চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দ দাসের পদের বিষয়বস্তু ও কাব্যসৌন্দর্য আলোচনা করে দেখাও তাঁকে কেন ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলা হয়।

চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা গোবিন্দদাস কবিরাজ। ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা বলা চলে একাধারে সাধক, ভক্ত ও রূপদক্ষ এই কবিকেই। যৌবনের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়ে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন গোবিন্দদাস। অতঃপর রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণি আয়ত্ত্ব করে বৈষ্ণব রসশাস্ত্র অনুসারে রচনা করতে থাকেন রাধাকৃষ্ণ-লীলা ও চৈতন্য-লীলার পদাবলি। তাঁকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। 

জন্মস্থান : পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত শ্রীখণ্ডে এক বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। 

জন্ম ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ, দেহাবসান সপ্তদশ শতকের প্রথমে।

পিতা :তাঁর পিতা চিরঞ্জিত সেন ছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ। 

মাতা :সুনন্দা দেবী

উপাধি :কবীন্দ্র, কবিরাজ, দ্বিতীয় বিদ্যাপতি

জীব গোস্বামী গোবিন্দদাসকে ‘কবীন্দ্র’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

শ্রীনিবাস আচার্য গোবিন্দদাসকে ‘কবিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।



কবি বল্লভ দাস  গোবিন্দদাসকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

নাটক : সঙ্গীতমাধব

কাব্য : কর্ণামৃত

শ্রেষ্ঠত্ব : গৌরাঙ্গ বিষয়ক ও অভিসার পর্যায়।

অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে, অভিসারের পদে গোবিন্দদাস রাজাধিরাজ।

🔵 সুবৃহৎ বৈষ্ণব সংকলনগ্রন্থ  ‘পদকল্পতরু’তে তাঁর অজস্রপদ সংকলিত হয়েছে।

🔵 শ্রীনিবাস আচার্যের অন্যতম শিষ্য ছিলেন।

🔵 খেতুরীর মহোৎসবে নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরভদ্রের দ্বারা অভিনন্দিত হয়েছিলেন।

🔵 রাধাকৃষ্ণের ‘অষ্টকালীয় লীলা’ বর্ণনার পরিকল্পনায় পথিকৃৎ ছিলেন।


গোবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্যের কবি, রূপানুরাগের কবি। তিনি ভক্তি ও রূপের মধ্যে এক নিবিড় ঐক্যসাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পদগুলি ভাষা, অলংকার ও ছন্দের সৌন্দর্যে এবং ভাবের গভীরতায় পরিপূর্ণ। রূপসৌন্দর্যের ভাবপ্রতিমা সৃজনে তিনি কতদূর সক্ষম হয়েছিলেন তা পূর্বরাগের এই পদটির বর্ণনা থেকেই পরিস্ফুট হয় –


যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।।

এই তীব্র রূপাসক্তিই ছিল গোবিন্দদাসের কাব্যরচনার মূল। তাঁর ভক্তি যত বেড়েছে, যতই তিনি সাধনার উচ্চস্তরে উপনীত হয়েছেন, ততই এই রূপমুগ্ধতা তাঁকে নিয়ে গেছে পূর্ণতার দিকে।

অভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যে নেই। এই সকল পদে ছন্দে, সুরে, ভাবে ও ভাষায় যে স্বতঃস্ফুর্ত উল্লাস ঝরে পড়েছে। 


গোবিন্দদাসের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদেও পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন, বিরহ, মাথুর প্রভৃতি পর্যায় আছে। তাঁর রাধার মধ্যেও বাসকসজ্জা, খণ্ডিতা, মান-অভিমান, কলহান্তরিতা দশা লক্ষিত হয়। বিদগ্ধ গোবিন্দদাস অন্তর-সংঘাতে বিধ্বস্ত রাধার আত্মগ্লানি, দীনতা, মিনতি পরিস্ফুট করেছেন উৎকৃষ্ট ভাব ও ভাষায়। তবে বিরহের পদে তাঁর সার্থকতা নেই। তিনি আরাধনার কবি। প্রেমের কবি। তাঁর রূপোল্লাসের প্রদীপে বিরহের অন্ধকার অপহৃত হয়েছে।


শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন গোবিন্দদাসের জীবনদেবতা। স্বীয় পদে তিনি এঁকেছেন দিব্যভাবচঞ্চল মহাপ্রভুর অন্তর্জীবনের ছবি –


নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে পুলক মুকুল অবলম্ব।
স্বেদমকরন্দ বিন্দু বিন্দু চূয়ত বিকশিত ভাবকদম্ব।।


গোবিন্দদাসকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। কবি বল্লভদাস তাঁকে বলেছেন দ্বিতীয় বিদ্যাপতি। তবে বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য নিছকই ভাষাগত। ভাবগত নয়। বিদ্যাপতির ভাষা ব্রজবুলি। গোবিন্দদাসের ভাষাও বাংলা-অনুসারী ব্রজবুলি। এমনকি তাঁর খাঁটি বাংলা পদও দুর্লভ নয় –
ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণী অবনী বহিয়া যায়।
ঈষৎ হাসির তরঙ্গহিল্লোলে মদন মুরছা পায়।।


ছন্দ-অলংকারের ঝংকারে ধ্বনিমাধুর্যে গোবিন্দদাসের পদ বিদ্যাপতির সমতুল। কিন্তু বিদ্যাপতির পদে ভক্তের আকুতি অনুপস্থিত। তিনি জীবনরসিক কবি। মনে রাখতে হবে, ধর্মক্ষেত্রে বিদ্যাপতি ছিলেন শৈব। গোবিন্দদাস, অন্যদিকে, স্বয়ং বৈষ্ণবই শুধু নন, ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব ধর্মনেতাদের অন্তরঙ্গও বটে। চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের অন্যতম রসভাষ্যকার গোবিন্দদাস কবিরাজ। বিদ্যাপতি সভাকবি, গোবিন্দদাস ভক্তকবি। স্বভাবতই, বিদ্যাপতির পদে আছে বুদ্ধির দীপ্তি, রাজকীয় আভিজাত্য। সেখানে ভক্তি এসেছে কদাচিত। কিন্তু গোবিন্দদাসের সব ছন্দ, সব অলংকার, সকল ধ্বনির এক এবং একমাত্র গতি হল ভক্তি। রাধাকৃষ্ণ-প্রেমলীলার অন্তর্নিহিত সত্যটি যে সেই জীবাত্মা-পরমাত্মার অপার্থিব সম্পর্ক – সেই বৈষ্ণব তত্ত্বের অনুভূতিরই অন্যতম প্রকাশস্থল গোবিন্দদাসের পদাবলি। এই প্রসঙ্গে তাঁর অভিসার পর্যায়ের পদগুলির উল্লেখ করা যেতে পারে – যেখানে তাঁর প্রতিস্পর্ধী কবি বৈষ্ণব সাহিত্যে বিরল।

গোবিন্দদাসের কিছু পদ ও তার পর্যায় :

(১) ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবনি (পূর্বরাগ)
(২) যাঁহা যাঁহা নিকষয়ে তনু তনু জ্যোতি (পূর্বরাগ)
(৩) সহচরী মেলি চললি বররঙ্গিনী (পূর্বরাগ)
(৪) রূপে ভরল দিঠি সোঙ্গারি পরশ বিঠি (পূর্বরাগ)
(৫) সুনয়নী কহত কানু ঘন শ্যামর (পূর্বরাগ)
(৬) আধক আধ আধ দিঠি অঞ্চলে (পূর্বরাগ)
(৭) কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল (অভিসার)
(৮) মন্দির বাহির কঠিন কপাট (অভিসার)
(৯) কুল মরিয়াদ কপাট উদ্ঘাটলু (অভিসার)
(১০) আদরে আগুসরী রাই হৃদয়ে ধরি (অভিসার)
(১১) মাধব কি কহব দৈব বিপাক (অভিসার)
(১২) নামহি অক্রুর ক্রুর নাহি যা সম (মাথুর)
(১৩) পিয়ার ফুলের বনে পেয়ার ভোমরা (মাথুর)
(১৪) যে মুখ নিরখনে নিমিখ না সহই (মাথুর)
(১৫) যাঁহা পহু অরুণ চরণে জাত (মাথুর)

 গোবিন্দ দাসের কাব্য রচনার পটভূমি ছিল ভিন্নতর, চৈতন্যদেবকে তিনি দেখতে পাননি। কিন্তু চৈতন্য ঐতিহ্যের সঙ্গে সুপরিচিত হয়ে স্বয়ং চৈতন্যদেবকে নিজ কবি- প্রাণ চেতনায় একীভূত করে নিয়ে তিনি পদরচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণু কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিল্পী প্রতিভূ। একটি যুগের সামগ্রিক সাধনা ও উপলব্ধির বাঙ্ময় প্রকাশ তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও এইখানেই তাঁর সঙ্গে আছে মৌলিক পার্থক্য। বিদ্যাপতির কাব্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ও উপলব্ধির মাধ্যমে কবি মানসের শৈল্পিক প্রকাশ, আর গোবিন্দ দাসের কাব্য যুগ সাধনার সামগ্রিক অভিব্যক্তি। তাঁর প্রাণচেতনার সঙ্গে চৈতন্য-ঐতিহ্য একাত্মরূপে প্রকাশিত।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ময়মনসিংহ গীতিকার স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করো।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading