‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে একটি পুরুষ চরিত্রকে ঘিরে মাতা ও বধূর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবি প্রকাশিত হয়েছে তার পরিচয় দাও।

Table of Contents

‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে একটি পুরুষ চরিত্রকে ঘিরে মাতা ও বধূর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবি-

আশাপূর্ণা দেবীর ‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে একটি পুরুষ চরিত্রকে ঘিরে মাতা ও বধূর মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়, তা সামাজিক ও মানসিক স্তরের জটিলতা এবং পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনকে প্রতিফলিত করে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু পারিবারিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই; এটি মূলত সমাজের স্থাপিত ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধের সঙ্গে জড়িত।

গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্রটি হলো পার্থ। পার্থ একজন আদর্শবাদী ও বিবেচনাপ্রবণ ব্যক্তি, যার মা এবং স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বেশ জটিল। মাতা এবং বধূর এই সম্পর্কের দ্বন্দ্ব কেবলমাত্র পার্থকে কেন্দ্র করে নয়; এটি সমাজের মূল্যের পরিবর্তন এবং নৈতিক দ্বন্দ্বকে চিত্রিত করে। মাতা এবং বধূ, দুজনেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের নিজস্ব পদ্ধতি এবং মানসিকতা তাদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মাতা: প্রতীকি মমতার অধিকার

গল্পে পার্থের মায়ের চরিত্রটি একদিকে মমতাময়ী, আবার অন্যদিকে অধিকারী এবং স্বার্থপর। তিনি নিজের সন্তানের প্রতি গভীর মমতা এবং স্নেহ পোষণ করেন, যা একধরনের অধিকার দাবীর মতো। মায়ের কাছে পার্থ কেবলমাত্র তার সন্তানই নয়, বরং তার জীবনের অর্থ এবং অবলম্বন। তিনি চান না যে তার সন্তান অন্য কাউকে বেশি গুরুত্ব দিক। এই মনোভাবের ফলে মায়ের মধ্যে একধরনের অধিকারবোধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়, যা পার্থের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের সংঘর্ষে রূপ নেয়।

মায়ের এই আচরণে সমাজের প্রাচীন মূল্যবোধের প্রতিফলন দেখা যায়, যেখানে মা এবং সন্তানের সম্পর্ককে অতি গুরুত্ব দেয়া হয় এবং মা একধরনের প্রতিকী মমতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। মায়ের জন্য তার সন্তান তার জীবন, তার অস্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই কারণে তিনি পার্থের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে চান, যা পরবর্তীতে পার্থ এবং তার স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণ হয়।

বধূ: স্বাধীনতা এবং আধুনিকতার প্রতীক

পার্থের স্ত্রীর চরিত্রটি আধুনিক এবং স্বাধীনচেতা। তিনি সমাজের পুরোনো ধ্যান-ধারণা এবং নিয়মাবলীর বাইরে চিন্তা করেন। তিনি চান যে তার স্বামী শুধুমাত্র তার সাথে সম্পর্কিত থাকুক এবং মায়ের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকুক। এই কারণে তিনি মায়ের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হন। পার্থের স্ত্রীর এই মনোভাব সমাজের আধুনিক মূল্যবোধের প্রতিফলন, যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে ব্যক্তিগত ও স্বাধীন বলে গণ্য করা হয়।

স্ত্রী মনে করেন যে তার স্বামীকে নিয়ে নিজের জীবনের পথ চলার স্বাধীনতা থাকা উচিত, যা তাকে মায়ের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। এই কারণে তিনি স্বামীর প্রতি অধিক অধিকার দাবি করেন এবং মায়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়ান। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু পার্থকে কেন্দ্র করে নয়; এটি মূলত সমাজের আধুনিক এবং পুরোনো মূল্যবোধের মধ্যে সংঘর্ষের একটি প্রতীক।

পার্থ: দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে

গল্পে পার্থ একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র, যাকে নিয়ে মাতা এবং বধূর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে ওঠে। পার্থ নিজে একটি দোটানায় থাকে; একদিকে মায়ের প্রতি তার দায়িত্ব এবং অন্যদিকে স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা। এই দ্বন্দ্ব পার্থের জন্য মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি একদিকে মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেন, অন্যদিকে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা এবং সমর্থন প্রদর্শন করতে চান।

পার্থের এই দোটানায় থাকা অবস্থা গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সমাজের মধ্যে পুরোনো এবং আধুনিক মূল্যবোধের সংঘর্ষকে প্রতিফলিত করে। পার্থ একদিকে মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করতে চান, অন্যদিকে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা এবং আধুনিক মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করতে চান। এই দ্বন্দ্ব গল্পের কেন্দ্রীয় থিমগুলির মধ্যে অন্যতম।

সমাজের প্রতিফলন

‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে মাতা এবং বধূর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবলমাত্র পার্থকে কেন্দ্র করে নয়; এটি সমাজের পরিবর্তিত মূল্যবোধ এবং সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন। মায়ের চরিত্রটি পুরোনো ধ্যান-ধারণার প্রতীক, যেখানে সন্তানকে সম্পূর্ণভাবে নিজের অধীনে রাখার চিন্তা থাকে। অন্যদিকে, স্ত্রীর চরিত্রটি আধুনিক মূল্যবোধের প্রতীক, যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে স্বাধীন এবং সমান হিসেবে গণ্য করা হয়।

এই গল্পের মাধ্যমে লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী সমাজের একটি বৃহত্তর সমস্যাকে চিত্রিত করেছেন, যেখানে পুরোনো এবং আধুনিক মূল্যবোধের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটছে। মাতা এবং বধূর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধুমাত্র পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতা নয়, বরং এটি সমাজের মূল্যের পরিবর্তনের প্রতিফলন।

উপসংহার

আশাপূর্ণা দেবীর ‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে মাতা এবং বধূর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমাজের বিভিন্ন স্তরের জটিলতা এবং মানসিক দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছে। এই গল্পে মাতা এবং বধূর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবলমাত্র পার্থকে কেন্দ্র করে নয়; এটি মূলত সমাজের পুরোনো এবং আধুনিক মূল্যবোধের মধ্যে সংঘর্ষকে প্রতিফলিত করে। এই গল্পটি সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র তুলে ধরে, যা সমাজের মূল্যের পরিবর্তন এবং সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনকে বোঝায়।

আরো পড়ুন,

‘স্টোভ’ গল্পে শশিভূষণের চরিত্র আলোচনা করো।

‘নিমগাছ’ গল্পটি কোন গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত? নিমগাছের প্রতীকে গল্পকার যে সমাজচিত্র তুলে ধরেছেন তা বুঝিয়ে দাও।

‘রস’ গল্প অবলম্বনে মাজু খাতুনের চরিত্রটি আলোচনা করো।

‘পাড়ি’ গল্পটি রচনার প্রেক্ষাপট বুঝিয়ে দাও।

‘পুঁইমাচা’ গল্পে প্রতিফলিত সমাজচিত্র আলোচনা করো।

‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে হাস্যরস নির্মাণে গল্পকারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

‘মৌরীফুল’ গল্পে প্রকৃতি ও মানবের মেলবন্ধন কীভাবে ঘটেছে বুঝিয়ে দাও।

‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে একটি পুরুষ চরিত্রকে ঘিরে মাতা ও বধূর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবি প্রকাশিত হয়েছে তার পরিচয় দাও।

‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পের নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো।

‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পের নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো।

‘পুঁইমাচা’ গল্পটি নামকরণের সার্থকতা বিচার কর ?

“ রস ” গল্পের নামকরণ সার্থকতা বিচার কর ?

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ?

দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ও নাম করনের সার্থকতা বিচার কর ?

রবীন্দ্রনাথ ও প্রভাতকুমারের মধ্যে তুলনা কর ?

‘দেবী’ গল্পের মূল চরিত্রের পরিণতির জন্য কোন কোন ঘটনা দায়ী উল্লেখ করো।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading