উনিশ শতকের বাংলা মহিলা কবিদের সাহিত্যচর্চার পরিচয় দাও।

বাংলা ভাষার বয়স প্রায় হাজার-বছরেরও বেশি। মাগধী-অপভ্রংশ থেকে বহু বিবর্তনের পরে বাঙলা ভাষার উদ্ভব। প্রায় আঠারো শতক পর্যন্ত। চর্যাপদ-চণ্ডীদাস-শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-বিদ্যাপতি প্রমুখের জন্য বৈষ্ণব-পদাবলী, অনুবাদ-সাহিত্য, কয়টি প্রধান মঙ্গলকাব্য ও জীবনীসাহিত্য এবং নানাজাতীয় লােক-সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এরপরে বাংলা সাহিত্যের গতিকে প্রশস্ত করেছিলেন রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যে ধারা প্রবেশ করেছিল আধুনিক যুগে। এই সময়ে এই সুদীর্ঘ যাত্রায় তার বাহক হয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিশ্ববন্দিত সাহিত্যিকগণ। ছিলেন রাসসুন্দরী দেবী, কৃষ্ণকামিনী দাসী, জ্যোর্তিময়ী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবীর মতো বিদুষীরাও, যদিও প্রচারের আলোয় এঁরা পুরুষ-স্রষ্টাদের সমকক্ষ হতে পারেননি এবং তার কারণ তৎকালীন সমাজব্যবস্থা।

নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলা-সাহিত্যে একটা বড় জায়গা দখলে নিয়েছিলেন নারী-লেখকরা। মূলত আঠারো-শতকের মাঝামাঝি থেকেই সাহিত্যে নারীদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু ‍করে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও পিছিয়ে পড়া নারীসমাজকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে তাঁরা রেখেছিলেন এক অগ্রণী ভূমিকা। বাংলা সাহিত্যের আজ যে বিস্তৃতি তার জন্য তৎকালীন মহিলাদের ভূমিকা কিছুমাত্র কম নয়, অথচ সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যে মহিলা-সাহিত্যিকদের প্রবেশের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বিশেষ করে উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলার সমাজ-জীবনে মেয়েদের মুখ ছিল অন্ধকারের ঘোমটায় ঢাকা।

অন্তঃপুর শিক্ষার পাঠশালা :


দেড়শত বৎসর পূর্বে—ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষার অবস্থা মোটেই উল্লেখযোগ্য ছিল না। প্রধানত সম্ভ্রান্ত-পরিবারের অন্তঃপুরের মধ্যেই এই ভাবনা সীমাবদ্ধ ছিল; মেয়েরা ঘরে বসে শিক্ষয়িত্রীর সাহায্যে বিদ্যাচর্চা করতেন। সাধারণ গৃহস্থ পরিবারে মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না, বরং প্রাচীনাদের অনেকের বদ্ধমূল সংস্কার ছিল, যে-মেয়ে লেখাপড়া করে সে ‘রাঁড়’ (বিধবা) হয়। এমন সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যেও যাতে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা যথার্থ হয় , তার জন্য তৎকালীন ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ অন্তঃপুর স্ত্রীশিক্ষার প্রথম থেকে পঞ্চম বছর পর্যন্ত এক ধারাবাহিক বিদ্যাশিক্ষার পাঠক্রম, পুস্তকের তালিকা ও পরীক্ষা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা চালু করেছিল। পরবর্তী কালে স্ত্রীশিক্ষার অগ্রগতিতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে এই ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’।

নারীশিক্ষার আয়োজন


বেথুন সাহেবের প্রচেষ্টায় এবং রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখ এদেশের কয়েকজন বিদ্বান ব্যক্তির সহায়তায় ১৮৪৯ সনের ৭ মে ‘কলিকাতা বালিকা বিদ্যালয়ের’ (বর্তমানে বেথুন কলেজ) প্রতিষ্ঠা এবং দেশেও স্ত্রীশিক্ষার প্রসার লাভ করেছিল। আর এর প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ, কিছুকালের মধ্যেই আমরা কোনও কোনও বঙ্গমহিলাকে পর্দার আড়াল ভেদ করে সাহিত্যক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করতেও দেখেছি। তাঁদের রচিত কবিতাবলি পরবর্তী কালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় সাদরে গৃহীত হয়েছিল। তবে বিষয়টি মোটেও সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য ছিল না। একে যথোচিত শিক্ষার অভাব, তার উপর সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূলতা —সেযুগের মহিলা লেখিকাদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল।
ক্রমশ মাসিকপত্রের পৃষ্ঠাতেও বঙ্গমহিলাদের আত্মপ্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল। ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-য় বামাগণের রচনা প্রকাশিত হওয়ার পরে চারিদিকে স্ত্রীশিক্ষা-প্রসারের আন্দোলন মাথা তুলেছিল।

আঠারো শতক ও বাঙালি লেখিকাদের উত্থান :


আঠারো-শতকের মধ্যভাগে বাংলা সাহিত্যে নারী-লেখিকাদের আবির্ভাব ঘটল। এই সময়ে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে এমন এক প্রতিভাশালিনী মহিলা আবির্ভূত হলেন যাঁর গদ্যে-পদ্যে আমরা সর্বপ্রথম শিল্পসুষমার আস্বাদ পেয়েছিলাম। যাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যের এক নবরূপে লাভ হল, ইনি হলেন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী। প্রতিভার জাদুস্পর্শে সর্বপ্রথম এঁর রচনাই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গল্প-উপন্যাস, কবিতা-গান, নাটক-প্রবন্ধ ও বিজ্ঞান—এক কথায় সাহিত্যের সকল বিভাগেই তাঁর দান স্বীকৃত হতে থাকে। তিনি ছিলেন শিক্ষিত বাঙালি নারীসমাজের প্রথম যুগের অন্যতম প্রতিনিধি। ১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী-দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়। অবশ্য এর আগে ১৮৫২ সালে হানা-ক্যাথরিন মুলেনস ‘ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত’ প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে মহিলা-সাহিত্যিকদের প্রতিবন্ধকতা :


এভাবে নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলা সাহিত্যে বড় একটা জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন নারী-লেখকরা। মূলত আঠারো-শতকের মাঝামাঝি থেকেই সাহিত্যে নারীদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু ‍করে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও পিছিয়ে পড়া নারী-সমাজকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে তাঁরা রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। বাংলার নারী-সাহিত্যিকরা নারীর অধিকার নিয়েই বেশি লিখেছেন, কারণ বাংলার নারী সব সময়ই অবহেলিত ও অত্যাচারিত, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশে কম দেখা যায়। তবে, বাংলা-সাহিত্যে নারীদের উপস্থিতি কম, আর তার অন্যতম প্রধান কারণ হল বাংলায় সবসময়ই নারীশিক্ষার হার কম। এছাড়া বাংলার সমাজ-ব্যবস্থাও এর জন্য কিছুটা দায়ী। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রগতিকে অনেকেই সহজভাবে নিতে পারেননি। আর তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল তদানীন্তন সাহিত্য।

নারীশিক্ষা সম্পর্কে জনমত


আসলে, অন্যান্য সব সাহিত্যের মতো বাংলা-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বাঙালি পুরুষ, সব জাতির পুরুষের মতোই, নারীসাহিত্যকে অনুমোদন করেনি, নারীকে দেখেছেন রান্নাবান্না বা সংসারের-সেবাদাসীরূপে; নারী-লেখকদের মধ্যেও তারা খুঁজেছেন আদর্শ স্ত্রীকে। নারী-লেখক বা তাঁর লেখা এক্ষেত্রে মূল্যবান নয়। পুরুষের কাছে তাই নারীসাহিত্যের কোনও ইতিহাস আজও লেখা হয়নি, তাঁদের প্রতিভার প্রকৃত বিচার ও মূল্যায়ন হয়নি, এমনকী তাঁদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্যও বেশ দুষ্প্রাপ্য। স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবী, শৈলবালা ঘোষজায়া, সীতা দেবী, শান্ত দেবী ও আরও অনেক লেখিকার সব বইয়ের নামও খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁদের বইয়ের প্রকাশের তারিখ।
এই তথ্য বাংলা সাহিত্য-সমাজে অত্যন্ত লজ্জার। তাঁরা শিকার হয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উপেক্ষার। পুরুষ-সমালোচকেরা ধরেই নিয়েছিলেন তাঁদের সাহিত্য অপাঠ্য, বিশেষ করে যাঁদের বই জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁরা সম্পূর্ণ অপাঠ্য, এমন একটি ধারণাও প্রচলিত রয়েছিল।

মাসিক পত্রিকা ও নারীসমাজ :


নারীদের প্রথম রচনা প্রয়াসের মাধ্যম, নারী-মনন প্রতিফলনের ও মতপ্রকাশের সাক্ষী অবশ্যই উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’। ১৮৬৩ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত এক টানা ষাট বছর ‘বামাবোধিনী’ প্রকাশিত হয়ে বাংলা সংবাদপত্র-পত্রিকার জগতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। রাসসুন্দরী দেবী, কৈলাসবাসিনী, জ্ঞানদানন্দিনী, সরলাদেবী, স্বর্ণকুমারী, বেগম রোকেয়া ‘বামাবোধিনী’-তে নিয়মিত লিখতেন। নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক অত্যাচার-অবিচার ও অন্তঃপুরের নারীদের অনেক অজানা মর্মান্তিক ঘটনার কথা তাঁরা নির্ভয়ে ব্যক্ত করতেন। উল্লেখ্য যে, ‘বামাবোধিনী’, ‘সম্বাদ ভাস্কর’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি পত্রিকা মেয়েদের কথা ও লেখায় সমৃদ্ধ হলেও তাদের সম্পাদকরা ছিলেন সবাই পুরুষ। এই অসমতা ঘোচাতে শ্রীমতী মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গমহিলা’-এপ্রিল, ১৮৭০ সালে।

ঠাকুরবাড়ি ও বঙ্গনারীর উত্থান :


আমরা জানি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অবদান উল্লেখযোগ্য। আধুনিক বাঙালির জীবন বিকাশের নানা-পর্বে ও নানা-পরিসরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ইতিহাস স্বীকৃত। পারিবারিক ঐতিহ্য ও অনুপ্রেরণায় অন্দরমহলের অবরোধ ভেঙে সাহিত্য-চর্চার মধ্য দিয়ে আত্মমুক্তির পথকে ব্যঞ্জিত করেছিলেন এই পরিবারের নারীরা।

পরবর্তী সময়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ১৮৭৭ সালে ‘ভারতী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর ওপর। গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘ভারতীর এক অর্থ বাণী, আর এক অর্থ বিদ্যা আর এক অর্থ ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী’। নির্ভেজাল সাহিত্য-পত্রিকা ছাড়াও সে সময় অন্য বিষয়-ভিত্তিক কিছু পত্রিকাও প্রকাশিত হত। হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীদেবীর সম্পাদনায় অক্টোবর ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘পুণ্য’, যাতে রন্ধনপ্রণালী ও নানাবিধ সুস্বাদু রান্নার ব্যাপারেও লেখা থাকত। মেয়েদের সংগীতশিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য প্রতিভাদেবী ও ইন্দিরাদেবীর যুগ্ম সম্পাদনায় ১৩২০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় ‘আনন্দ-সঙ্গীত’ পত্রিকা। নারী মঙ্গল সমিতির মুখপত্ররূপে ১৯২৫ সালে সরোজনলিনী দত্ত সম্পাদিত ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকা এবং স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিকায় মাতৃভূমির সেবাকল্পে ১৯০৭ সালে কুমুদিনী মিত্রর (পরে বসু) সম্পাদনায় ‘সুপ্রভাত’ প্রকাশিত হয়। এভাবেই উনিশ ও বিশ শতকের এইসব পত্র-পত্রিকায় মেয়েদের সম্পাদনা ও মতপ্রকাশও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বাংলা উপন্যাস ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নারীসমাজ :


বাঙালি নারীরা যখন প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করে, তখন পুরুষ এই-কাজকে অনাচার বলেই গণ্য করে। এতসব বাধা পেরিয়েও কিন্তু বাঙালি-নারী উপন্যাসে হাত দিতে দেরি করেনি; পুরুষের প্রথম উদ্যোগের দু-দশকের মধ্যেই প্রকাশিত হয় মহিলা লেখিকাদের প্রথম উপন্যাস : স্বর্ণকুমারী দেবীর দীপনির্বাণ (১৮৭৬), পরে প্রকাশিত হয় ছিন্ন মুকুল (১৮৭৬), বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), ফুলের মালা (১৮৯৪), হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৯৪), কাহাকে (১৮৯৮)। অল্প পরেই দেখা দেন জনপ্রিয় অনুরূপা দেবী ও নিরুপমা দেবী, তাঁরা দু’জনে লেখেন প্রচুর উপন্যাস। নিরুপমার উপন্যাস অন্নপূর্ণার মন্দির, দিদি (১৯১৫), বিধিলিপি (১৯১৭), শ্যামলী (১৯১৮); অনুরূপার উপন্যাস মন্ত্রশক্তি (১৯১৫), মহানিশা (১৯১৯), মা (১৯২০), গরিবের মেয়ে, পথহারা, ত্রিবেণী (১৯২৮), জ্যোতিঃহারা, চক্র। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য এমন কিছু প্রতিভাময়ী সাহিত্যিকদের নাম, যেমন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, শৈলবালা ঘোষজায়া, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, ও আরও অনেকে, যাঁরা নিজেদের নিয়মিত কর্মজীবনের পরে সাহিত্য চর্চা, এমনকী সমাজের উন্নতি-সাধনেও মনোযোগী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের এমন অবদান আমরা যেমন পেয়েছি, তেমন অনেক বড় বড় লেখিকাও পেয়েছি। আশির দশকে পাওয়া গেছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুফিয়া কামাল, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, লীলা মজুমদার, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ সাহিত্যিকদের ।

বেগম রোকেয়া : বাংলাদেশের পায়রাবন্দ গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম এক রক্ষণশীল-পরিবারে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে জন্মগ্রহণ বেগম রোকেয়ার। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা ও মনোবল সম্বল করে ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন রোকেয়া। বিয়ের পর স্নেহশীল ও মুক্ত-মনের অধিকারী স্বামীর সংস্পর্শে এসে তিনি লেখাপড়া করার ও চিত্ত-বিকাশের সুযোগ পান। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে তিনি সমাজ সংস্কার ও গঠনমূলক কাজে নিজেকে উজাড় করে দেন। বেগম রোকেয়া রচিত গ্রন্থ তাঁর চিন্তা ও কর্মাদর্শের বাণীরূপ। মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন প্রভৃতি লেখিকার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ‘পদ্মরাগ’ বেগম রোকেয়া রচিত একটি উপন্যাস।

   
সুফিয়া কামাল : সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত কিন্তু গদ্যলেখক হিসেবেও তাঁর অবদান রয়েছে। বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ ভাবে উজ্জ্বল। তাঁর সময়কালে পশ্চাৎপদ মুসলিম-সমাজের একজন মহিলা হিসেবে সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে সমাজে ভূমিকা রাখা ছিল শুধু গৌরবের নয়, বিশেষভাবে এক অসাধারণ বিষয়। তিনি তেমন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজেই বাংলা ভাষা শিখে নেন। পর্দার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন একজন আধুনিক মানুষ। স্বামী নেহাল হোসেনের অনুপ্রেরণায় সাহিত্য ও সমসাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগ হয় । এর ফলে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ধীরে ধীরে তিনি একটি সচেতন মনের অধিকারিণী হয়েও উঠেছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’, যা বরিশালের ‘তরুণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

১৯৪৯ সালে তাঁর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সুলতানা’ পত্রিকা, যার নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন-গ্রন্থের’ প্রধান চরিত্রের নামানুসারে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থটি। এর ভূমিকা লিখেছিলেন নজরুল এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এটি পড়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। তিনি অনেক ছোটগল্প এবং ক্ষুদ্র উপন্যাসও রচনা করেছেন। ‘কেয়ার কাঁটা’ (১৯৩৭) তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গল্প-গ্রন্থ। তাঁর কবিতা চিনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে রুশ ভাষায় তাঁর ‘সাঁঝের মায়া’ গ্রন্থটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও তাঁর বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি তাঁর কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ দিয়ে “Mother of Pears and other poem” এবং ২০০২ সালে ‘সুফিয়া কামালের রচনা সমগ্র’ প্রকাশ করেছিল।

সর্বক্ষেত্রেই সাহিত্যে নারী-লেখকদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ-প্রথা সর্বকালের এবং সর্বযুগের। ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়, যা মূলত পুরুষদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। কখনও কখনও নারী-লেখকদের লেখাকেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। তবে বাংলা সাহিত্যে নারীলেখক, যাঁরা এ-পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী নাম করেছেন তাঁরা সকলেই নারীর অধিকার ও প্রগতি নিয়ে কথা বলেছেন। এটাই ছিল মূল বিষয়। এর বাইরে কিছু লেখা রয়েছে সেগুলো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। এইভাবেই সাহিত্যের যে বীজ সেই সময়ে বপন করা হয়েছিল তার ফলশ্রুতি হলেন পরবর্তী সময়ে আশাপূর্ণা দেবী, লীলা মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী থেকে তসলিমা নাসরিন প্রমুখ আজকের প্রজন্মের লেখিকারা।

   
তবে, ঊনবিংশ শতাব্দীর এই মহীয়সী নারীদের কথা যতই বলি না কেন, শেষ করেও শেষ করা যায় না। আমাদের বর্তমান চলার পথ যে এত মসৃণ, এত স্বাধীন; তাঁর মূল অবদান আমাদের অবিস্মরণীয় পূর্বসূরিদের। প্রণাম জানাই নমস্যদের। বাকিটা রইল আমাদের শিকড় খোঁজার দায়বদ্ধতা।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading