপিয়ে দেয়, তার ফলেই জ্ঞান হয়। মনে যদি কাজ করার ইচ্ছা না থাকে তবে কাজ করা যায় না।
সমালোচনাঃ দর্শনে কোনো মতবাদই ত্রুটিমুক্ত নয়। সুতরাং অন্যান্য মতবাদের ন্যায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ও সমান্তরালবাদেরও সমালোচনা আছে। নিম্নে সমালোচনাগুলো তুলে ধরা হলোঃ
(১) মানুষের ইচ্ছার ক্ষেত্রে কার্যকারণ কার্যকর নয়ঃ দেহ ও মন যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি সত্তা হয় তাহলে দেহ ও মনের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক কীভাবে ঘটতে পারে? কার্য ও কারণ সমজাতীয় না হলে তাদের পক্ষে পরস্পরকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। একটি কঠিন দ্রব্যকে আর একটি কঠিন দ্রব্য দিয়ে আঘাত করা যেতে পারে, কিন্তু মানুষের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়কে কোনো কঠিন বস্তু দিয়ে আঘাত করা যায় না।
(২) ডেকার্টের মত অপূর্ণঃ ডেকার্টের মতে জড়ের বা দেহেরই স্থানব্যাপ্তি আছে, কিন্তু মনের কোনো ব্যাপ্তি নেই। তাহলে মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পিনিয়েল গ্রন্থিতে মনের অবস্থান কীভাবে সম্ভব?
(৩) এ মত দেহ ও মনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেয় নাঃ ডেকার্ট দেহ ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কীভাবে হয় ব্যাখ্যা না করে কোথায় এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংগঠিত হয়, সেটুকু মাত্র নির্দেশ করেছেন।
(৪) এ মত শক্তির নিত্যতা-নীতিবিরুদ্ধঃ ডেকার্টের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ স্বীকার করলে ‘শক্তির নিত্যতা-নীতি’ ভঙ্গ করতে হয়।
সমান্তরালবাদঃ দার্শনিক স্পিনোজা সমান্তরালবাদের প্রবক্তা। সমান্তরালবাদ অনুসারে দেহ ও মনের মধ্যে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্ভব নয়। দেহ ও মন পাশাপাশি থাকে। যেমন দু’টি সমান্তরাল সরলরেখা পাশাপাশি থাকলেও কোনো একটি অপরটিকে প্রভাবিত করতে পারে না। স্পিনোজার মতে, ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য। এই ঈশ্বরের অসংখ্য গুণ আছে। এই অসংখ্য গুণের মধ্যে আমরা মাত্র দু’টি গুণই জানি- দেহ বা বিস্তৃতি এবং মন বা চৈতন্য। দেহ বা মন ঈশ্বরের দুই সমান্তরাল গুণ। দেহে যখন কোনো পরিবর্তন হয় তখন মনের অনুরূপ পরিবর্তন ঘটে থাকে। ঈশ্বরের মধ্যে চিরকাল দেহ ও মন পাশাপাশি দেখা যায়। সমান্তরালবাদ অনুসারে দেহ ও মন একই ঈশ্বরের দু’টি দিক।
সমান্তরালবাদ দেহ ও মনের কাছে সম্পর্ক স্বীকার করে; কিন্তু এ কথা বলে যে, এ সম্পর্ক কার্যকারণিক সম্পর্ক নয়। কেননা দেহ ও মন দু’টো পৃথক জিনিস, যে কারণে কার্যকারণিকভাবে একটি আরেকটির ওপর ক্রিয়া করতে সক্ষম নয়। এ মতবাদ মনে করে যে, দেহ ও মন হচ্ছে দু’টি ঘড়ির মতো, যেখান দু’টিরই নিজস্ব কার্যপদ্ধতি রয়েছে। আর এদের মধ্যে যদিও কোনো কার্যকারণিক সম্পর্ক নেই, তথাপি এরা সব সময় পর্যায়ক্রমে একই সময় দিয়ে থাকে। দেহ ও মন সহ অবস্থান করে এবং একটি অপরটির উপর কার্যকারণের মাধ্যমে ক্রিয়া করে না বরং এ দু’টি একই ক্রমে ক্রিয়া করে, অর্থাৎ সমান্তরালভাবে চলে। এ মতে, ঈশ্বর একমাত্র দ্রব্য। দেহ ও মন যেহেতু একই ঈশ্বরের দু’টি প্রকাশ বা দিক, সেহেতু প্রতিটি মানসিক ক্রিয়ার অনুরূপ একটি দৈহিক ক্রিয়া এবং প্রতিটি দৈহিক ক্রিয়ার অনুরূপ একটি মানসিক ক্রিয়া আছে। দেহে যখন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়, তখন অনুরূপ পরিবর্তন দেহে দেখা দেয়। যদিও উভয়ের মধ্যে কোনো কার্যকারণিক সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ সমান্তরালবাদ মানসিক ও দৈহিক ঘটনার মধ্যকার পারস্পরিক সম্বন্ধের বিষয়কে স্বীকার করে, কিন্তু এদের মধ্যে যে প্রত্যক্ষ কার্যকারণিক সম্পর্ক রয়েছে, এ কথা অস্বীকার করে। স্পিনোজা দেহ ও মনকে ঈশ্বরের দু’টি আকৃতি বলে মনে করেন। তাই সমান্তরালবাদকে কেউ কেউ দ্বৈতাকৃতিবাদও বলেন।
সমালোচনাঃ সমান্তরালবাদও ত্রুটিমুক্ত নয়, নিম্নে তা আলোচনা করা হলোঃ
(১) এ মত মনের উৎকর্ষকে স্বীকার করে নাঃ সমান্তরালবাদ দেহের তুলনায় মনের উৎকর্ষকে স্বীকার করে না। মন দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজের বাসনা মনেই জাগে এবং দেহের মাধ্যমেই তা পূর্ণ হয়। সুতরাং মনের প্রাধান্যকে অস্বীকার করা যায় না৷
(২) এ মত অযৌক্তিকঃ প্রতিটি ক্রিয়ার সমান্তরাল মানসিক ক্রিয়ার অস্তিত্ব স্বীকার করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
(৩) এ মত জগৎকে বিভক্ত করেঃ সমান্তরালবাদ বিশ্বজগৎকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে এবং দেহ ও মনের সম্পর্কের সমস্যার ব্যাখ্যার পরিবর্তে সমস্যাটাই অস্বীকার করে বসেছে।
(৪) এ মতবাদ অপূর্ণঃ আকস্মিক ঘটনার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা সমান্তরালবাদে পাওয়া যায় না।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেহ ও মনের সম্পর্কবিষয়ক মতবাদ হিসেবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ও সমান্তরালবাদ কোনোটাই সন্তোষজনক নয়। কারণ এ দু’টি মতবাদই দেহ ও মনকে আলাদা দু’টি পৃথক সত্তা বলে ব্যাখ্যা দিয়েছে। আসলে দেহ ও মন আলাদা দু’টি সত্তা হতে পারে না। কারণ এ দু’টি বিষয়ই ঘনিষ্ঠভাবে সহাবস্থান করে এবং উভয়েই পরমাত্মার ভিন্ন প্রকাশ।