আরগ্যে কাব্যগ্রন্থের ‘ওরা কাজ করে’ কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ বিশ্রামরত, কর্মহীন অবস্থায় মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে ছায়াছবি দেখতে পান। সে ছায়াছবিতে ভারতবর্ষের অতীত থেকে আজকের ইতিহাস যেমন তার কাছে প্রকাশিত হয় তেমনই ফুটে ওঠে লোকসাধারণের জীবনসত্য।
জীবনের পরমসত্য যে মানুষদের কর্মে, শ্রমে, আত্মত্যাগে মহীয়ান তাদেরই জীবন নিষ্প্রদীপ – এ যন্ত্রণা কবির মর্মপীড়ণের মূল ছিলো। রথের রশি’ নাটিকায় তাই এ মানুষদেরকেই তিনি রাষ্ট্রপরিচালক হিসেবে দেখিয়েছেন। রাষ্ট্র, সভ্যতার প্রবাহিত ইতিহাস ও তাঁর সুললিত ব্যাখ্যা রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যত্রর মতো ‘ওরা কাজ করে’ কবিতাতেও প্রকাশিত।
এ কবিতায় প্রবাহিত ইতিহাসের বিরাট দৃশ্যমালা দরজা খুলেছে কবির চোখের সামনে। সুদীর্ঘ অতীত থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস বিদেশিদের পদলাঞ্ছিত হবার ইতিহাস। অনার্য ভারতে আর্য প্রবেশ এবং “শক-হ্ণ-দল-পাঠান-মোগলের একদেহে লীন হওয়া। বিদেশিদের জয়োল্লাশ, জয়ৌদ্ধত্ত্বের সামনে অসহায় ভারতবাসী। সমস্ত ভারতজুড়ে বিদেশীয় শাসকদের দম্ভ। প্রত্যক্ষ করেছেন কবি। পাঠান, মোগলদের জয়স্তম্ভ কালের নিয়মে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। সময়ের প্রবাহে ভারত শাস্ত্র করতে এসেছে আর এক বিদেশি ইংরেজ। ইতিহাসচেতনার ব্যঞ্জনাময় প্রকাশে কবি উল্লেখ করেছেন।
“লৌহ বাঁধা পথে অনল নিঃশ্বাসী রথে।”
ইংরেজ কীর্তি রেলপথ স্থাপ্নের সংকেতদ্যোতক এই চরণ একইসঙ্গে ইংরেজ লালসারও প্রকাশক। প্রগাঢ় দার্শনিক সত্তার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ অবশ্য একইসঙ্গে বলেছেন ইংরেজের পণ্যবাহী সেনা একদিন ভারত থেকে তথা বিশ্ব থেকে লীন হয়ে যাবে।
‘জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন আঁকিবে না’।
কবির মৃত্যুর পরে ভারতের স্বাধীনতা এবং কবির জীবদ্দশায় স্বাধীনতা আগমনের লক্ষ্মণ সমাজদেহে প্রকাশিত নয়। তাই কবির প্রত্যয়ী বাণী আমাদের তাঁর দার্শনিক স্বত্তার কাছে শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। কবি তাঁর কবিতায় বলেছেন মানুষের জীবনের নিত্যপ্রয়োজনে যে বিপুল জনতাবলে জীবন থেকে মরণ পর্যন্ত তারাই ধ্রুব, সনাতন। রাজস্তম্ভ ভেঙে যায়, রণডঙ্কা নিঃশব্দ হয়, জয়স্তম্ভ কীর্তিগর্ব ভুলে পুরাকীর্তি হয়ে ওঠে, প্রবল প্রতাপশালীর স্থান হয় ছেলেভুলানো ছড়ায় কিন্তু ইতিহাসে প্রাণসঞ্চার করে ওই লোকসাধারণ, সভ্যতার পিলসুজরা, ইতিহাসের রথচক্র ‘ওরা’ই ওদের কর্মের মাধ্যমে সচল রাখে।
‘কিষাণের জীবনের শরিক যে জন কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন’।
‘আরোগ্য কাব্যগ্রন্থের পাঠ্য কবিতায় রবীন্দ্রলোকচেতনের প্রকাশ ঘটেছে সাবলীলভাবে। ১৯৩০ খ্রীঃ-এ। রাশিয়া ভ্রমণের পর রবীন্দ্রনাথ যেন নিপীড়িতের পক্ষে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা পান। পৃথিবী সে সময় নিদারুণ অর্থদৈণ্যে পিড়ীত, ভারতীয় সমাজও সাম্রাজ্যবাদী শাসনে বিহুল ত্রস্ত। মানবতার বেদীকে রক্তাক্ত করে তুলছে। বিশ্বব্যাপী বণিকতন্ত্রের লাভে। ব্যক্তিজীবনের অসুস্থতায় এ সময়ই কবি পেয়েছেন মৃত্যুর ভয়াবহ আমন্ত্রণের স্বাদ। মানুষ ও পৃথিবীর প্রবাহিত তরঙ্গ তাকে করে তুলছে আরো দৃঢ়। মানবত্বের পরম সত্য তাই বারংবার রূপ পাচ্ছে তাঁর রচনায়।
চলিতেছে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি প্রাণী এই শুধু জানি।। চলিতে চলিতে থামে, পণ্য তার দিয়ে যায় কাকে পশ্চাতে যে রহে নিতে ক্ষণপরে সেও নাহি থাকে। (রোগশয্যায়) এই জীবনসত্য বহনকারীদের সম্পর্কে পাঠ্য কবিতায় বলেছেন –
‘মাটির পৃথিবী পানে আঁখি মেলি যবে দেখি সেথা কলকলরবে বিপুল জনতা চলে ।
নানা পথে নানা দলে দলে যুগযুগান্তর হতে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে। জীবনে মরণে।
বিশ্বজীবন প্রবাহের এই সত্যকে প্রকাশ গিয়ে এ কবিতায় এদের জীবন, এদের কথা, তাদের ভাষা কোন কিছুই সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত নয় বলে কবি কলকলরবে বলেছেন, বলেছেন এরা কেউ জন নয়
– জনতা। এদের ব্যক্তিপরিচয়ে সমাজে উপেক্ষিত বলে কবি এদের কবিতায় তুচ্ছার্থবোধক সর্বনাম ‘ওরা” বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এদের কর্মক্ষেত্র সর্বত্র, এরাই সভ্যতার বাহক, ধারক, পরিচালক
– ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।
সভ্যতা অগ্রগতি ও দিশা দেওয়া এই ব্রাত্য, উপেক্ষিতরা সভ্যতার পিলসূজ। তারাই সভ্যতার গতি ও দিকনির্ণায়ক বলে দেশ-দেশান্তরে, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ, পজ্ঞাব-বোম্বাই-গুজরাট, সমুদ্র নদীর ঘাট সর্বত্রই শােনা যায় এদের রব। উপনিষদ বলেছে মানবজীবনের মূলমন্ত্র চরৈবতি, চরৈবতি। এরা সেই মন্ত্রকে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনিতে রূপান্তরিত করে রেখেছে – আগামীকেও রাখবে।
কবি এমন মানুষদের কথা বলেছেন যারা যুগে যুগে দেশের বেড়াজাল ভেঙে যুগ-যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে দাঁড় টেনে, হাল ধরে মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।
এরা কখনো শিশুপাঠ্য কাহিনীটি মুখ ঢেকে থাকে না। ওরা অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের সমুদ্র বা নদীর ঘাটে পাঞ্জাবে, বোম্বাই, গুজরাতে বন্দরে বন্দরে কাজ করে। কাজ ই এদের জীবনের মহামন্ত্র।