জীবনব্যাপী শিক্ষার ঐতিহাসিক পটভূমি ব্যাখ্যা করুন। Explain the historical background of lifelong learning

জীবনব্যাপী শিক্ষার ঐতিহাসিক পটভূমি :

মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষা গ্রহণ করে আর শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় শিক্ষা হলো জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া শিক্ষা জ্ঞান সংগ্রহের কৌশল নয় শিক্ষা হলো শেখার একটি প্রক্রিয়া যা জ্ঞানঅর্জনদক্ষতামূল্যবোধ বিশ্বাস অভ্যাসের একটি প্রক্রিয়া বরং বৃহত্তর জীবন বিকাশের প্রক্রিয়া বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে তার পেছনে একটি দীর্ঘ অতীত রয়েছে যে অতীতের ক্রমবিবর্তনের ফল আজকের শিক্ষাব্যবস্থা তাই সময়ের ব্যবধানে যুগের চাহিদা বিবেচনায় শিক্ষায় অনেক নতুন ধারণা নতুন বিষয়বস্তু যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে তেমনি অনেক কিছু বাদও পড়েছে তাছাড়া মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিতবঞ্চিত ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো শিক্ষা

প্রাগৈতিহাসিককালে বয়স্ক ব্যক্তিদের মাধ্যমে সমাজের যুবকদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাজ্ঞান দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রাকশিক্ষিত সমাজ মূলত মৌখিকভাবে অনুকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে গল্পবলার মাধ্যমে জ্ঞানমূল্যবোধ দক্ষতা এক প্রজন্মের থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। এভাবে সাংস্কৃতিক দক্ষতা প্রসারণের ফলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে। পরবর্তীকালে প্লেটো এথেন্সে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। যা ইউরোপের প্রথম উচ্চতর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরে আলেকজান্দ্রিয়ার শহরটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এথেন্সের বুদ্ধিবৃত্তিক প্যাড হিসেবে এটি প্রাচীন গ্রিসে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। শিক্ষা বিস্তারের জন্য আলেকজান্দ্রিয়ার বৃহত্তর গ্রন্থাগারটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমের পতনের পর ইউরোপীয় সভ্যতায় স্বাক্ষরতা এবং সংগঠনের পতন ঘটে। রোমের পতনের পর ক্যাথলিক চার্চ পশ্চিম ইউরোপে স্কলারশিপের একমাত্র রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠে। তবে চার্টার্স ক্যাথিড্রাল স্কুলকে আধুনিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ পর্যন্ত মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউরোপের বিভিন্ন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এক্ষেত্রে উচ্চ মধ্যযুগের সময় চার্টার্স ক্যাথিড্রাল দ্বারা বিখ্যাত প্রভাবশালী চার্টার্স ক্যাথিড্রাল এর মাধ্যমে স্কুল পরিচালিত হয়

১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বলোনি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম এবং প্রাচীনতম অপারেটিং ইউনিভার্সিটি বলে ধারণা করা হয়। মধ্যযুগীয় সময়ে মধ্যপ্রাচ্য ইসলামিক খলিফার অধীনে ইসলামিক বিজ্ঞান গণিত সমৃদ্ধ হয়। যা পশ্চিম আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে পূর্ব সিন্ধু পর্যন্ত এবং দক্ষিণে আলমোরাভিড রাজবংশ মালির সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। ইউরোপে রেনেসাঁ প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিবৃত্তিকের নতুন যুগের সূচনা ঘটে। এদিকে প্রায় ১৪০০ সালের দিকে জোহানেস গুটেনবার্গ একটি প্রিন্টিং প্রেস তৈরি করেন। এর ফলে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের যুগে ইউরোপীয় দর্শনধর্মশিল্প বিজ্ঞান বিষয়ক ধারণাগুলো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মিশনারি পণ্ডিতরা অন্যান্য সভ্যতা থেকে নতুন ধারণা নিয়ে আসে। জেসুইট চীন মিশনের সাথে তারা চীন ইউরোপের মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞান সংস্কৃতি প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে জ্ঞানদানের মাধ্যমে ইউরোপে আরও নিরপেক্ষ শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ছিল

প্রাচীন ভারতের সর্বপ্রথম শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বৈদিক শিক্ষা। বৈদিক শব্দটি এসেছেবেদথেকে আর বেদ হলো প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ এমন একটি বৃহদাকার গ্রন্থ। গ্রন্থের মূলে রয়েছে বৈদিক শিক্ষার রীতিনীতি কলাকৌশল। যা শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে অনেকে ধারণা করে। কারণে বেদ হলো বৈদিক শিক্ষার মূল উৎস। বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদান ছিল গুরুকেন্দ্রিক আর যে পদ্ধতিতে পাঠদান শুরু করে। সে পদ্ধতির নাম হলো শ্রুতি পদ্ধতি। তাছাড়া সময়ে শিক্ষার্থীরা শুনে শুনে শিক্ষালাভ করেন। বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু ব্রাহ্মণরাই শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পায়। বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাস বা বৌদ্ধ মতামতের আলোকে গড়ে ওঠেছিল বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা। বৌদ্ধ শিক্ষাদানের কেন্দ্রকে বৌদ্ধ বিহার বলা হয়। বৌদ্ধরাই দেশে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যা হাকে বিহারকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয় বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে শ্রেণি শিক্ষণের উদ্ভব ঘটে। কারণ তখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার জায়গা দখল করে নেয় দলকেন্দ্রিক শিক্ষা। প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ শিক্ষায় যার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আর তিনি হলেন অতীশ দীপস্কর শ্রীজ্ঞান। তাঁর বৌদ্ধ শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যা আজও দৃশ্যমান। বৌদ্ধরা ৫ম শতকে বিহারে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন স্থানে আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথে ভাষা শিল্পসাহিত্যের ধারা অনেকাংশেই বদলে যায়। মুসলমানদের প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। মুসলমানরা ধর্মীয় প্রয়োজনে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করে। সকল মসজিদ শুধুমাত্র ধর্মীয় কাজেই ব্যবহার হয়নি বরং শিক্ষাদান করাও হতো। তবে কম সময়ের মধ্যে মসজিদভিত্তিক অনেক মক্তব মাদ্রাসা গড়ে ওঠে আর কারণেই সহজে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হতো। এক সময় ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষাও দেয়া হয়। মুসলিম আমলে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নেতৃত্বে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষারও মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। সুলতান ইলতুৎমিস তাঁর শাসনামলে বহুসংখ্যক মক্তব মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর রাজধানী ফিরোজাবাদে একটি সুবিশাল মাদ্রাসা স্থাপন করেন। মুসলমানদের আগমনে ভাষায় অনেকটা পরিবর্তন আসে আর সুলতানি আমলে সাধারণ মানুষ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পায়। বাংলার স্বাধীন সুলতানরা মুসলমান হিন্দু শিক্ষাধারার মধ্যে এক চমৎকার সমম্বয় ঘটিয়ে একটি বিশেষ শিক্ষাধারা প্রবর্তন করতে সক্ষম হন সে সময়ে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়। শিক্ষাকেন্দ্রে প্রখ্যাত আলমগণের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ফলে মোঘল আমলে অনেক হিন্দু ফারসি ভাষা শেখায় অগ্রহী হয় আর কারণে হিন্দুরাও তখন মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করতো১৫৫৬ সালে বণিক পর্তুগিজরাই ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ছাপাখানা স্থাপন করেন। তখন থেকে মুদ্রিত পাঠ্যসামগ্রীর প্রচলন ঘটে। ভারতীয় উপমহাদেশে পর্তুগিজদেরকে একমাত্র আধুনিক শিক্ষা সূচনাকারী বলা হয়।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading