চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী নারায়ণীর পুত্র হলেন বৃন্দাবন দাস। গ্রন্থমধ্যে বৃন্দাবন পিতার নাম কোথাও উল্লেখ না করলেও মাতা নারায়ণীর পরিচয় দিয়েছেন। বৃন্দাবনের জন্মকথা অনেকটা রহস্যাচ্ছন্ন। মনে করা হয় কবির জন্ম বর্ধমান জেলার দেনুর গ্রামে । বৃন্দাবন দাসের জন্মসন নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে ঃ
(a) দীনেশচন্দ্র সেনের মতে ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবনদাসের জন্ম।
(b) সুকুমার সেনের মতে ১৫০৭-১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বৃন্দাবন দাস জন্মগ্রহণ করেন।
(c) বিমানবিহারী মজুমদারের মতে ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে কবির জন্ম হয়।
গ্রন্থ পরিচয়ঃ
১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে কবি কর্ণপুর নামে এক চৈতন্য ভক্ত ‘গৌরগণোদ্দেশদীপিকা নামক বই লেখেন। কবি কর্ণপুরের আসল নাম পরমানন্দ সেন। তিনিই প্রথম উল্লিখিত বইতে বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’-এর কথা বলেছিলেন।
বৃন্দাবন দাস নিত্যানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। নিত্যানন্দ তাঁকে চৈতন্য জীবনী রচনার নির্দেশ দেন। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য জীবনী কাব্যের নাম – ‘চৈতন্য ভাগবত’ । গ্রন্থটির প্রথমে নাম ছিল ‘চৈতন্যমঙ্গল’ ।
নাম পরিবর্তনের কারণঃ
বৃন্দাবন দাস ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে কাব্য রচনা করেন । সমকালীন সময়ে লোচন দাস একই নামে গ্রন্থ রচনা করেন । দুটি কাব্যের একই নাম হলে ভবিষ্যতে গোলমাল হবার সম্ভাবনা থেকে যায় । তাই মাতা নারায়ণীর নির্দেশে তিনি নাম পাল্টে এর নাম দেন ‘চৈতন্য ভাগবত’ ( মতান্তরে জানা যায় এই কাব্যে শ্রীমদ্ভাগবতের লীলা অনুসৃত হওয়ায় বৃন্দাবনের গোস্বামীরা এই কাব্যের ‘চৈতন্যভাগবত’ নামকরণ করেন ) । নিত্যানন্দ দাসের ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থে পাওয়া যায়-
- “চৈতন্য ভাগবতের নাম চৈতন্যমঙ্গল ছিল।
- বৃন্দাবনের মহাস্তেরা ভাগবত আখ্যা দিল।
গ্রন্থ রচনার দৃষ্টিভঙ্গীঃ
পাপ বিনাশ করে পুণ্যের প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান কৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন দ্বাপরে। চৈতন্য কালতে পূর্ণাবতার। এই দৃষ্টিতে বৃন্দাবন দাস জীবনী লিখেছেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে তথ্য সংকলিত হওয়ায় তা অনেকটা নির্ভরযোগ্য এবং দেশকালের বিবরণ সনিষ্ঠায় পরিবেশিত।
রচনাকালঃ
চৈতন্য ভাগবতের রচনাকাল নিয়েও নানা জনের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।
(a) দীনেশচন্দ্র সেনের মতে ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ বা ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দই চৈতন্য ভাগবতের রচনাকাল।
(b) রামগতি ন্যায়রত্নের মতে এই সময়কাল ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দ।
(c) সুকুমার সেনের মতে তা ১৫৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দ।
(d) বিমানবিহারী মজুমদার বিভিন্ন প্রমাণ দিয়ে সিদ্ধান্তে এসেছেন, ‘১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্যভাগবত রচিত হইয়াছিল।’
খন্ড বিভাগঃ
বৃন্দাবন দাস তিন খণ্ডে ৫১ টি পরিচ্ছেদে এই জীবনীগ্রন্থের পরিকল্পনা করেন।
(a) আদিখণ্ডে পনেরটি (১৫টি) অধ্যায়,
(b) মধ্যখণ্ডে ছাব্বিশটি (২৬টি) অধ্যায়,
(c) অন্ত্যখণ্ডে দশটি (১০টি) অধ্যায়।
(a) আদিখণ্ডে – নিমাইর জন্ম, বাল্যলীলা, নিত্যানন্দের জন্ম ও বাল্যলীলা। নিমাইর বিদ্যাশিক্ষা, লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে বিবাহ, নিমাইর বিদ্যাশিক্ষা, দিগ্বিজয়ী পরাভব, লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যু ও বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ, যবন হরিদাসের মহিমা, পিতার মৃত্যু ও গয়াগমন, ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও প্রেমাবিষ্ট হয়ে নবদ্বীপে ফিরে আসা পর্যন্ত কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
(b) মধ্যখণ্ডে – ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা চৈতন্যের বিদ্যার অহংকার প্রকাশ, চৈতন্যের উদ্ভাত্ত অবস্থাকে শ্রীবাসের ঈশ্বরপ্রেম রূপে ব্যাখ্যা, নবদ্বীপে নিত্যানন্দের আগমন এবং নিত্যানন্দ ও গৌরঙ্গের মিলন, নবদ্বীপে হরিনাম সংকীর্তন, নিত্যানন্দের জগাই-মাধাই উদ্ধার, কাজীদলন, কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষাগ্রহণ, প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, রূপ সনাতনের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রভৃতি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
(c) অন্ত্যখন্ডে – চৈতন্যের গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গে মিলন এবং গুন্ডিচা মহোৎসব বর্নিত ।
উৎসঃ
বৃন্দাবন দাস ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনায় ভাগবত থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। চৈতন্যের বাল্যলীলার কথা তিনি সম্ভবতঃ নিত্যানন্দ, গদাধর ও অদ্বৈত প্রভুর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন । তাছাড়া ভক্তমুখে তিনি চৈতন্যলীলা বিশেষতঃ নবদ্বীপ লীলা সম্বন্ধে অনেক তথ্যই শুনেছিলেন।
চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থটির গুরুত্ব হল-
ক) কবি বৃন্দাবন দাস, মহাপ্রভুর জীবনকে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোন থেকে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন ।
খ) গ্রন্থটিতে সমকালীন বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও লৌকিক ইতিহাসের আলেখ্য চিত্র বর্তমান।
গ) ঐতিহাসিক নিষ্ঠা লক্ষনীয় ।
গ্রন্থের ত্রুটিঃ
চৈতন্যভাগবত গ্রন্থটির ত্রুটি হল
ক) অসমাপ্ত চৈতন্য জীবনী ।
খ) গ্রন্থটি অলৌকিকতার নাগপাশে আবদ্ধ ।
গ) বৈষ্ণব বিদ্বেশীদের প্রতি কবি অসহিষ্ণু মনোভাব মানবিকতাও বৈষ্ণবতার দিক দিয়ে অসমর্থনীয় ।
বৈষ্ণব ধর্মের ভাগবতঃ
তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা, বিশ্বাসনিষ্ঠ আন্তরিকতা, ইতিহাসের তথ্যে, ভক্ত হৃদয়জাত বিশ্বাস-সত্যে এবং শৈল্পিক সরসতায় ‘চৈতন্যভাগবত’ যথার্থই বৈষ্ণুবধর্মের ‘ভাগবত’ হয়ে উঠেছে। যথার্থই—চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবন দাস। (“চৈতন্যচরিতামৃত’)।
বৃন্দাবন দাসের কৃতিত্বঃ
বৃন্দাবন দাসের প্রধানতম কৃতিত্ব হল চৈতন্যের একটি ব্যক্তিমহিমার ভাব ফুটিয়ে তোলা। ভক্তি প্রবলতা, অলৌকিকে বিশ্বাস প্রভৃতির মধ্য দিয়েও চৈতন্যের সেই মানবরূপ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।। আশ্চর্য সে চরিত্রের নিপুণ রূপায়ণ।
বাংলা ভাষায় প্রথম চৈতন্য জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত বৃন্দাবন দাস। তার কাব্যখানি সুপরিচিত ও কাব্যগুন সমন্বিত। বাংলাদেশের সমাজ জীবনে চৈতন্যদেব সম্পর্কে যে সমস্ত কাহিনী, তত্ত্ব তথ্য, প্রচারিত হয়েছে তার সিংহভাগ বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত থেকে পাওয়া। নিত্যানন্দের অনুগামী ছিলেন – তিনি তার কাছ থেকে শ্রীচৈতন্য সম্পর্কিত যে তথ্য পেয়েছিলেন, তাকে অভ্রান্ত মনে করে তথ্যনিষ্ঠ ভাবে গ্রন্থ কে রচনা করেছেন।
কাব্যটির নামকরণ বিশিষ্ঠতার
বলা হয় বৃন্দাবন দাস প্রথম চৈতন্য জীবনীর নাম দিয়েছিলেন চৈতন্যমঙ্গল, কিন্তু নারায়নী দেবীর নির্দেশে তিনি নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করেন চৈতন্যভাগবত। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য জীবনী কাব্যটি 3 টি খন্ডে বিভক্ত. আদি- মধ্য ও অন্ত খন্ড মিলিয়ে এই গ্রন্থে মধ্যে সংখ্যা একান্নটি। আদি খণ্ড চৈতন্যদেবের জন্ম, বাল্য লীলা, বিদ্যাশিক্ষা, প্রথম ও দ্বিতীয় বিবাহ থেকে গয়া গমন ও নবদ্বীপে ফিরে আসা পর্যন্ত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
মধ্য খন্ড 24 বছর বয়স থেকে 30 বছর বয়স পর্যন্ত পরিব্রাজক রূপে বিভিন্ন তীর্থভূমি পরিক্রমার বর্ণনা এবং অন্তখন্ডে জীবনের শেষ 18 বছর নীলাচলে অবস্থানকালীন বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে। অন্ত খণ্ডটি যেভাবে হঠাৎ শেষ হয়েছে, তাতে কাব্যের অঙ্গহানি অনেকটা ঘটেছে বলে মনে করা হয়। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে – চৈতন্যভাগবত মহাপুরুষের ভাগবত জীবনী লেখা হয়নি। কোভিদ বর্ণনায় সমসাময়িক গৌড়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে।