ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য আলোচনা করো।

ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য:

বাংলার লোকসাহিত্য চর্চার ঐতিহাসিক ধারায় ছড়ার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা যায় এই উপমহাদেশে ছড়ার ইতিহাস প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো। অনেকেই খনার রচনাকে ছড়ার প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মনে করেন। কিন্তু এগুলি মূলত উপদেশাত্মক ও ভবিষ্যৎ গণনার জন্যই চিহ্নিত হয়েছে। ছড়া প্রকৃত অর্থে সাহিত্যের মর্যদা লাভ করে উনিশ শতক থেকেই। আঠারো শতকে মোজাম্মেল হক রচিত ‘পদ্যশিক্ষা’ গ্রন্থটাকে কেউ কেউ ছড়ার প্রথম সংকলন বলে মনে করেন। প্রাচীন বাংলার আলোচনা প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন জানিয়েছেন “শেকশুভোদয়া’ গ্রন্থে কয়েকটি বাংলার গান ও ছড়া সঙ্কলিত হয়েছিল (সেন, পৃষ্ঠা ৮৩)। একথা সত্য হলে বাংলা ছড়ার প্রথম সংগ্রহের মর্যাদা “শেকশুভোদয়া’ গ্রন্থকেই দিতে হয়। উনিশ শতকের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে আধুনিক ছড়ার রূপকার বলা হয়। সুকুমার রায় ছড়াকে কেবল সাহিত্য হিসাবেই নয়, আধুনিক সাহিত্যের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবেই মর্যদা দিয়েছেন। বাংলা লোকছড়াগুলির সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত ভূমিকা যারা নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইউরোপীয় মিশনারী উইলিয়াম কেরী, উইলিয়াম মর্টন, রেভারেন্ট জেমস লঙ্ , হানা ক্যাথেরীন মুলেন্স এবং রেভারেন্ড লালবিহারী দে। যদিও তাঁরা ছড়া বলে যেগুলো সংগ্রহ করেছিলেন তাঁদের সংগৃহীত অধিকাংশই ছিল প্রবাদ। এই বিষয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন- ” ছড়া এবং প্রবাদে সূক্ষ্ম পার্থক্যবোধ ইংরেজ সংগ্রাহকদিগের থাকিবার কথা ছিল না, স্বতন্ত্রভাবে ছড়া বলিয়া কোন সংগ্রহ সেদিন পর্যন্ত নির্দেশ করা হয় নাই, সকলই প্রবাদ বলিয়া গৃহীত হইয়াছিল।” ২১ তবুও ছড়া সংগ্রাহক হিসাবে ইংরেজ মিশনারীদের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

শ্রী তিমিরবরণ চক্রবর্তী তাঁর “লোকসংস্কৃতি চর্চার আদিযুগ” গ্রন্থে লোকসংস্কৃতি চর্চায়, কেরীর দুটি সঙ্কলন গ্রন্থ “কথোপকথন” ও “ইতিহাসমালা” (১৮০১, ১৮১২) এ দুটির দান কতখানি, সে নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। কেরীর “কথোপকথন” গ্রন্থে লোকভাষার উপাদান মেলে। (চক্রবর্তী-২ ক, পৃঃ৪)। প্রথম মুদ্রিত বাংলা এবং মুদ্রিত ধাঁধা কেরী রচিত “ইতিহাসমালা” তে মেলে (চক্রবর্তী ২-ক, পূঃ৭-৮)। যেমন

১। মুই লাচার কি করিম।

মহাশয় তুই মা বাপ

২।

তোমার চরণ ছাড়িমু না (কথোপকথন)

মাছ আনিলা ছয় গণ্ডা,

চিলে নিলে দুই গন্ডা

বাকী রইল ঘোল।

তাহা ধুতে আটটা জলে পলাইল,

তবে থাকিল আট।

দুইটায় কিনিলাম দুই আটি কাট,

তবে থাকিল ছয়।

প্রতিবাসিকে চারিটা দিতে হয়,

তবে থাকিল দুই,

তার একটা চাকিয়া দেখিলাম মুই,

তবে থাকিল এক:

ঐ পাত পানে চাহিয়া দেখ।

এখন হইস্ যদি মানুষের পো,

কাঁটাখান খাইয়া মাছখান থো।

আমি যেই মেয়ে তেই হিসাব দিলাম কয়ে।

একথা সত্য যে লোকসংস্কৃতির সংগ্রহ বা সংকলন গ্রন্থ হিসাবে আমরা ইতিহাস মালার উল্লেখ দেখি না। কিন্তু লোকসংস্কৃতির, বিশেষত মৌখিক সাহিত্যের নানা উপাদান সুবিন্যস্তভাবে সংগৃহীত হয়েছে এই গ্রন্থে।

Share
error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading