কাশীরাম দাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে, তাঁর অনূদিত মহাভারতের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য বিচার করুন।

কাশীরাম দাসের আত্মপরিচয়:

কাশীরাম দাসের পৈতৃক উপাধী দেব’। নিজ আত্মপরিচয় তিনি স্পষ্টই লিখেছেন—

ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।

দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী।

কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিঙ্গিগ্রাম।

প্রিয়ঙ্কর দাস পুত্র সুধাকর নাম।।

(অর্থাৎ-বর্ধমানের ইন্দ্রাণী পরগণার সিঙ্গিগ্রামে কায়স্থকুলে কাশীরামের জন্ম। পিতার নাম কমলাকান্ত, কবিরা তিনভাই–কৃষ্ণদাস, কাশীরাম, গদাধর। ঠাকুরদা—সুধাকরের পিতা প্রিয়ঙ্কর ইত্যাদি।)

কবিবংশ ছিল বৈব ভাবাপন্ন। তাই বৈবোচিত বিনয়ে ‘দেব’ না লিখে ‘দাস’ লিখেছিলেন। কাশীরাম তাঁর গুরু অভিরাম মুখুটির আশীর্বাদে মহাভারত অনুবাদ করেন। শোনা যায় মেদিনীপুর জেলায় আওখগড়ের (আলিগর) জমিদার বাড়ীতে শিক্ষকতা করার সময় বহু কথক ও পণ্ডিতের মুখে মহাভারত আখ্যান শুনে তাঁর অনুবাদ কর্মের বাসনা জাগে।

কাশীরাম দাসের রচনাকাল:

প্রাপ্ত বিভিন্ন পুঁথি অনুযায়ী কাশীরামের কাব্যের রচনাকাল যথাক্রমে ১৫৯৫ খ্রীষ্টাব্দ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথি), ১৬০৪ ও ১৬০২ খ্রীষ্টাব্দ (যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যা নিধি নির্দেশিত), ১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথির দ্বিতীয় পর্ব)। এই তথ্য থেকে অনুমান করা যায় কাশীরাম দাস ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মহাভারত বোধ হয় সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত হয়ে থাকবে।

কাশীরাম দাসের এই মহাভারত রচনার শুরুর ইতিহাস যেমন অজ্ঞাত তেমনি এর সমাপ্তির পরিচয়ও রহস্যাচ্ছন্ন। কোনও কোনও পুঁথিতে পাওয়া যায় এমনি শ্লোক—

আদি সভা বন বিরাটের কত দূর। 

ইহা লিখি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর॥

অথবা মুদ্রিত কাশীদাসী মহাভারতের বন পর্বে পাওয়া যায়।

“ধন্য হল কায়স্থ কুলেতে কাশীদাস। 

তিন পর্ব ভারত যে করিল প্রকাশ।।”

এই সমস্ত উল্লেখ থেকে অনুমিত হয় যে, কাশীরাম আদি, সভা, বন, ও বিরাট পর্বের কিয়দংশ রচনা করে পরলোকগত হন। এছাড়া প্রাপ্ত তথ্যের সূত্রে মনে হয়, কবির ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম, পুত্র ঘনশ্যাম ও জামাতা নানা প্রসঙ্গ যোগ করে কাশীরাম দাসের এই অষ্টাদশ পর্বের মহাভারত সম্পূর্ণ করেন।

কাশীরাম দাসের মহাভারতের গুরুত্ব  :-

কাশীরাম দাস তাঁর রচনাকে ঘটনাবিন্যাসে, নাটকীয়তায়, সরস উক্তি-প্রত্যুক্তি ও হাস্যরস পরিবেশনে চিত্তাকর্ষী করে তুলেছেন। মহাভারতীয় রস ও ধ্বনিঝংকার অক্ষুন্ন রাখার জন্য অনুবাদ কর্মে তিনি প্রয়াসী হন। কাশীদাসি মহাভারত মূলানুগ ও সংস্কৃতগন্ধী হলেও তা দুর্বোধ্য ও নীরস হয়ে ওঠেনি।

মহাভারতের কাহিনিকে সরল করে কাশীরাম দাস তার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক আদর্শকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। লােকশিক্ষার জন্যই সামাজিক ও নৈতিক আদর্শ শিক্ষা সে যুগে বিশেষ প্রয়ােজন সেটা কাশীরাম দাস বুঝতে পেরেছিলেন। জনসাধারণের কাছে গুরুভার হবে বলেই তিনি মহাভারতীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দার্শনিক তত্ত্বকে তেমন বেশি অনুসরণ করেননি।

কাশীরাম দাস তাঁর মহাভারতে পৌরাণিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হন। তাঁর রচনারীতিতে সংস্কৃত মহাভারতের তৎসমবহুল ক্লাসিক রীতির শব্দপ্রয়ােগ বেশি। তাই কৃত্তিবাসি রামায়ণের মতােকাশীদাসি মহাভারত সামগ্রিকভাবে বাঙালি ঘরের কাহিনি হয়ে ওঠেনি। 

মহাভারতীয় রস ও মহাকাব্যিক পরিমণ্ডল সৃষ্টির জন্য কাশীরাম দাস ক্লাসিক আদর্শ অনুসরণ করেছেন সুপরিমিত ও সুবিহিত তৎসম শব্দ ও অলংকার প্রয়ােগে। অনুপম তনুশ্যাম নীলােৎপল আভা, ‘মহাবীর্য যেন সূর্য জলদে আবৃত’, ‘শ্রীবৎস কৌস্তভ মনি’ শশাভিত হৃদয় এবং ভারত পঙ্কর রবি মহামুনি ব্যাস প্রভৃতি পঙক্তিগুলিতে ক্লাসিক সাহিত্যের সুমহান অটল গাম্ভীর্যের সৌন্দর্যচ্যুতি ফুটে উঠেছে।

কাশীদাসি মহাভারত বাঙালিকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিপুল শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণের মতাে এই গ্রন্থ কেবলমাত্র করুণরসের নিঝর নয়। বাঙালির ধ্যান-ধারণা ও ভাবকল্পনার সঙ্গে কাশীরাম দাস মহাভারতীয় ভাবাদর্শকে যথাসম্ভব মিলিয়ে দিয়েছেন।সভ্যতার রূপবদলের তালে তালে বাঙালি জীবনেও কত পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু কাশীদাসি মহাভারতের কাব্যরসধারা অন্তঃসলিলা ফক্মধারার ন্যায় বাঙালির অন্তৰ্জীবনে কুলুকুলু নাদে প্রবাহিত। কাশীদাসি মহাভারত বাঙালির জীবনগীতা—একটি বড়াে ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য।

কাশীরাম দাসের রচনায় একদিকে মুকুন্দরাম প্রভৃতির স্বাভাবিকতা আছে, অন্যদিকে ভারতচন্দ্রীয় যুগের অলংকারের ঐশ্বর্যদীপ্ত সৌন্দর্যের এক অপরূপ সমন্বয় সাধিত হয়েছে। একদিকে অতীত যুগের তিনি ধারক ও বাহক, অপরদিকে পরবর্তী যুগের আভাসটুকুও তার মধ্যে অভিব্যক্ত।

কাশীদাসি মহাভারতের বৈশিষ্ট্য :-

কাশীরাম দাস সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। তাই তাঁর রচনা সংস্কৃত প্রভাবিত। মহাভারতে প্রচুর তৎসম শব্দ ও সমাসবদ্ধ পদের প্রয়ােগ ঘটেছে। অলংকারের আতিশয্যে কোথাও রচনা কৃত্রিমতায়

পর্যবসিত হয়ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে রচনা সাবলীল গতিযুক্ত ও রসােত্তীর্ণ। তাঁর ভাষারীতিতে ক্লাসিক তৎসম শব্দের গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। চৈতন্যোত্তর যুগের প্রেমভক্তির আদর্শ কবির জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। কাব্যে ভক্তিভাবুকতার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে স্বয়ম্বর সভায় অর্জুনের সৌন্দর্য বর্ণনার মধ্যে। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের যােগ্যতা বােঝাতে গিয়ে কবি তার ক্ষাত্রজনােচিত চরিত্রধর্ম ও শারীরিক সৌন্দর্যকে অনুপম ভাষায় ও অনুপ্রাসের ঝংকারে এক বর্ণদীপ্ত ভাবগাম্ভীর্যের শিল্পমূর্তি দান করেছেন। সেখানে বীরযােদ্ধ অর্জুন নবঘনশ্যামের মােহনমূর্তিতে রূপান্তরিত ।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading