ছোটোগল্পকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃতিত্ব আলোচনা করো

ছোটোগল্পকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :-

যাঁরা শুধু সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকেন না, সৃষ্টিকে আপন প্রতিভা বলে গৌরবের চরমসীমায় স্থাপন করেন, তেমনই এক অসামান্য স্রষ্ঠা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা তিনি। তিনিই এর পূর্ণতাদানকারী।

গল্পগ্রন্থ: রবীন্দ্রনাথ তাঁর “সোনার তরী” কাব্যের “বর্ষাযাপন” কবিতায় ছোটগল্পের রূপ নির্মিতি ব্যাখ্যা করেছেন এবং সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী অসংখ্য সার্থক ছোটোগল্প রচনা করেছেন। তাঁর ছোটোগল্প গ্রন্থের সংখ্যা মোট পাঁচটি। “গল্পগুচ্ছ”(১ম, ২য়, ৩য়), “লিপিকা”, “সে”, “তিনসঙ্গী” ও “গল্পস্বল্প”।

পর্ব বিভাগ:  রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলি তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। 1891- 1901  পর্যন্ত “সাধনা” ও “হিতবাদী” পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলি প্রথম পর্বের গল্প। এর মধ্যে আছে “অতিথি”, “কঙ্কাল”, “ছুটি”, “কাবুলিওয়ালা”, “মনিহারা”, “নষ্টনীড়”, “পোস্টমাস্টার” প্রভৃতি। “সবুজপত্র”-কে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় পর্বের সূচনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “হালদার গোষ্ঠী”, “স্ত্রীরপত্র”, “ভাইফোঁটা”, “অপরিচিতা”, “বলাই”, “চিত্রকর” প্রভৃতি। “সে”, “তিনসঙ্গী”, “গল্পস্বল্পের” গল্পগুলি তৃতীয় পর্বের। “রবিবার”, “শেষ কথা”, “ল্যাবরেটরি”,  “সওগাত”, “তোতাকাহিনী” এই পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্প।

  অবদান:

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে মানুষ, প্রকৃতি ও অন্তহীন রহস্যলোকের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গ্রাম্য ও নাগরিক জীবনের নানা ছবি, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনদশা,পারিবারিক বিরোধ, স্নেহ-প্রেমের সংঘাত, সংস্কারের সঙ্গে মানব ধর্মের বিরোধ ও পরিশেষে মানব ধর্মের জয় প্রভৃতি সুনিপুণভাবে বর্ণিত হয়েছে তার গল্পে।

বাস্তবতা: তাঁর সমাজ ও পারিবারিক গল্পগুলিতে প্রেম, সৌন্দর্য ও কল্পনার বিচিত্র সমন্বয় ঘটেছে এবং তা গল্পের বাস্তবতাকে ক্ষুন্ন করেনি।

দৈনন্দিন জীবন পরিচিতি: “পোস্টমাস্টার”, “কাবুলিওয়ালা”, “ছুটি” প্রভৃতি গল্পে স্নেহপ্রেমের যে পারিবারিক রূপ ফুটে উঠেছে তা কবির দৈনন্দিন জীবন পরিচিতির নিবিড় রসে পূর্ণ।

গীতিকাব্যিক স্পর্শ: “মেঘ ও রৌদ্র”, “অতিথি”, “আপদ” প্রভৃতি গল্পে উদার বিশাল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিটোল গীতিকাব্যিক স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

অতিপ্রাকৃত:  “ক্ষুধিত পাষাণ”, “নিশীথে”, “মনিহারা” প্রভৃতি অতিপ্রাকৃত কাহিনীমূলক গল্পে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলেও অশরীরী আত্মার আবির্ভাব নেই। আছে বিকারগ্রস্ত মানুষের অন্তর্জীবনের পরিচয়- এ ধরনের মনস্তত্ত্ব ঘটিত অতিপ্রাকৃত গল্পের স্রষ্টা হিসেবে তার অবদান অসামান্য।

স্বচ্ছ দৃষ্টি: গল্পকার রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন। তার মধ্যে কোনো ধূসরতা, অসুস্থ বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদ ও জটিল মনোবিকার নেই। আছে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসার পরিচয়।  উপসংহার: সূক্ষ্ম মানসিক জীবনাভূতি, সংযত প্রকাশ নৈপুণ্য, শিল্প পরিমিতিবোধ ও ভাবের একমুখীনতা তাঁর গল্পের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কাহিনী বর্ণনা, বাস্তবতা, কৌতুকরস সিঞ্চন, চরিত্র সৃষ্টি, সংযম ও ভারসাম্য রক্ষায় তিনি অবিস্মরণীয়। ছোট গল্পকার হিসেবে তাঁকে টলস্টয়, মোপাসাঁ, চেখভের পাশে স্থান দেওয়া হলেও মানবসত্তার গভীর স্বরূপ উপস্থাপনে ইউরোপীয় কম লেখকই তাঁর নাগাল পেয়েছেন।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading