চণ্ডীদাস সমস্যা আলোচনান্তে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা, অলংকার, ভাব ও রীতির বৈশিষ্ট্যগুলির যথাযথ পরিচয় দিন।

ভাষা: শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অনেক শব্দই আজকের পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ও অর্থহীন বলে মনে হলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে বেরোনো চর্যাপদের বাংলা ভাষার জড়তা দূর হয়ে তা সাবলীল ও তুলনায় অনেক গতিময় হয়ে উঠেছে- এ বিষয়ে কবির দক্ষতা ও অপরিসীম।


• অলংকার: শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বহিরাঙ্গিক কারুকৃতি ও লক্ষণীয়। কবি বড়ু চন্ডীদাস তাঁর এই কাব্যে উপমা,রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলংকার প্রয়োগে ও মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। “আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিয়ে যেহ্ণ ঝর এ নয়নের পানী”- কাব্যটিতে এমনই বহু উৎকৃষ্ট অলংকারের সন্ধান মেলে।
• ছন্দ: শুধু অলংকার নয়, দশ, এগারো,চোদ্দ ও বিষম অক্ষরের পয়ার এবং লঘু ও দীর্ঘ ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দের ব্যবহারে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ছন্দবৈচিত্র্য প্রশংসনীয়।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বৈশিষ্ট্য অথবা কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।

  • আঙ্গিক (পৌরাণিক আদর্শ ও লৌকিক জীবনরহস্যের সংমিশ্রণ): শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চন্ডীদাসের মৌলিক প্রতিভার পরিচায়ক। আঙ্গিকগত দিক থেকে এটি নাট্যরসাশ্রিত গীতিকাব্যের সঙ্গে আখ্যান কাব্যের সংমিশ্রণে গঠিত অপূর্ব কাব্যশিল্প। তবে কাব্যটিতে গীতগোবিন্দের আঙ্গিক অনুসৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাহিনীর সঙ্গে জনমনে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক অমার্জিত গাল গল্পের উপর ভিত্তি করে 13 টি খন্ডে কাব্যটি রচিত।
    • নাট্যধর্ম ও চরিত্র-চিত্রন: নাটকীয় কাহিনীকে প্রকাশ করতে কবি রাধা,কৃষ্ণ, বড়াই সহ কতগুলি অপ্রধান চরিত্রের সার্থক রূপায়ণ করেছেন। চরিত্র চিত্রণে তাঁর দক্ষতা অসাধারণ। কৃষ্ণ চরিত্রটি বাদ দিলে অন্য সব চরিত্রই কবির অসীম দক্ষতায় বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং তাদের পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে নাট্য ধর্মের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে।
  • গীতিকাব্যিক ভাবোচ্ছাস ও বৈষ্ণব পদাবলীর পূর্বাভাস: পরবর্তী পদাবলী সাহিত্যের মাথুর ও ভাবসম্মেলনের বিরহ আর্তি ও আত্মনিবেদনের পূর্বাভাস রাধাবিরহ খন্ডে আভাসিত হয়েছে। কৃষ্ণের কামাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী রাধা হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণগতপ্রাণা প্রেমময়ী চিরন্তন নারী।
    “কে না বাঁশী বা এ বড়াই কালিনী নঈ কূলে।
    কেনা বাঁশী বা এ বড়াই এ গোঠ গোকুলে”।
  • রাধার বিরহ জনিত এই গীতিকাব্যিক ভাবোচ্ছাস কাব্যটিকে সুষমা দান করেছে।
    সমালোচকের মধ্যে বড়ু চন্ডীদাসের রাধার যেখানে শেষ সেখান থেকে পদাবলীর রাধার শুরু। “রাধাবিরহ” কবির শ্রেষ্ঠ ও সুগভীর সাহিত্য প্রতিভার স্বাক্ষরবাহী।
  • উপসংহার: সংস্কৃত পুরাণ ও লৌকিক কাব্যধারার সংমিশ্রণে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কবি যে বিচিত্র কাব্যমূর্তি নির্মাণ করেছেন, তার সমকক্ষ কাব্যকাহিনী মধ্যযুগে বিরল। এ বিষয়ে ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই মন্তব্য করেছেন- “ভাষাভঙ্গিমা, চরিত্ররূপায়ন, বিচক্ষণতা, কাহিনীর বাঁধুনী ও নাটকীয় চমৎকারিত্বের বিচারে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি অনন্য সাধারণ কাব্য।
Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading