ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি। শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য। ভূমি রাজস্ব হল ‘মাল’ বা ‘খারাজ’। মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত। তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ (খামস); স্থানীয় আবওয়াব জিহত, শয়ের-ই-জিহত, ফুরুয়াত, অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত।
আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২,৮২,৮৩, ৮২৫ টাকা, সুজন রায়ের মতে, ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২,৬৮,১৬,৫৮৪ টাকা, এই রাজস্বের ৬% ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪% ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন। বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত।
বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন। দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত। হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি। মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর। আকবরের আগে দু’জন মুসলিম শাসক আলাউদ্দিন খলজী ও শের শাহ ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। আকবর এদের সংস্কার দ্বারা অবশ্যই প্রভাবিত হয়েছিলেন। আকবর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা করে তুলেছিলেন।
১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইতমাদ খাঁ দেওয়ান নিযুক্ত হয়ে জায়গীর জমি থেকে খালসা জমিকে পৃথক করেন। খালসা জমি জরিপ পরে রাজস্ব ধার্যের ব্যবস্থা করেন। এরপর মুজাফফর খাঁ দেওয়ান পদে বসে কানুনগোদের সাহায্যে জমি জরিপ করে ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করার ব্যবস্থা করেন। এরই ভিত্তিতে তিনি যে হিসাব কিতাব করেন তা হাল-ই-হাসিল নামে পরিচিত। মুজাফফর খাঁ নিয়ম করেন যে জমির যেমন উৎপাদন লেখা থাকবে সেই হারে রাজস্ব ধার্য করা হবে।
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজা টোডরমল দেওয়ানের পদে বসলে তিনি তাঁর সহকারী শাহ মনসুরের সাহায্যে মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করেন। টোডরমলের আমলে তিন প্রকার ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত হয় যথা জাবতি বা দহসালা প্রথা’ খালাবকস, ও নাকস্ প্রথা।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ভারতে ভ্রমণকারী বিদেশী পর্যটকরা মুঘল রাষ্ট্রকে সমস্ত জমির মালিক বলে উল্লেখ করেছেন। ইংরেজ আমলারা এই মতবাদ মেনে নিয়ে বলেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘলদের কাছ থেকে এই মালিকানা পেয়েছে। কিন্তু আবুল ফজল সম্রাটের কর চাপাবার অধিকারকে শুধুমাত্র ‘সার্বভৌমতার’ দাবি বলে স্বীকার করেছেন – কারণ সম্রাট শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। কোথাও রাজার সম্পদ ব্যবহারের জন্য খাজনা হিসেবে রাজস্বকে বর্ণনা করা হয়নি। ইরফান হাবিবের সিদ্ধান্ত যে মুঘলদের ভূমি রাজস্ব জমির কর বা খাজনা নয়। প্রভুত্বের অধিকার কেবল জমির ফসলের ওপর সীমিত ছিল, (it was a tax on the crop)। এদিক থেকে দেখলে ব্রিটিশ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সঙ্গে মুঘল ভূমি রাজস্বের কোন মিল নেই। ব্রিটিশ সরকার জমির উৎপাদন নির্বিশেষে জমির ওপর স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট কর ধার্য করেছিল। মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ‘মাল’ হল জমিতে উৎপন্ন ফসলের ওপর রাষ্ট্রের দাবি।
মুঘল ভূমি রাজস্বের এই প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে যায় রাজস্ব নির্ধারণ পদ্ধতি থেকে। এই পদ্ধতি নিঃসন্দেহে জটিল এবং দীর্ঘকাল ধরে তা গড়ে উঠেছিল। এই পদ্ধতির চারটি রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে।
ভাওলি বা বাটাই: ফরাসিতে খালাবক্সি, ভাওলি বা বাটাই আবার দু ভাগে বিভক্ত খুসাবাটাই খাল্লাবাটাই। খুসাবাটাই -হল ফসল না ঝেড়ে আঁটিতে ভাগ করে নেওয়া। খাল্লাবাটাই হল শস্যের ভাগ, সরকার ও কৃষক উৎপন্ন শস্যের ভাগ পেত, তবে কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দেবার পর শস্য ভাগ করা হত। ফসল না হলে রাষ্ট্র কোন রাজস্ব পেত না। রাজস্ব আদায়ের এই পদ্ধতি ছিল সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
কানকুত: প্রশাসনের সময় ও ব্যয় কমানোর জন্য উন্নত ধরনের রাজস্ব নির্ধারণ পদ্ধতি হল কানকুত। কান হল শস্য, কুত হিসাব। বিঘা প্রতি উৎপন্ন শস্যের হিসাব করে মোট উৎপাদনের হিসাব মিলত। উত্তম, মাধ্যম ও সাধারণ তিন শ্রেণীর জমি উৎপাদনের গড় হিসেব করে, জমি জরিপ করে রাজস্ব ধার্য করা হত।
কানকুত পদ্ধতিতে রাজস্ব ধার্যের ঝামেলা ও ব্যয় খানিকটা রাষ্ট্রের কাছে কমেছিল ঠিকই, কিন্তু রাজস্বের সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা থেকে গিয়েছিল। রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে কৃষক ও রাষ্ট্র উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হত। এজন্য কানকুত ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন শের শাহ। প্রতিবছর শস্যের হিসেব প্রস্তুত করার বদলে তিনি আবাদি জমির একটি স্থায়ী গড় তালিকা তৈরি করান। তিন ধরনের জমির গড় উৎপাদন তৈরি করে জমির ফসলের উপর এক তৃতীয়াংশ কর ধার্যের ব্যবস্থা করেন। কানকুত ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে জাবত বা জাবতি ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
জাবত বন্দোবস্ত: জাবত শব্দের অর্থ পরিমাপ, রাজস্ব ধার্য ও আদার নয়। তিনি শুধু আবাদি জমির পরিমাপ করে পূর্ব-নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য করবেন। ইরফান হাবিব লিখেছেন যে জাবত এমন একটি নির্ধারণ পদ্ধতি যাতে প্রতিবার ফসল তোলার সময় এলাকা জরিপ করতে হয়। তারপর ‘জমা’ বার করার জন্য দস্তুর-আল-আলম (শস্যের হিসাব) ব্যবহার করা হয়। জাবতের মধ্যে ছিল দুটো জিনিস নগদে বাঁধা রাজস্ব হার আর জমি জরিপ। আবাদি জমির একাংশে ফসল না হলে (নাবুদ) রাজস্বের একাংশ (সর্বোচ্চ ১২ ১/২%) বাদ যেত।
জাবত ব্যবস্থায় জমি জরিপের জন্য ইলাহিগজ ব্যবহার করা হত। ৬১ গজ × ৬০ গজ জমির পরিমাপকে এক বিঘা ধরা হত। জাবতি প্রথায় ফসল উৎপাদনের ভিত্তিতে কৃষি জমিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়, যথা – পোলাজ যে জমি প্রতি বছর চাষ হত এবং কখনো অনাবাদি থাকত না।
পরৌটি- যে জমিতে সব সময় আবাদ হত না।
চাচর – যে জমি ৩/৪ বছর অনাবাদি থাকত।
বানজারা – যে জমি ৫ বা তার বেশি বছর অনাবাদি থাকত।
প্রতি পরগনায় জমিকে সরেশ, মাঝারি, নিরেশ এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করে প্রতি শ্রেণীর ১০ বছরের মোট উৎপাদনের গড় করে সেই গড় উৎপাদনের ১/৩ ভাগ ছিল সরকারি ভূমি রাজস্ব।
নাসক্ বন্দোবস্ত: জাবত ব্যবস্থার পরিণত রূপ। যেখানে মাটির ধরন সমজাতীয় নয়, ফসল অনিশ্চিত সেখানে জাবতি সুপ্রযোজ্য হত না। তাছাড়া প্রতিবছর জমি জরিপ প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করত, তাই আকবর কয়েকটি বন্দোবস্ত নেন। প্রত্যেক রেভেনিউ বিভাগের আবাদি জমি শস্যের প্রকৃতি উৎপন্ন শস্যের পরিমাণ গড়দাম ইত্যাদি হিসেব করে (১৫৭০-১৫৮০) তিনি স্থায়ী রাজস্ব হার নির্ধারণের নির্দেশ দেন। এই স্থায়ী ভূমি রাজস্ব হার ধার্য ও সংগ্রহকে বলা হত নাসক।
আকবরের শাসনকালে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা স্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ নেয়। তবে প্রয়োজন হলে ভূমি রাজ্যের পরিবর্তন ঘটানোর অধিকার রাষ্ট্রের ছিল। মুর্শিদকুলি খাঁ দাক্ষিণাত্যে কানকুত ব্যবস্থার পরিবর্তন করেন। লাঙলের সংখ্যা অনুযায়ী ভূমি রাজস্ব ধার্যের পুরোনো পদ্ধতি তিনি বাতিল করে দেন। পাঞ্জাব থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিল আকবরের জাবত ব্যবস্থা। রাজস্থান, কাশ্মীর, গুজরাট ও সিন্ধুতে কানকুত ও ভাওলি, বাংলায় ছিল স্থায়ী ‘মুক্তাই ব্যবস্থা’।
জমির উৎপাদিকা শক্তি, শস্য উৎপাদনের জন্য শ্রম ও মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ, জলসেচের সুযোগ সুবিধা, কৃষকদের আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিচার করে তবেই রাজস্ব ধার্য করা হত, এ সমস্ত বিষয় হিসেবে মধ্যে থাকলেও মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থায় করের হার ছিল খুব উঁচু। শিরীন মুসবি ও ইরফান হাবিব উভয়ে জানিয়েছেন যে, উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রীয় দাবি হলেও রাষ্ট্রের দাবি অনেক ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। এর উপরে থাকত জিহত, সয়ের – ই – জিহত, ফুরুয়াত ও আবওয়াব। তবে ফসলের ক্ষতি হলে ভাওলি ও কানকুত ব্যবস্থায় কৃষক রাজস্বের ছাড় পেত। জাবত ব্যবস্থায় ও ১২ ১/২ (সাড়ে বারো শতাংশ) পর্যন্ত ছাড়ের ব্যবস্থা ছিল। কৃষক যাতে চাষ বন্ধ না করে, তার জন্য তাকে ‘তাকাবি’ বা কৃষি ঋণ দানের ব্যবস্থা ছিল। বীজ, বলদ কিনে কৃষক যাতে আবার চাষ করতে পারে সেজন্য রাষ্ট্র থেকে এই ঋণ দেওয়া হত।
অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী আকবরের জাবত ব্যবস্থায় কৃষককে উৎসাহ প্রদানকারী দুটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। বিশেষ ধরনের বাণিজ্য পণ্য উৎপাদন করলে বা পতিত জমি চাষের আওতায় আনলে রাজস্বের ক্ষেত্রে ছাড় মিলত।