তত্ত্ব ও আন্দোলনের সঙ্গে উপন্যাসের যে অনিবার্য সংযোগের কথা আমরা বলছি নারীবাদ সেই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। এই মানবীবিদ্যার চোখ দিয়ে আমরা জগৎ ও জীবনকে নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আলোয় বর্তমানে আলোকিত হতে দেখি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফেমিনিজম্ বা নারীবাদ নারীর পক্ষ নিয়েই যে শুধু কথা বলে এমন নয়। এই মতবাদ নারীর জন্য একটি নিজস্ব পৃথিবীর রূপরেখা গঠন করতে চায়। এই মতবাদ প্রশ্নহীনভাবে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে অস্বীকার করে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে। কালক্রমে নানা আলোচক বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর অধিকারগুলি সুরক্ষিত করার কথা বলেছেন। যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ ও দার্শনিক থিমোন দ্য বোভোয়া বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে নারীর অবস্থানকে আলোচনা করেছেন। সমাজের অন্দরমহলে আশ্রিতা নারীরা যেন প্রথম শ্রেণীর মানুষ হিসাবে স্বীকৃত নয়। নারীদের তাই তিনি অসহায়ভাবে বলেছেন-‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’। নারীচেতনা ও রাজনৈতিক সংঘাত, নারীচেতনা ও Gender Politics এইসব বিষয়গুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তপোধীর ভট্টাচার্যের মতো তাত্ত্বিক এখান থেকেই নারীচেতনাকে সামনে রেখে একটি স্বতন্ত্র বিদ্যাচর্চা গড়ে তোলার পক্ষপাতি-
“…নারীর পরিসর সন্তত ততক্ষণ ঈপ্সিত তাৎপর্য প্রতিষ্ঠিত হবে না যতক্ষণ সাহিত্যের মূল স্রোত বলে গৃহীত ও মান্যতাপ্রাপ্ত পুরুষস্রোত থেকে স্বতন্ত্র ধারায় তা ব্যক্ত হচ্ছে না। তার মানে, নারীর পক্ষে আবশ্যিক হলো নারীচেতনা নিষ্পন্ন সন্দর্ভ, নন্দন এবং জীবনসত্য।’ |
আশাপূর্ণা দেবী তাঁর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি, ‘সুবর্ণলতা’ ও ‘বকুলকথা’ এই তিনটি উপন্যাসের সূত্রে নারীর অন্দরমহলের মহাকাব্য রচনা করেছেন। সামাজিক প্রেক্ষাপটে তিনপ্রজন্মের নারীরা কীভাবে নিজের আকাশ বা অধিকারের ভূমি রচনা করার চেষ্টা করেছে তার বয়ান উপস্থাপন করেছেন লেখিকা। সত্যবতী (‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’) প্রথম প্রজন্ম, যে প্রথম থেকেই অন্তঃপুরের অনুশাসনকে মানেনি। জীবনে একমাত্র পুরুষ হিসাবে পিতা রামকালী ভিন্ন অন্য কাউকে আদর্শপুরুষ হিসাবেও সে স্বীকার করে নেয়নি। নিরক্ষর নারীরাই যে সমাজে ‘স্বাভাবিক’, সেই যুগ পরিবেশে সরস্বতীকে বন্দনা করে ত্রিপতীদে ছড়া লেখে সত্যবর্তী। নিজের মেয়েকে (সুবর্ণলতা) যে শিক্ষিত করার পণ নিয়ে বেথুন স্কুলে পাঠিয়েছে। সেসমস্ত কারণ একজন নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গের তকমা দিয়ে দিয়ে থাকে, সেই সব কারণকেই এই নারী নিজের স্পর্ধায় ভাঙতে চেয়েছে। ‘সুবর্ণলতা’ উপন্যাসে মেয়ে তার মা সত্যবতীর পথকেই অনুসরণ করেছে। পরিবারের গণ্ডি অতিক্রম করে দেশের কথা ভেবেছে সে। সুবর্ণ মনেপ্রাণে চায় দেশ স্বাদীন হোক। তবু নিজের আত্মজীবনটি যখন প্রখাশ হল এবং তাতে মুদ্রণক্রটি বর্তমান; পুরুষতন্ত্র তখন জিতাক্ষরা এই নারীকে জঙ্গও শ্লেষদ্বানে বিদ্ধ করেছে। এবং সেই বিদ্রূপ এসেছে সূবর্ণর স্বামী ও সন্তানের দিক থেকেই। তবু মেয়ে বকুল একদিন সব বিপত্তি অতিক্রম করে বড়ো হয়ে উঠবে; সুবর্ণর মনে এই প্রশংসা ও সাধনা উজ্জ্বল হয়েছিল। বকুল বোঝে তার মা যন্ত্রণার শিকার। ‘অনামিকা দেবী’ ছদ্মনামে সে গদ্য লিখতে শুরু করে। অসহায় পিতার দায়িত্বও অস্বীকার করেনি বকুল। ‘বকুলকথা’ পূর্ববর্তী দুই উপন্যাসের নারীদের যে স্বপ্ন ও সাধনা তাকে সঠিক গন্তব্য দিতে পেরেচে। এই ট্রির্লাজ আসলে প্রচলিত সমাজ-সংস্কারের ঊর্ধ্বে নারীর জীবন ও অস্তিত্বের স্বাক্ষর রচনা করেছে।
উত্তরোত্তর উপন্যাসের জগৎ আরও বিস্তৃত হচ্ছে। তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে বিস্তর। উপন্যাসের ভাষা বদলাচ্ছি, বদলাচ্ছি তার উপস্থাপনা কৌশল। বিবিধ তত্ত্ব ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই প্রকরমটির বিচারবিবেচনা করে চলেছেন গবেষক-তাত্ত্বিকেরা। এটি একটি নিরবধি প্রক্রিয়া। তবে শেষপর্যন্ত জীবনবোধসম্পন্ন বাস্তবজীবনের আখ্যানই উপন্যাসের প্রাণ। বিশুদ্ধ জীবন ও ঘটনা কখনই বানানো শব্দগুচ্ছ
ছাড়া অন্যকিছু হতে পারে না। ই.এম. ফরস্টারকে অবলম্বন করে আমরাও বলতে পারি-
‘The Novel is sogged with humanity, there is no escapins the uplifts and the downpower nor can they be kept out of criticism’ জীবন ও সময় যেমন উপন্যাসকে ঠিক তেমন নিজের নির্মাণকে গড়ে নিতে হবে। সেখানেই আধুনিক পৃথিবীর মহাকাব্য হিসাবে চিহ্নিত উপন্যাসের সার্থকতা নিহিত রয়েছে।