টিপু সুলতানের অধীনে মহীশূরের সাথে ব্রিটিশ সম্পর্ক এবং অ্যাংলো-মহীশূর সংঘর্ষ
টিপু সুলতান (১৭৫১–১৭৯৯) ছিলেন মহীশূরের ভারতীয় উপমহাদেশের এক অন্যতম শক্তিশালী শাসক এবং দক্ষিণ ভারতের স্বাধীনতার প্রতীক। তার পিতা হায়দার আলির, উত্তরাধিকার হিসেবে মহীশূরের সিংহাসনে বসেন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার রাজত্বকাল ব্রিটিশদের সাথে একাধিক সংঘর্ষ এবং ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে ভারতের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।
মহীশূরের সাথে ব্রিসম্পর্ক একটিএকটি পটভূমি
১. হায়দার আলি এবং ব্রিটিশ সম্পর্ক
- টিপুর পিতা হায়দার আলি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
- তার শাসনকালে প্রথম এবং দ্বিতীয় অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
- ব্রিটিশদের সঙ্গে ফরাসি মিত্রদের নিয়ে তার জোট দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
২. টিপু সুলতানের উত্থান
- টিপু সুলতান তার পিতার পরে মহীশূরের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং একইভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখেন।
- তার শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ধ্বংস করা এবং তার রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
৩. ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক ও সামরিক আগ্রাসন
- মহীশূর ছিল বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ এবং সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী।
- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ ভারতের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল, যা মহীশূরের সাথে তাদের সংঘর্ষকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধ
টিপু সুলতানের আমলে চারটি অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং মহীশূরের শাসকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রতিফলন।
১. প্রথম অ্যাংলো–মহীশূর যুদ্ধ (১৭৬৭–১৭৬৯)
- টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলি এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
- ফরাসি হায়দারআলিহায্যে হায়দার আলি ব্রিটিশদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন।
- যুদ্ধের পর মাদ্রাজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সাময়িকভাবে ব্রিটিশ-মহীশূর সংঘর্ষ থামায়।
২. দ্বিতীয় অ্যাংলো–মহীশূর যুদ্ধ (১৭৮০–১৭৮৪)
- টিপু সুলতান তার পিতার সাথে ব্রিটিশদের বি•ফ্রান্সতৃত্ব দেন।
- ফ্রান্স এবং মহীশূরের মিত্রতা যুদ্ধের এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
- যুদ্ধের শেষে ১৭৮৪ সালের “ম্যাঙ্গালোর চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে ব্রিটিশরা টিপুর শক্তি স্বীকার করে।
৩. তৃতীয় অ্যাংলো–মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯০–১৭৯২)
- টিপু সুলতান স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যান এবং ফ্রান্স ও অন্যান্য বিদেশি শক্তির সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন।
- ব্রিটিশ, মারাঠা, এবং হায়দারাবাদের নিজাম একত্রে টিপুর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।
- যুদ্ধ শেষে “শ্রীরঙ্গপট্টনম চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে টিপু মহীশূরের অর্ধেক অঞ্চল ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর করেন।
৪. চতুর্থ অ্যাংলো–মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯৯)
- ফরাসি বিপ্লব এবং ফ্রান্সের সাথে টিপুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ব্রিটিশদের মধ্যে ভয় তৈরি করে।
- লর্ড ওয়েলেসলির নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনারা শ্রীরঙ্গপট্টনম আক্রমণ করে।
- এই যুদ্ধে টিপু সুলতান নিহত হন এবং মহীশূর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
নবায়নকৃত ফরাসি ভীতির ভূমিকা
১. ফরাসি বিপ্লব এবং ভারতীয় রাজনীতি
- ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব ইউরোপ এবং উপমহাদেশে ব্রিটিশদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
- ফ্রান্সের প্রভাব দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি এবং সামরিক কৌশলে বিশেষ প্রভাব ফেলে।
২. ফ্রান্স–মহীশূর জোট
- টিপু সুলতান ফরাসি মিত্রদের কাছ •তিনিমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।
- তিনি ফ্রান্সের বিপ্লবী নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন এবং সামরিক সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান।
৩. ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়া
- ফ্রান্স-মহীশূর জোট ব্রিটিশদের কাছে ভারতের স্বাধীন রাজ্যগুলোর প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দেয়।
- ব্রিটিশরা টিপুকে “ফরাসি আগ্রাসনের প্রতীক” হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়।
৪. টিপুর ফরাসি সৈন্য আমন্ত্রণ
- টিপু তার রাজ্যে ফরাসি সৈন্যদের আমন্ত্র•শ্রীরঙ্গপট্টনমেক প্রশিক্ষণও দেন।
- শ্রীরঙ্গপট্টনমে টিপুর দ্বারা ফরাসি বিপ্লবের পতাকার অনুকরণে একটি পতাকা উত্তোলন করা হয়।
টিপু সুলতানের শাসনের প্রভাব
১. মহীশূরের সামরিক শক্তি
- টিপু সুলতান তার শাসনামলে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন।
- মহীশূরের সামরিক ক্ষমতা দক্ষিণ ভারতের ব্রিটিশ আধিপত্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
২. কূটনৈতিক নীতি
- টিপু ফ্রান্স, তুরস্ক, এবং পারস্যের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে একটি আন্তর্জাতিক সমর্থন কাঠা•টিপু তোলেন।
৩. অর্থনৈতিক সংস্কার
- টিপু সুলতান মহীশূরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- বাণিজ্য, কৃষি, এবং শিল্পক্ষেত্রে তার উদ্যোগ দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ় করে।
উপসংহার
টিপু সুলতানের শাসনকালে মহীশূর এবং ব্রিটিশদের সম্পর্ক ছিল দ্বন্দ্বপূর্ণ। ফরাসি বিপ্লব এবং ফ্রা�তার ইতিহাসে এক অনুপ্রেরণাদায়ক প্রতীক হয়ে থাকেন।