উদারনীতিক নারীবাদ:
প্রাথমিক অবস্থায় নারীবাদ বিশেষত ‘প্রথম পর্বের নারীবাদ’ (first wave feminism) উদারনীতিক ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের নারীবাদ’ (second-wave feminism)-এর মধ্যেও উদারনীতিক উপাদানসমূহের অভাব নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ইংরেজীতে ‘নারীবাদী’ (feminist) কথাটির প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আধুনিক নারীবাদের উদ্ভব ঘটেছে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। এই সময় প্রাথমিক পুঁজিবাদের বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রাথমিক পর্বে আইনগত ও আর্থনীতিক পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের পরিবর্তনের কারণে মহিলাদের অবস্থার অবনতি ঘটে। এই সময় পুরুষের স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার অভিব্যক্তি ঘটে। মহিলাদের রাজনীতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদারনীতিক চিন্তাবিদ্রা সোচ্চার হন। ১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লবের গোড়ার দিকে মেরী উলস্টোনক্রাফটের Vindication of the Rights of Women শীর্ষক গ্রন্থটি প্রণীত হয়। প্রথম এই গ্রন্থটির মাধ্যমে প্রাথমিক উদারনীতিক নারীবাদের পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি ঘটে। এই সময় মহিলাদের ভোটাধিকারতো ছিলই, এমনকি শিক্ষার অধিকারও ছিল না। অনেক বৃত্তি থেকে মহিলারা বঞ্চিত ছিল। আইনগত অবস্থানের বিচারে শিশুদের সঙ্গে মহিলাদের তেমন বিশেষ ব্যবধান ছিল না। বিবাহিত মহিলাদের নিজস্ব কোন সম্পত্তির অধিকার ছিল না। স্ত্রীর উপার্জনের উপর স্বামীর পরিপূর্ণ অধিকার স্বীকৃত ছিল। নির্যাতিতা হলেও স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ছিল
উদারনীতিক নারীবাদের দার্শনিক ভিত্তি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধ্যান-ধারণার মধ্যে নিহিত আছে। তদনুসারে সকল ব্যক্তি মানুষ সমগুরুত্বসম্পন্ন। সকল ব্যক্তির নৈতিক মূল্য সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমমর্যাদা প্রাপ্য। উদারনীতিবাদীদের মতানুসারে রাজনীতিক জীবনে সকলের অংশগ্রহণের অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের বৈষম্য বা বঞ্চনামূলক আচরণ প্রতিহত করা প্রয়োজন। যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিচার-বিবেচনা করা দরকার। ব্যক্তি মানুষের প্রকৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, গুণগত যোগ্যতা বিচার্য বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উদারনীতিক নারীবাদ প্রধানত সংস্কারমূলক প্রকৃতির। এই শ্রেণীর নারীবাদীরা জনজীবনের ক্ষেত্রসমূহে নারী-পুরুষের মধ্যে সমপ্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ-সুবিধাকে উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী। অপরদিকে অনেক নারীবাদী সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে আক্রমণ করার কথা বলে থাকেন। উদারনীতিক নারীবাদীরা সাধারণত জীবনের সর্বসাধারণ ও ব্যক্তিগত (public-private) ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে পার্থক্যের বিলোপ সাধনের পক্ষপাতী নন। তাঁরা সংস্কার সাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সর্বসাধারণের ক্ষেত্রসমূহে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাই হল এর মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে শিক্ষার অধিকার ভোটাধিকার, স্বাধীনভাবে বৃত্তি গ্রহণের অধিকার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে বিশেষত, পশ্চিমী দেশগুলিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনের উদাহরণ অনস্বীকার্য। এতদসত্বেও ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রসমূহে, পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারের বিন্যাস, লিঙ্গগত শ্রমবিভাজন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।
প্রাথমিক উদারনীতিক নারীবাদের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে মেরী উলস্টোনক্রাপ্ট (Mary Woll-stonecraft) প্রণীত Vindication of the Rights of Women (১৭৯২) শীর্ষক গ্রন্থটিতে। এই গ্রন্থটি প্রথম ও প্রধান নারীবাদী গ্রন্থের মূল পাঠ হিসাবে পরিগণিত হয়। এই মহিলা সমাজবিজ্ঞানী যুক্তিসহকারে বলেছেন যে, মানুষ হিসাবে পুরুষদের মত মহিলারাও সমান অধিকার ও বিশেষাধিকারসমূহ পাওয়ার হকদার। মহিলাদের শিক্ষার অধিকার দেওয়া দরকার এবং নিজেদের অধিকারের জোরেই মহিলাদের যুক্তিবাদী জীব হিসাবে স্বীকার করা আবশ্যক। তাহলেই রাজনীতিক ও সামাজিক ক্ষেত্র লিঙ্গগত পার্থক্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। মহিলাদের হীনতর অবস্থান সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী পুরুষদের মত মহিলারাও হল যুক্তিবাদী ব্যক্তি। সুতরাং মহিলাদের সমানাধিকার থাকা উচিত। শিক্ষা, চাকরি, সম্পত্তি, ভোট প্রভৃতি ক্ষেত্রে মহিলাদের সমানাধিকারের ব্যাপারে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। ভ্যালেরী ব্রাইসন তাঁর Feminism শীর্ষক এক রচনায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “Half a century later, these principles found concrete expression at the first ever Women’s Rights Convention hold at seneca Falls in America in 1848, and the latter part of the nineteenth century saw the growth of equal rights feminism throughout the industrializing world.” অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Wollstonecraft’s feminism drew upon an Enlightenment liberal belief in reason and a radical humanist commitment to equality. She stressed the equal rights of women, specially in education, on the basis of the notion of personhood’.”
ইংল্যাণ্ডে বিশিষ্ট উদারনীতিক রাষ্ট্রদার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমলসভায় নারী ভোটাধিকারের প্রশ্নটি পেশ করেন। সহযোগী লেখক হ্যারিয়েট টেলরের সঙ্গে লিখিত জে. এস. মিলের On the Subjection of Women শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। এই গ্রন্থটিতে মহিলাদের অবস্থা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। তা ছাড়া সমাজের স্বার্থে পুরুষদের মত মহিলাদেরও সম্পূর্ণ আইনগত ও রাজনীতিক সাম্য প্রদানের কথা বলা হয়। মিলের মতানুসারে যুক্তির ভিত্তিতে সমাজ সংগঠিত হওয়া দরকার। নারী-পুরুষের বিষয়টি হল জন্মগত বিষয়। সমাজ-সংগঠনের ক্ষেত্রে বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক। পুরুষদের মত মহিলাদেরও সকল অধিকার ও স্বাধীনতায় সমানাধিকার বর্তমান। বিশেষতঃ ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে বিষয়টি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ।
আধুনিক উদারনীতিক নারীবাদ:
আধুনিক উদারনীতিক নারীবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হল যে, ব্যক্তি মানুষ হিসাবে মহিলারা যুক্তিবাদী। এই সুবাদে মহিলারা সম্পূর্ণ মানবাধিকার পাওয়ার অধিকারী। জনজীবনে নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণের সুযোগ ও স্বাধীনতা মহিলাদের থাকা উচিত। রাজনীতি ও সবেতন চাকরিতে পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদের সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এই সমস্ত ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বাধীনতা অনেকাংশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সর্বাংশে উপলব্ধ হয়নি। মহিলাদের অভিপ্রেত স্বাধীনতা, আত্মপ্রকাশ ও আনুষঙ্গিক অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতিপূরণের ক্ষেত্রে মার্কিন সমাজের অসাফল্যের কারণে উদারনীতিক প্রতিবাদ হিসাবে আমেরিকায় দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদ (second wave feminism)-এর সূত্রপাত ঘটে। এই সময় দাবি করা হয় যে, ঘর-গৃহস্থালীর দায়-দায়িত্বের বন্দী জীবন থেকে মহিলাদের মুক্তি দিতে হবে। এ বিষয়ে বিদ্যমান ব্যবহার বিধি-বিধানসমূহ নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হবে। আধুনিক উদারনীতিক নারীবাদে বিদ্যমান সামাজিক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থাকে একবারে উল্টে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। নারীবাদের এই ধারায় সাবেকি নীতিবোধ ও পারিবারিক মূল্যবোধসমূহকে আক্রমণ করা হয়নি।
আধুনিক উদারনীতিক নারীবাদের সম্যক অভিব্যক্তি ঘটেছে বেট্টি ফ্রায়েডান (Betty Friedan) প্রণীত The Feminine Mystique শীর্ষক গ্রন্থটিতে। গ্রন্থটি ১৯৬৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই মহিলা সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী বিশেষ কিছু বিশ্বাস সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মহিলাদের মধ্যে প্রথিত হয়েছে। তদনুসারে মহিলারা মনে করেন যে, ঘরের বা পরিবারের মধ্যেই তাদের পরিপূর্ণতা বর্তমান। নারীজীবনের উদ্দেশ্য হল স্বামী-সন্তান লাভ ও তাদের পরিচর্যা করা। মার্কিন নারীবাদী ফ্রায়েডান একেই বলেছেন নারীসুলভ গূঢ়শক্তি বা গুণ (feminine mystique)। এই বোধ ছিল সর্বব্যাপী ও অত্যন্ত সফল। এই মহিলা সমাজবিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে, অসংখ্য মার্কিন গৃহবধূর অভিজ্ঞতায় নৈরাশ্য ও হতাশা বর্তমান। তাদের এই হতাশার অবস্থা বলে বোঝান যাবে না। এই সমস্ত অসুখী মার্কিন মহিলারা মনে করেন যে, এর জন্য যে ত্রুটি-বিচ্যুতি তা তার নিজেরই, তার পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের নয়। এই সমস্যাকে ফ্রায়েডান বলেছেন: * problem that has name’। এই কথার মাধ্যমে ফ্রায়েডান বোঝাতে চেয়েছেন যে, বহু মহিলাকে গভীর হতাশা ও নৈরাশ্যমূলক অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়। কারণ তাদের গৃহকর্মের চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হয়। রাজনীতিক জীবনে বা জনজীবনে লাভজনক বৃত্তির মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের সুযোগ-স্বাধীনতা মহিলারা পান না। ভ্যালেরী ব্রাইসন তাঁর Feminism শীর্ষক এক রচনায় এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। Friedman was sounding a clarion catl to women, for she believed that the gains won by earlier feminists meant that the door to freedom had been opened, and that women could now walk through it and join men in pursuing careers in the public sphere.”
ফ্রায়েডান অনুধাবন করেন যে, মহিলাদের বিরুদ্ধে কিছু বৈষম্যমূলক আচরণ অব্যাহত আছে। এসবের বিরুদ্ধে সক্রিয় সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা আছে। এই উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালে অন্যান্যদের সহযোগিতায় শ্রীমতী ফ্রায়েডান ‘মহিলাদের জন্য জাতীয় সংগঠন’ (NOW– National Organization for Women) গঠন করেন। একটি জাতীয় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসাবে সংগঠনটিকে গড়ে তোলা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লিঙ্গগত সাবেকি মতাদর্শ ও অসাম্য-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করা। পরবর্তীকালে মহিলাদের স্বার্থে শ্রীমতী ফ্রায়েডান আরও কতকগুলি কর্মসূচীর উপর জোর দেন। এগুলি হল সন্তান প্রতিপালনের জন্য অধিকতর সরকারী প্রযত্ন; ঘর-গৃহস্থালীর কাজকর্মে ও সন্তান প্রতিপালনে পুরুষদের অধিকতর অংশগ্রহণ, সবেতন চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুনর্বিন্যাস, যাতে নারী-পুরুষ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গৃহকর্ম সম্পাদনে দায়িত্ব পালন করতে পারে। এমন কথাও বলা হয়েছে যে, নারীজাতি সুদীর্ঘকাল ধরে অসাম্য-বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তারজন্য ক্ষতিপূরণ করা দরকার। ক্ষতিপূরণের জন্য চাকরি-বাকরি ও রাজনীতিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীজাতির পক্ষে, পুরুষদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। যাইহোক মহিলাদের জন্য জাতীয় সংগঠন (NOW) কালক্রমে শক্তিশালী চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এবং বিশ্বের বৃহত্তম মহিলা সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে র্যাডক্লিফ রিচার্ডসও সুশন মোলার ওকিন (Susan Moller Okin) উদারনীতিক রাজনীতিক মতবাদের মাধ্যমে নারীবাদী ধ্যান-ধারণা বিকশিত হয়েছে। শ্রীমতী রিচার্ডস-এর The Sceptical Feminis. শীর্ষক গ্রন্থটি ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়। এই সমাজবিজ্ঞানী জন রলস (John Rawls)-এর আধুনিক উদারনীতিক ধ্যান-ধারণা স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। এবং এ পথে তিনি এক ন্যায়ের তত্ত্ব খাড়া করেছেন। তদনুসারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে নিজেদের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর বিকাশ সাধন করতে পারবে। এমন কথাও তিনি বলেছেন যে, ন্যায়ের এই তত্ত্ব অনুযায়ী সাময়িককালের জন্য বিপরীত বৈষম্যমূলক আচরণ (reverse discrimination)-এর প্রয়োজন হতে পারে।
Gender, Justice and the Family শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। এই গ্রন্থটিতে রিচার্ডস ও ওকিন সন্তান প্রযত্নের ক্ষেত্রে সরকারী সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিকতর নমনীয় প্রক্রিয়া এবং গৃহকর্মের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণের কথা বলেন। এই দুই সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী কেবলমাত্র ন্যায় ও যুক্তির কারণে লিঙ্গগত সাম্য আবশ্যক তা নয়; পুরুষ জাতি এবং সমগ্র সমাজের স্বার্থেও তা দরকার। ভ্যালেরী ব্রাইসন তাঁর Feminism শীর্ষক রচনায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…from this perspective, there is no reason why their proposals should be opposed, and neither explores the possibility that women’s progress might be blocked by powerful conflicting interests.”
১৯৯৩ সালে নাওমি উলফ্ (Naomi Wolf) নামে এক মহিলা সামাজবিজ্ঞানী প্রণীত Fire with Fire শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শ্রীমতী উলফ নতুন প্রজন্মের জন্য উদারনীতিক নারীবাদী বক্তব্যকে পুনরায় তুলে ধরেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী মহিলারা নিজেদের দুর্বল ও নির্যাতিতা হিসাবে দেখবে না। তারা ক্ষমতাযুক্ত নারীবাদ (power feminism)-এর অনুগামী হবে। নিজেদের জীবনধারা নির্ধারণের ব্যাপারে মহিলারা স্বাধিকার প্রয়োগ করবে। সাফল্যের ব্যাপারে ভয়কে মহিলাদের জয় করতে হবে।
উদারনীতিক নারীবাদের সমালোচনা:
উদারনীতিক নারীবাদ তীব্র বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। নারীবাদ বিরোধী চিন্তাবিদরা নারী-পুরুষ ভেদাভেদের ক্ষেত্রে সাবেকি ব্যবস্থা বা স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের পক্ষপাতী। স্বভাবতই তাঁরা নারীবাদী ধ্যান-ধারণাকে আক্রমণ করেছেন। অনান্য নারীবাদী চিন্তাবিদরাও উদারনীতিক নারীবাদের বিরোধিতা করেছেন। অন্যান্য নারীবাদীদের অভিযোগ হল যে, উদারনীতিক নারীবাদীরা মহিলাদের সম্যক স্বার্থ যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন। নি। স্বভাবতই নারী স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে তাঁরা কার্যকর পথ নির্দেশ করতে পারেননি। উদারনীতিক নারীবাদের বিরুদ্ধে সমালোচকরা বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন। তারমধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এক: তত্ত্বগত বিচারে উদারনীতিবাদের ধারণাসমূহ এবং নারীবাদী রাজনীতির চাহিদাসমূহের মধ্যে মৌলিক অসামঞ্জস্য বর্তমান। উদারনীতিবাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণাসমূহের সঙ্গে লিঙ্গগত স্বার্থসমূহের উপর ভিত্তিশীল নারীবাদী রাজনীতির সামঞ্জস্য সাধন সম্ভব নয়। উদারনীতিবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে যার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে সক্ষম। অপরদিকে নারীবাদে নারীজাতির অসুবিধাসমূহকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয় এবং মহিলাদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সমষ্টিগত সক্রিয়তার কথা বলা হয়। স্বভাবতই উদারনীতিবাদের সঙ্গে নারীবাদের সংঘাত অনিবার্য।
দুই: র্যাডিক্যাল নারীবাদীরা লিঙ্গগত রাজনীতির ভিত্তি হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সীমাবদ্ধতা-সমূহের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
(ক) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণাগত পটভূমি পিতৃতন্ত্রের কাঠামোগত প্রকৃতির দিক থেকে অপরদিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। অথচ এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে মহিলাদের অবদমিত করে রাখা হয় ব্যক্তি হিসাবে নয়। তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাসমূহ থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয় লিঙ্গগত বিচারে। লিঙ্গগত কারণেই মহিলাদের উপর সুবিন্যস্তভাবে নির্যাতন কায়েম করা হয়।
(খ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ব্যক্তিসত্তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ব্যক্তিসত্তার প্রাধান্য মহিলাদের মধ্যে লিঙ্গগত ঐক্য ও ভগিনীত্ব বোধের ভিত্তিতে সমষ্টিগত চেতনা ও সক্রিয়তার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে।
(গ) উদারনীতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লিঙ্গগত ও অন্যান্য সামাজিক সত্তামূলক পরিচিতিকে অতিক্রম করে যেতে পারে। ব্যক্তিগত বিচক্ষণতা ও সাফল্যের নিরীখে মানুষের মূল্যায়ন করতে পারে। তার ফলে লিঙ্গগত সম্পর্কের অ-রাজনীতিকীকরণ (depoliticize) হতে পারে। কারণ এই প্রক্রিয়ায় লিঙ্গগত পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয় না। এমনকি পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাসমূহ কৌশলে মহিলাদের উপর আরোপিত হতে পারে। ব্যক্তিকে লিঙ্গহীনভাবে বিচার করলে সুপ্তভাবে পুরুষ প্রকৃতি আরোপিত হয়। এইভাবে সকল মানুষকে সমানভাবে বিচার-বিবেচনা করার অর্থ নারীকে পুরুষ হিসাবে বিবেচনা করা।
তিন: সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী স্বীয় শর্তাদির পরিপ্রেক্ষিতেও উদারনীতিক নারীবাদের অসাফল্য অনস্বীকার্য। কতিপয় মহিলার লাভালাভ নিয়ে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। এ কথা ঠিক। কিন্তু এখনও কর্মক্ষেত্রে এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে যথার্থ সাম্য অধরা থেকে গেছে। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অদ্যাবধি পুরুষের আধিপত্য অব্যাহত। এখনও পুরুষদের থেকে মহিলাদের উপার্জন ক্ষমতা কম। এমন কি আইনগত ক্ষেত্রেও পরিপূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
চার: সমালোচকদের মতানুসারে ক্ষমতা ও রাজনীতির উদারনীতিক পটভূমিতে পুরুষদের ধারণাই স্বীকৃত। তারফলে নারী নির্যাতনের মূল কারণ অপ্রকাশিত থেকে যায়। তাছাড়া এ ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনায় রাজনীতির সর্বসাধারণ ক্ষেত্র এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কসমূহের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের মধ্যে এক ধরনের কৃত্রিম বিভাজন স্বীকার করা হয়। এই থেকে জীবনের আপাত বিচারে কতকগুলি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রকে সম্যকভাবে অনুধাবন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পরিবারের কথা বলা যায়। পরিবারের মধ্যে লিঙ্গগত রাজনীতি সংঘটিত হতে পারে। আবার গৃহের মধ্যে নারীর উপর হিংস্র আচরণ বা ধর্ষণের ঘটনা নিছক দুর্ভাগ্যজনক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না। কারণ এ সবের সঙ্গে সমাজের ক্ষমতা-কাঠামো সম্পর্কিত। তাছাড়া ঘর-গৃহস্থলীর কাজকর্মে মহিলাদের ভূমিকার গুরুত্ব ও মূল্যের সম্যক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের ব্যর্থতা অনস্বীকার্য। ভ্যালেরী ব্রাইসন তাঁর Feminism শীর্ষক এক রচনায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…domestic and caring work does not disappear when women enter paid employment, nor is it shared equally with men; until this problem is confronted, the liberal promise of emancipations may represent an increase in women’s burdens, and women will be unable to compete equally with men in paid work or politics.”
পাঁচ: সমালোচকদের অনেকের অভিমত অনুযায়ী নারীবাদের উদ্দেশ্যই বাস্তবে অকার্যকর প্রতিপন্ন হয়। কর্মজীবনে উন্নতিলাভে আগ্রহশীল মধ্যবিত্তশ্রেণীর মহিলাদের ক্ষেত্রে নারীবাদের লক্ষ্য অর্থবহ প্রতিপন্ন হতে পারে। বাস্তবে প্রতিযোগিতামূলক ক্রমস্তরবিন্যস্ত ঊর্ধ্বাধঃ সমাজব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কে সমালোচকরা সন্দিহান। এ ধরনের সমাজে অধিকাংশ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে জাতি ও শ্রেণীর দ্বারা শোষিত ও নিপীড়িত হবে। উদারনীতিক নারীবাদের মূল দাবী হল মহিলাদের জন্য সমানাধিকার। এই বিষয়টি সহায়ক সামাজিক পটভূমি সম্পন্ন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে অনুকূল অবস্থায় অবস্থিত মহিলাদেরই আকর্ষণ করে। কারণ এই শ্রেণীর মহিলারাই কর্মজীবনের সুযোগ-সুবিধা এবং উচ্চতর শিক্ষার যাবতীয় সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— “Liberal feminism may therefore reflect the interests of white middle-class women in developed societies, but fail to address the problems of working-class women, black women and women in the developing world.”
ছয়: সমালোচকদের মতানুসারে নারীসুলভ মূল্যবোধসমূহকে পরিত্যাগ করার পরিবর্তে পরিপুষ্ট করতে হবে। উদারনীতিক নারীবাদের বক্তব্যসমূহ পুরুষজাতির রীতিনীতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত হয়েছে। নারীজাতির প্রথাগত বৈশিষ্ট্যসমূহকে এবং মহিলাদের ক্রিয়াকর্মের মূল্য ও গুরুত্বকে উদারনীতিক নারীবাদে উপেক্ষা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য যদি হয় পুরুষের মত হওয়া, তা হলে সন্তানের জন্ম দেওয়ার সামর্থ্য মহিলাদের সীমাবদ্ধতাকেই সূচিত করবে। মহিলাদের ঘর-গৃহস্থলীর কাজকর্ম ও পরিসেবামূলক কাজকর্ম নিম্নতর প্রকৃতির ও গুরুত্বহীন প্রতিপন্ন হবে। এ প্রসঙ্গে ভ্যালেরী ব্রাইসন মন্তব্য করেছেন: “…we must recognize the interdependence that is the essential basis of human society so that male ideas of autonomy, competition and rationality must be supplemented or replaced by nurturing, co-operation and empathy.”
সাত : উদারনীতিক নারীবাদীরা অতি সহজ-সরলভাবে বিশ্বাস করেন যে, রাষ্ট্র হল একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান; নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সদর্থক ও সহায়ক ভূমিকায় পাওয়া যাবে। সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী উদারনীতিক নারীবাদীদের এই ধারণা ভ্রান্ত। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃতি এবং নারী-পুরুষের স্বার্থসমূহ সম্পর্কে উদারনীতিক নারীবাদীরা নিজেরাই বিভ্রান্ত। এই শ্রেণীর নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থা সকলের স্বার্থের পরিপোষক। ন্যায়ভিত্তিক সমাজে মহিলাদের মত পুরুষেরাও নারীবাদী হতে পারে। কিন্তু সমালোচকদের মতানুসারে নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে পুরুষজাতির এক ধরনের কায়েমী স্বার্থ আছে। রাষ্ট্র ও সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ ধারা বা প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে পুরুষের প্রভাবাধীন।
আট: সমালোচকদের মধ্যে অনেকের অভিমত হল যে, রাষ্ট্র পুঁজিবাদী অর্থনীতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। নারী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থের সঙ্গে পুরুষ জাতির স্বার্থের বিরোধ বাধলে, নারীজাতির স্বার্থ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। ব্রাইসন বলেছেন: “…confusion over the nature of the state is increased by liberal feminist demands for state action… for this is contrary to liberal principles of limited government and non-intervention.”
উপসংহার: উদারনীতিক নারীবাদের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শের অভিব্যক্তি ঘটেছে। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এতদসত্ত্বেও এই মতবাদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তাও অস্বীকার করা যাবে না। ন্যায়, স্বাধীনতা ও সাম্য সম্পর্কিত উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। নারীজাতির স্বার্থের ক্ষেত্রে এই সমস্ত ধারণার প্রয়োগ অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রয়োগ প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিক এই সমস্ত আদর্শের পুনর্মূল্যায়ন ও উন্নতি সাধন সম্ভব।