রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এষা’ কাব্যের ‘মৃত্যু’ পর্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা—তিন ও ছয় সংখ্যক কবিতা—কবি জীবনের অন্বেষণ এবং মৃত্যুর উপলব্ধি নিয়ে গভীর চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। এই কবিতাগুলির মাধ্যমে কবি মৃত্যুর ভাবনাকে একাধারে ব্যক্তিগত, দার্শনিক এবং অস্তিত্বের সংকট হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যু কেবল একটি দৈহিক বা বাহ্যিক ঘটনা নয়, এটি একটি অন্তর্গত বিষয় যা মানবজীবনের সংকট, তার ব্যর্থতা এবং সত্যের দিকে যাত্রা প্রসঙ্গে নানা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। মৃত্যু একটি পরিণতির দ্বার, যা জীবনের উদ্দেশ্য ও অস্তিত্বকে নির্ধারণ করতে সহায়তা করে।
‘মৃত্যু’ পর্বের তিন সংখ্যক কবিতার ভাবনাঃ
এই কবিতায় মৃত্যুর প্রসঙ্গে কবি প্রথমেই একটি দ্বন্দ্বমুখী অনুভূতি প্রকাশ করেন। মৃত্যুকে তিনি দুঃখের হিসেবে গ্রহণ করতে চান না, বরং তাকে একধরণের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখেন। প্রথমেই তিনি মৃত্যুকে এক অবশ্যম্ভাবী সত্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন:
“আমি যে চিরদিনই বাঁচি যাব না
শাসন করে দেব জীবন, অবশেষে মৃত্যুর দল”
এখানে, কবি জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানে যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের স্বাভাবিকতাকে বুঝিয়েছেন। তিনি মনে করেন যে মৃত্যু আমাদের জন্য একটি অসীম গতি, একটি নির্দিষ্ট পরিণতি। এই কবিতায় কবি মৃত্যুকে কোনো ভয় বা ভয়ংকর শক্তি হিসেবে দেখেন না, বরং তিনি তাকে জীবনের এক প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন। মৃত্যুর সঙ্গে যে সম্পর্ক, তার মধ্য দিয়ে জীবন ও মৃত্যুর সমন্বয় ঘটানো হয়, যা কবির দৃষ্টিকোণ থেকে এক আত্মিক শান্তির প্রবাহ।
এখানে কবির ভাষায় মৃত্যুর অনুভবটি তীব্র নয়, বরং তা শাশ্বত স্বীকারোক্তির মতো। মৃত্যুর প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গি পরিপূর্ণভাবে ঐশ্বরিক ও দার্শনিক, যেখানে মৃত্যু এক পবিত্র গতি, এক নবজন্মের সূচনা হিসেবেও প্রতিভাত হয়। কবি মৃত্যুকে এমনভাবে গ্রহণ করেছেন, যেন এটি জীবনের শেষ নয়, বরং একটি নতুন পথের সূচনা। তার এ দৃষ্টিভঙ্গি মৃত্যুকে জীবনের পরিসমাপ্তি না, বরং তার এক নতুন রূপের বিকাশ হিসেবে চিহ্নিত করে।
‘মৃত্যু’ পর্বের ছয় সংখ্যক কবিতার ভাবনাঃ
এই কবিতায় কবি মৃত্যুর অধিক গম্ভীর এবং দার্শনিক ভাবনাকে তুলে ধরেছেন। এখানেও মৃত্যু কোনও ভয়াবহ এবং নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা হয়নি, বরং এটি জীবনের একটি গন্তব্যস্থল বা প্রাকৃতিক পরিণতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে এখানে কবি মৃত্যুর গভীরতা এবং তার প্রভাবকে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। মৃত্যুর পরে কোথায় গিয়ে পৌঁছানো যাবে, সেই অনিশ্চয়তার ভাবনা কবির মনোজগতে একধরনের যন্ত্রণার সৃষ্টি করে:
“তবে কি আমি চিরকালকার অস্থির?
তবুও অজ্ঞাত দিকে পৌঁছাবো?”
কবি প্রশ্ন করেছেন, মৃত্যুর পর কি এক অজানা গন্তব্য বা অন্ধকারে চলে যেতে হবে? এখানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুর পরে কোথায় বা কি ঘটবে তা জানার বা উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে তার অক্ষমতা ও অনিশ্চয়তা তুলে ধরেছেন। কবি মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থার প্রতি একটা অনিশ্চিত মুড তৈরি করেছেন, যেখানে মৃত্যু একটা অন্তর্গত দ্বন্দ্ব ও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে তার মধ্যেই কবি তার নিজের উপলব্ধি এবং আত্ম-অন্বেষণের পথে পথ চলতে চান।
এই কবিতায়, মৃত্যুতে কবির প্রক্রিয়াটি প্রায় মগ্নভাবেই আত্মবিশ্বাসী হলেও, তার পরবর্তী সত্ত্বা এবং অস্তিত্বের বিষয়ে চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। কবি মনে করেন মৃত্যুর পরবর্তী জীবন একটি ধারাবাহিকতার মতো, যেখানে মৃত্যু একটি শান্তির শেষ কথা হতে পারে, তবে সেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর বা ফলাফল নেই।
মৃত্যুর ভাবনা: জীবনের অবসান বা এক নতুন শুরু?
যে বিষয়টি দুটি কবিতায় একযোগে উপস্থিত তা হল, মৃত্যু একটি পরিণতি, যার মধ্যে ভয় বা দুঃখের উপাদান নেই। কবি তার ভাষায় জীবনকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে মৃত্যু একটি পরিপূর্ণতা অর্জন করা, জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, যা তাকে পরিপূর্ণ করে। কবির মতে, মৃত্যু কখনোই জীবনের সমাপ্তি নয়, বরং এটি জীবনের পূর্ণতা ও তার চূড়ান্ত উপলব্ধির মুহূর্ত।
তিন সংখ্যক কবিতায় কবি মৃত্যুকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাতে তা জীবনের নির্ধারিত সীমানার পরিপূরক হিসেবে প্রতিভাত হয়। মৃত্যুর পরের দিকটি চিন্তা করে, তিনি বলেন, “শেষে মৃত্যুর দল” – এটি একটি ধারণা, যা তাকে নির্দিষ্ট এক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। তবে, এখানেও তাকে ভয় বা দুঃখের আকারে দেখা যায় না, বরং মৃত্যুকে এক পরিপূর্ণতাবোধ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
ছয় সংখ্যক কবিতায়, কবি আবার মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করেছেন, তবে সেখানে অজানা গন্তব্য ও মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থার অজ্ঞতা কবির মধ্যে এক অনুভূতি তৈরি করে। এই কবিতায় তার অনুভূতি একটি দ্বন্দ্বমুখী ভাবনায় পূর্ণ: তিনি জানেন না তার পরবর্তী অবস্থান কোথায় হবে, কিন্তু তাকে সেই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে—এটাই যেন কবির অন্তর্নিহিত গতি ও আশা।
মৃত্যুর প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির সারাংশ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু ভাবনা একটি দার্শনিক এবং আত্মিক অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন। তার জন্য মৃত্যু কোনো নেতিবাচক বা ক্ষতিকর বিষয় নয়, বরং এটি জীবনের পরিণতি, যা নানান পরিপূর্ণতার মধ্যে চলে। “এষা” কাব্যের মৃত্যু পর্বে মৃত্যুর প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গি এমনভাবেই তৈরি হয়েছে, যাতে তা একান্তভাবে জীবনের সঙ্গী এবং মিত্র হয়ে উঠে, একটি ভয়ের বিষয় নয়, বরং একটি শান্তির এবং আত্মবিশ্বাসের মঞ্চ হিসেবে দাঁড়ায়।
মৃত্যু, তার গভীর ভাবনা ও উপলব্ধির মধ্যে, রবীন্দ্রনাথের জন্য একটি যাত্রার শেষ নয়, বরং একটি নতুন যাত্রার সূচনা—এটাই কবিতার মূল ভাবনা।